গন্তব্য ঠিক করেই দেশ ১১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি ট্রেনে উঠে পড়ায় পরবর্তী প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে ভালো নির্বাচন হতে আর কী কী বাধা থাকছে? সেই চ্যালেঞ্জগুলো আমরা কতটা জানি, জানলেও কি স্বীকার করি এবং বুঝলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে নির্বাচনি পরিবেশ উৎসাহব্যঞ্জক বা নিদেনপক্ষে স্বস্তিদায়ক হয়?
এখন প্রশ্ন যা-ই থাকুক, তিন-তিনটি মিথ্যা ভোটের আয়োজকরা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছেন আগেই, ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। ফলে রাষ্ট্র মেরামতসহ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রাপ্য হয়ে পড়ে এই দেশের মানুষের এবং তারা তা আশাও করে। ভোটাধিকারের নৈতিক দাবির পাশাপাশি, জনতার আশায় উৎসাহ জুগিয়েছে উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণা।
তবে তার প্রত্যয় মোতাবেক ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ সত্যি সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না—তা বলতে পারে শুধু ভবিতব্য। জাগতিক মানুষ ইউনূস সাহেবের আশাবাদী বক্তব্যকে বাইবেলের বাণী হিসেবে ধরে নেওয়ার উপায় নেই, চ্যালেঞ্জ করারও কিছু নেই।
প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা বা গড়ে না ওঠা এই দেশে শিগগিরই ভোট হওয়া নিয়েই সংশয় কিছুটা ছিল এবং সংশয়বাদীদের ‘ঈমান’ আরো দুর্বল করেছে নির্বাচনবিরোধী গোষ্ঠীর বাড়তি অনিশ্চয়তা সৃষ্টির প্রচারণা। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ভয়ের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছে।
যারা মনে মনে বা ইশারা-ইঙ্গিতে চাইছিলেন নির্বাচন একেবারেই না হোক, তারা ১২ ফেব্রুয়ারি-২০২৬-এ ভোটের তারিখ ঠিক করে তফসিল ঘোষণায় নিশ্চিতভাবেই বেজার হয়েছেন। তারপরও হতাশার দেখেছেন কী, ভোটের প্রচার জমে উঠলে এবং নির্বাচনটি একবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের বেদনা বাড়তে পারে বহুগুণে। আরো বেপরোয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাদের, আবার শক্তি ক্ষয়েরও। সুতরাং হাদিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা বর্তমান ও ভবিষ্যতের সহিংস প্রতিবিপ্লবী প্রতিক্রিয়াই নির্দেশ করে।
এই প্রবণতার একটি কোমল রূপ হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ‘নির্বাচন আদৌ হবে না’ বলে এতদিনের প্রচার, যে প্রচারে বুদ্ধিমানদের জন্য আছে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। এই ‘প্রোপাগান্ডা’ জনগণকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে দুটি রূঢ় বাস্তবতা—১. বিপ্লব-পরবর্তী বয়ান তৈরিতে কর্তৃপক্ষ ও মিডিয়ার ব্যর্থতা এবং ২. বিপ্লবের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি এবং তাতে করে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের নবজন্ম লাভের খোয়াব।
এমতাবস্থায়, একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করাটাই হবে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। যে ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের রাজনৈতিক ও জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল-২০২৪-এ এবং প্রতিশ্রুতি এসেছিল খোদ প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে, এর বাস্তবায়ন তার একার ওপর নির্ভর করে না।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে ১৯৯১ সালে। নির্বাচনি পরিবেশ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এমন ছিল যে কারচুপির চেষ্টাই হয়নি। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু ২০০৮ সালে এসে সেই অবাধ পরিবেশ থাকেনি এবং এরপর ক্ষমতাসীন হাসিনার দলীয় এবং সহযোগীদের দৌরাত্ম্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অবশিষ্ট কিছু থাকেনি।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব বিষয় এবং অনুঘটকের সমন্বয় হতে হয়, সেগুলো হলো রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা, সরকারের সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা, জনগণের উদ্দীপনা এবং বৃহৎ শক্তি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অদৃশ্য সহযোগিতা।
২০২৬-এর সংসদীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষজ্ঞরা যে একডজন চ্যালেঞ্জ নির্ণয় করেছেন, সেগুলো হচ্ছে—রাজনৈতিক বিভেদ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনি অফিসার নিয়োগ ও তাদের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন, ভারতের ভূমিকা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, একই দিনে সংসদীয় নির্বাচন ও গণভোট, নির্বাচন কমিশনের অনভিজ্ঞতা, নির্বাচনি আবহ তৈরি হওয়া না হওয়া, পোস্টাল ব্যালট, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং প্রাক-নির্বাচনি সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ। এই চ্যালেঞ্জগুলো বোদ্ধারা তুলে ধরেছেন সাম্প্রতিক এক শিক্ষামূলক আলোচনায়।
