মাহবুব উল্লাহ
বেশ কিছুদিন হলো ভারতের সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি অযাচিত মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত সরকার এলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হবে। এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হলো-একটি রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান কি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলতে পারেন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কেমন হবে, সেটা শুধু ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের বিচার বিবেচনার বিষয় নয়, সেটার ব্যাপ্তি অনেক বেশি। ভারতের সামরিক কর্তৃপক্ষ যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামায়, ভারতীয় সেনাপ্রধানের উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট। দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ যখন নাক গলায়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র দুটোর সম্পর্ক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিষয়টির অতিরিক্ত সামরিক দ্যোতনাও আছে। ভারত বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে তার ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করতে চায়, যা সে অতীতেও করেছে এবং বর্তমানেও করার ফন্দিফিকিরে আছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারত শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব করিডোর সুবিধা নিয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্য হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স কথিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের ভূখণ্ডগত যোগাযোগ অক্ষত রাখা। উত্তর-পূর্ব ভারতে নানা কিসিমের ইমার্জেন্সি ও অসন্তোষ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে করিডোর পাওয়ার আগে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ রক্ষা করা হতো এবং রক্ষা করা হচ্ছে সংকীর্ণ চিকেন নেক দিয়ে। যার প্রস্থ বিশ-বাইশ মাইলের বেশি নয়। এর সঙ্গেই রয়েছে চীন সীমান্ত। ভারতের উদ্বেগ চীন যেকোনো সময় চিকেন নেক দখল করে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এমনিতে চীন উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে নিজস্ব ভূখণ্ড বলে দাবি করেছে। অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনার চীনা নাম দিয়েছে। এসব কারণে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে বিশেষ করে তার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপদমুক্ত রাখতে ভারত বাংলাদেশকে বগলদাবা করতে চায়। একজন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বেশ কবছর আগে মন্তব্য করেছিলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতে নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিামাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্য দিয়ে আড়াআড়ি পথ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে সৈন্য ও রসদ পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এই লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দখল করতেও দ্বিধা করবে না।
ভারতের সেনাপ্রধান আশা করেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হবে। প্রশ্ন জাগে, সুসম্পর্ক বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নয় কেন? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হয়, এ সরকার শেখ হাসিনার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবে না। উপরন্তু ভারতের আপত্তিকর আবদার-অনুরোধও রক্ষা করতে রাজি নয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ভারতের প্রধান ও অতি মূল্যবান অ্যাসেট। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি, তা ভারত চিরকাল মনে রাখবে। ভারতের প্রতি উদারহস্ত এই মহিলাকে ভারত ক্ষমতায় রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিজয় নিশ্চিত করতে ভারত তার পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে পাঠিয়েছিল। সুজাতা সিং ঢাকায় এসে কী করেছেন, তা দেশবাসী জানে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য ভারত সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে এবং চালিয়ে যাচ্ছে। বেআইনিভাবে শেখ হাসিনাসহ তার দলের চাঁইদের আশ্রয় দিয়ে এবং ভারত থেকে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে ভারত একটা কথাই প্রমাণ করেছে। আর সেটা হলো শেখ হাসিনাই বাংলাদেশে তার পরম নির্ভরতার পাত্র।
প্রশ্ন ওঠে, সামনে যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনে ভারত যে দলটিকে ক্ষমতায় দেখার প্রত্যাশা করে, সে দলটি ভারতের স্বার্থ সহায়ক কোনো দল হবে বলে মনে হয়। তবে সেই দলটি কোন দল তা ভেবে পাওয়া কঠিন। আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিতাড়িত একটি দল। এই দলের নির্বাচন করা এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুনর্বাসিত হওয়ার বাসনা অনেকটাই সুদূরপরাহত। বাংলাদেশে যেসব দল আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে আমরা বুঝতে পারি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন ইসলামি দল, বিভিন্ন বাম দল এবং নতুনভাবে গঠিত হতে পারে এমন কিছু দল। এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, এ দলগুলোর মধ্যে ভারতের পছন্দনীয় অথবা পছন্দের সম্ভাব্য দল বা দলগুলো কী। এই মুহূর্তে চিহ্নিত করে বলা হলে তা একধরনের অগ্রিম কথা বলা হয়ে যাবে। তবে এ কথা নিশ্চিত বলা যায়, বাংলাদেশের কোনো দল যদি ভারতের পছন্দের দল হয়, তাহলে সেই দল বাংলাদেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশের মানুষ চায় বাংলাদেশে সে দলই ক্ষমতায় আসুক যে দল ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে, যে দল সব ধরনের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি থেকে মুক্ত থাকবে। এমন দলই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে সক্ষম।
আমি যখন এই কলাম লিখছি, তার দুদিন আগে শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বরের বাসভবন ও মিউজিয়াম, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদনসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে অথবা অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভারত থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার চরম উসকানিমূলক মনে করে এই ধ্বংসযজ্ঞ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড উচ্ছৃঙ্খল মবের কর্মকাণ্ড রূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে আমরা বুঝতে পারব শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ক্ষোভের আগুন এখনো নিভে যায়নি। কাজেই শেখ হাসিনার যেকোনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অনভিপ্রেত মনে হলেও একেবারে অস্বাভাবিক নয়। এমন ঘটনা না ঘটলেই হয়তো ভালো হতো। তবে শেখ হাসিনা থামছেন না বলেই তার হাতে নির্যাতিত দেশের জনগণকে থামানো সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতাচ্যুত হয়, তাহলে এক রাতের মধ্যেই পাঁচ লাখ লোক নিহত হবে। ২৪ জুলাই-আগস্টেও মহা-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটলেও ওবায়দুল কাদের কথিত প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনা এক তিলও ঘটেনি। হাজারের ওপর ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হলো, নিহতদের অনেকের লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো এবং অনেককে বেওয়ারিশ হিসেবে পুলিশের উপস্থিতিতে দাফন করা হলো, হাজার হাজার মানুষ আহত ও পঙ্গু হলো, তা সত্ত্বেও কোনো প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনা ঘটেনি।
এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধৈর্যশীল এবং ক্ষমাশীলও বটে। আশা করা গিয়েছিল, এত রক্ত, এত অশ্রু ঝরানোর পর আওয়ামী লীগে সুমতি আসবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, কোনো আওয়ামী লীগারের ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। শেখ হাসিনার তো নেই-ই। যদি তারা অনুশোচনা করত এবং জাতির কাছে ক্ষমা চাইত, তারপর যদি তাদের ঘরবাড়ি ভাঙার ঘটনা ঘটত, তাহলে এর নিন্দা জানাতে কসুর করতাম না। একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররাও ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা পাননি। ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। পরে ইন্দিরা গান্ধী আবার যখন নির্বাচন করলেন, তখন তিনি নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই বললেন, ম্যায় মাফি মাঙতা হু। ইন্দিরা ক্ষমা চাইলেন, জনগণ তাকে পুনর্নির্বাচিত করল। ইন্দিরা জরুরি অবস্থা জারি করে ভারতে যে নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছিলেন, তার চেয়েও শতসহস্র গুণ নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার দেশবাসীর ওপর। তিনি রয়েছেন অনুশোচনাহীন। তারপরও কি বলা যাবে ছাত্র-জনতা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে?
ভারত সরকার ভাঙচুরের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। ভারত কি শেখ হাসিনার হাতে যারা গুম, খুন, হত্যাকাণ্ডসহ বিবিধ লোমহর্ষক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার নিন্দা জানিয়েছে? একটি ঘটনা যদি এক চোখে দেখা হয়, তাহলে তা কারোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ যদি ভারতের অনুগ্রহ, অনুকম্পা প্রার্থী হয়, তাহলে তার চেয়ে বেশি দুঃখের আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে ভারত অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ চালিয়ে যাবে। ভারতের অনুসৃত এই নীতিতে অদূর ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে হয় না। সে জন্য বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি ভারতকে বিবেচনায় না রেখে চালু থাকতে পারে না। ভারত সম্পর্কে কী নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, সেটাই কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির দেশপ্রেম যাচাই করার একটি কষ্টিপাথর। যাচাইয়ের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কেউ যেন অদেশপ্রেমিক প্রমাণিত না হন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক
বেশ কিছুদিন হলো ভারতের সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি অযাচিত মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত সরকার এলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হবে। এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হলো-একটি রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান কি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলতে পারেন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কেমন হবে, সেটা শুধু ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের বিচার বিবেচনার বিষয় নয়, সেটার ব্যাপ্তি অনেক বেশি। ভারতের সামরিক কর্তৃপক্ষ যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামায়, ভারতীয় সেনাপ্রধানের উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট। দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ যখন নাক গলায়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র দুটোর সম্পর্ক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিষয়টির অতিরিক্ত সামরিক দ্যোতনাও আছে। ভারত বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে তার ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করতে চায়, যা সে অতীতেও করেছে এবং বর্তমানেও করার ফন্দিফিকিরে আছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারত শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব করিডোর সুবিধা নিয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্য হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স কথিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের ভূখণ্ডগত যোগাযোগ অক্ষত রাখা। উত্তর-পূর্ব ভারতে নানা কিসিমের ইমার্জেন্সি ও অসন্তোষ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে করিডোর পাওয়ার আগে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ রক্ষা করা হতো এবং রক্ষা করা হচ্ছে সংকীর্ণ চিকেন নেক দিয়ে। যার প্রস্থ বিশ-বাইশ মাইলের বেশি নয়। এর সঙ্গেই রয়েছে চীন সীমান্ত। ভারতের উদ্বেগ চীন যেকোনো সময় চিকেন নেক দখল করে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এমনিতে চীন উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে নিজস্ব ভূখণ্ড বলে দাবি করেছে। অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনার চীনা নাম দিয়েছে। এসব কারণে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে বিশেষ করে তার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপদমুক্ত রাখতে ভারত বাংলাদেশকে বগলদাবা করতে চায়। একজন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বেশ কবছর আগে মন্তব্য করেছিলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতে নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিামাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্য দিয়ে আড়াআড়ি পথ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে সৈন্য ও রসদ পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এই লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দখল করতেও দ্বিধা করবে না।
ভারতের সেনাপ্রধান আশা করেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হবে। প্রশ্ন জাগে, সুসম্পর্ক বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নয় কেন? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হয়, এ সরকার শেখ হাসিনার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবে না। উপরন্তু ভারতের আপত্তিকর আবদার-অনুরোধও রক্ষা করতে রাজি নয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ভারতের প্রধান ও অতি মূল্যবান অ্যাসেট। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি, তা ভারত চিরকাল মনে রাখবে। ভারতের প্রতি উদারহস্ত এই মহিলাকে ভারত ক্ষমতায় রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিজয় নিশ্চিত করতে ভারত তার পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে পাঠিয়েছিল। সুজাতা সিং ঢাকায় এসে কী করেছেন, তা দেশবাসী জানে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য ভারত সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে এবং চালিয়ে যাচ্ছে। বেআইনিভাবে শেখ হাসিনাসহ তার দলের চাঁইদের আশ্রয় দিয়ে এবং ভারত থেকে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে ভারত একটা কথাই প্রমাণ করেছে। আর সেটা হলো শেখ হাসিনাই বাংলাদেশে তার পরম নির্ভরতার পাত্র।
প্রশ্ন ওঠে, সামনে যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনে ভারত যে দলটিকে ক্ষমতায় দেখার প্রত্যাশা করে, সে দলটি ভারতের স্বার্থ সহায়ক কোনো দল হবে বলে মনে হয়। তবে সেই দলটি কোন দল তা ভেবে পাওয়া কঠিন। আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিতাড়িত একটি দল। এই দলের নির্বাচন করা এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুনর্বাসিত হওয়ার বাসনা অনেকটাই সুদূরপরাহত। বাংলাদেশে যেসব দল আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে আমরা বুঝতে পারি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন ইসলামি দল, বিভিন্ন বাম দল এবং নতুনভাবে গঠিত হতে পারে এমন কিছু দল। এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, এ দলগুলোর মধ্যে ভারতের পছন্দনীয় অথবা পছন্দের সম্ভাব্য দল বা দলগুলো কী। এই মুহূর্তে চিহ্নিত করে বলা হলে তা একধরনের অগ্রিম কথা বলা হয়ে যাবে। তবে এ কথা নিশ্চিত বলা যায়, বাংলাদেশের কোনো দল যদি ভারতের পছন্দের দল হয়, তাহলে সেই দল বাংলাদেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশের মানুষ চায় বাংলাদেশে সে দলই ক্ষমতায় আসুক যে দল ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে, যে দল সব ধরনের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি থেকে মুক্ত থাকবে। এমন দলই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে সক্ষম।