কর্তৃপক্ষ শুধু এগুলো মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না, নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে জন-আস্থা তৈরি এবং প্রতিযোগিতামূলক কিন্তু শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান আশ্বস্ত করলেই মানুষ ভোট দিতে আগ্রহী হবে। অবশ্যই শর্ত থাকে দল ও প্রার্থীরা কতটা গণমুখী এজেন্ডা নিয়ে ভোটারদের দ্বারে হাজির হয়।
চলমান মাঠ বাস্তবতা ও জনগণের ধারণা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভোটগ্রহণ বা ফল ঘোষণায় নয়, বরং তার আগে ও পরে। কারণটা রাজনৈতিক মেরূকরণ-সংক্রান্ত।
পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলের পতন এবং তার বেকায়দায় থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে আরো দুবার। ১৯৭৫-এ সামরিক অভ্যুত্থানে মুজিব সরকারের পতন হলে ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯-এর সংসদ নির্বাচন হয় একদলীয় বাকশালের মৃত্যু ও বাকশালে একীভূত আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে। ১৯৯০ সালে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে তার জাতীয় পার্টি ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তৃতীয় বৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। পতিত আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনবিরোধী এবং ফ্যাসিবাদী নীতি ও কার্যকলাপের দায়ে অভিযুক্ত এবং নিষিদ্ধ। এর শরিক দলগুলোও অভিযুক্ত। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী ভারতে আশ্রিত এবং সেই ভারত চায় (আওয়ামী লীগসহ) অন্তর্ভুক্তিমূলক সাধারণ নির্বাচন।
সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতার সব স্বাদ নেওয়া অবৈধ অর্থ ও অস্ত্র এবং আন্তঃসীমান্ত নেটওয়ার্ক-সমৃদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং তার দোসররা মরণ-কামড় দিতে পারে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে। দেশের বাইরে হাসিনা শাসনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগী ভারত চাইবে অন্তত পরবর্তী ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংলাপ এবং আগামী রাজনৈতিক বন্দোবস্তে দিল্লির প্রতি নমনীয় রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো সতেজ রাখতে। সেই দিক থেকে এই নির্বাচন, কিছু ব্যক্তি বন্ধু ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া, ‘ভারতের’ প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা একটু কম।
কারণ দু-চারটি দল বাদ দিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছুক প্রায় সব দল ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ পায়নি। এই মজলুম দলগুলোর নিশ্চয়ই ‘ঠেকা’ পড়েনি খাল কেটে কুমির আনার, যাতে আওয়ামী লীগ আবার গণতন্ত্র হত্যা করতে পারে।
অনেক বছর পর একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে দেড় দশকে নির্যাতিত ও বঞ্চিত রাজনীতিকদের স্টেইক অনেক বেশি। হয় এবার, নয়তো কখনোই নয়—এমন অবস্থাও অনেকের। সেই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ও শরিকদের ছাড়পত্র পাওয়া না পাওয়া, ভোটারদের নতুন চিন্তা ও মেরূকরণ—এসব বিষয় একটু উত্তেজনা তৈরি করতেই পারে।
এগুলোর বাইরে, সন্ত্রাসী আস্তানায় এবং এমনকি রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক, অলিগার্কিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে অদৃশ্য শক্তির নীরব কিন্তু কার্যকর উপস্থিতি নির্বাচনি পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে। যারা চায় বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংকটের দিকে ধাবিত হোক এবং জনপ্রতিনিধিরা সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচিত না হোক, তারা প্রমাণ করতে চায় হাসিনার আমলই ভালো ছিল।
তাহলে পক্ষ দাঁড়াচ্ছে দুটো—ক. নির্বাচনের পক্ষে নির্বাচন কমিশন তথা সরকার এবং বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো এবং খ. ক্ষমতা হারানো দল নিষিদ্ধ হওয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তাদের দেশি-বিদেশি উপকারভোগীরা। এখনকার দ্বিতীয় পক্ষরা কী করতে পারে, তা অনুমেয়, কিন্তু প্রথম পক্ষ ঐক্য দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তা সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল। নির্বাচন হয়ে গেলেও দ্বিতীয় পক্ষ বসে থাকবে না।
সেই নির্বাচন হওয়াটা শান্তিপূর্ণ এবং অর্থবহ করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যে সুসংহত এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরপেক্ষ, সেই সিগন্যাল দিতে হবে জনসমক্ষে। রেফারি হিসেবে তার ভূমিকা হতে হবে শক্তিশালী এবং রাজনৈতিক উত্তরণে অনুঘটকের মতো।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের বুঝতে হবে তাদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব তাদের কারো জন্যই লাভজনক নয়। তাদের দেখানো দরকার এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে তারা একমত ও বদ্ধপরিকর। তাই হতে পারে নির্বাচনে বিজয়ীরা গঠন করবেন সর্বদলীয় সরকার, যদি তা জাতীয় স্বার্থের সবচেয়ে বেশী অনুকূল মনে করেন।
লেখক : সাংবাদিক
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


ভারতীয় সাবেক কর্ণেলের হুমকি, হাদির পর ‘টার্গেট’ হাসনাত
নানক-আসাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ফয়সালের