আমি যখন এই কলাম লিখছি, তার দুদিন আগে শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বরের বাসভবন ও মিউজিয়াম, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদনসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে অথবা অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভারত থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার চরম উসকানিমূলক মনে করে এই ধ্বংসযজ্ঞ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড উচ্ছৃঙ্খল মবের কর্মকাণ্ড রূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে আমরা বুঝতে পারব শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ক্ষোভের আগুন এখনো নিভে যায়নি। কাজেই শেখ হাসিনার যেকোনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অনভিপ্রেত মনে হলেও একেবারে অস্বাভাবিক নয়। এমন ঘটনা না ঘটলেই হয়তো ভালো হতো। তবে শেখ হাসিনা থামছেন না বলেই তার হাতে নির্যাতিত দেশের জনগণকে থামানো সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতাচ্যুত হয়, তাহলে এক রাতের মধ্যেই পাঁচ লাখ লোক নিহত হবে। ২৪ জুলাই-আগস্টেও মহা-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটলেও ওবায়দুল কাদের কথিত প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনা এক তিলও ঘটেনি। হাজারের ওপর ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হলো, নিহতদের অনেকের লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো এবং অনেককে বেওয়ারিশ হিসেবে পুলিশের উপস্থিতিতে দাফন করা হলো, হাজার হাজার মানুষ আহত ও পঙ্গু হলো, তা সত্ত্বেও কোনো প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনা ঘটেনি।
এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধৈর্যশীল এবং ক্ষমাশীলও বটে। আশা করা গিয়েছিল, এত রক্ত, এত অশ্রু ঝরানোর পর আওয়ামী লীগে সুমতি আসবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, কোনো আওয়ামী লীগারের ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। শেখ হাসিনার তো নেই-ই। যদি তারা অনুশোচনা করত এবং জাতির কাছে ক্ষমা চাইত, তারপর যদি তাদের ঘরবাড়ি ভাঙার ঘটনা ঘটত, তাহলে এর নিন্দা জানাতে কসুর করতাম না। একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররাও ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা পাননি। ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। পরে ইন্দিরা গান্ধী আবার যখন নির্বাচন করলেন, তখন তিনি নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই বললেন, ম্যায় মাফি মাঙতা হু। ইন্দিরা ক্ষমা চাইলেন, জনগণ তাকে পুনর্নির্বাচিত করল। ইন্দিরা জরুরি অবস্থা জারি করে ভারতে যে নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছিলেন, তার চেয়েও শতসহস্র গুণ নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার দেশবাসীর ওপর। তিনি রয়েছেন অনুশোচনাহীন। তারপরও কি বলা যাবে ছাত্র-জনতা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে?
ভারত সরকার ভাঙচুরের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। ভারত কি শেখ হাসিনার হাতে যারা গুম, খুন, হত্যাকাণ্ডসহ বিবিধ লোমহর্ষক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার নিন্দা জানিয়েছে? একটি ঘটনা যদি এক চোখে দেখা হয়, তাহলে তা কারোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ যদি ভারতের অনুগ্রহ, অনুকম্পা প্রার্থী হয়, তাহলে তার চেয়ে বেশি দুঃখের আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে ভারত অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ চালিয়ে যাবে। ভারতের অনুসৃত এই নীতিতে অদূর ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে হয় না। সে জন্য বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি ভারতকে বিবেচনায় না রেখে চালু থাকতে পারে না। ভারত সম্পর্কে কী নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, সেটাই কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির দেশপ্রেম যাচাই করার একটি কষ্টিপাথর। যাচাইয়ের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কেউ যেন অদেশপ্রেমিক প্রমাণিত না হন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক
জুলহাস যা তৈরি করেছেন, তা মূলত একটি বড় আকারের খেলনা। জুলহাসের এই প্রতিভাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু তাকে নিয়ে আমরা অনেকেই যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি, তা রীতিমতো ভয়ংকর!
২ মিনিট আগেএকটি দেশের গণমাধ্যম তার চেতনার দর্পণ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু যখন সেই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয় অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থ, তখন গণমাধ্যম আর স্বাধীন থাকে না, হয়ে ওঠে এক অভিনব উপনিবেশ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কতটা ছিল, সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
১ দিন আগেআমার এই লেখা যেদিন দৈনিক আমার দেশ-এ ছাপা হবে তার আগের দিন অর্থাৎ ১৩ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশে এসে পৌঁছানোর কথা চার দিনের সফরে। আমাদের স্বাধীনতার মাসে ও পবিত্র রমজানে এদেশের বেশিরভাগ মানুষের ধর্মানুভূতির প্রতি সম্মান দেখাতে তিনি নাকি একদিন রোজা রাখবেন বলেও কথা রটেছে।
১ দিন আগেআওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে পরাজিত করে। সে নির্বাচনটি যে পুরোপুরি নিরপেক্ষ ছিল, তা অধিকাংশ জনগণই মনে করে না; কারণ ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনই ছিল পুরোপুরি সুষ্ঠু নির্বাচন। সে নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে, যে সত্য সর্বজনস্বীকৃত।
১ দিন আগে