ড. হাসান মাহমুদ
স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের শুরু হয় এই চরণ দিয়ে– আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। এই চরণ আপামর বাংলাদেশির মাঝে আবেগ তৈরি করে নিজেকে নিয়ে, নিজের দেশকে নিয়ে। সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেশপ্রেমজাত নানান কথায় ও কাজে স্বেচ্ছায় অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত এবং এই দেশটাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। আর আমাদের সেই গর্বটাই প্রকাশ করি ‘সোনার বাংলা’ শব্দ দুটি দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত এই জাতীয় সংগীতের মধ্যে দেশকে সোনার মতো মূল্যবান সম্পদের সঙ্গে তুলনা করার ব্যাপারটা অন্যান্য অনেক কবির লেখাতেও পাওয়া যায়। যেমন কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ও ভাই, খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি, আমার দেশের মাটি।’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন, ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা...’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে এমনকি মায়ের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। এসব রচনাই বাংলাদেশকে বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার করে আমাদের কল্পনায় নির্মাণ করে। দেশটি যেহেতু সোনার মতো মূল্যবান, একইসঙ্গে ব্যক্তি হিসেবে আমরা বাংলার মানুষও মূল্যবান। আমাদের দেশের মাটি মূল্যবান, এখানে ধান-ফুল-পাখি সবকিছু মিলিয়েই দেশ ও দেশের মানুষ, বাংলা ও বাঙালি।
বিশ শতকের শুরুতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরাজ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অঞ্চলকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া থেকে পৃথক করে বৃহত্তর আসামের (বর্তমানে ইন্ডিয়ার সেভেনসিস্টার নামে পরিচিত ভূখণ্ডের অধিকাংশ) সঙ্গে জুড়ে দিয়ে একটি নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলায় সহিংস আন্দোলন শুরু হয়, যা স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে স্বদেশী আন্দোলনের স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা রচনা করেন, যার প্রথম ১০টি চরণই আমাদের জাতীয় সংগীত। এই কবিতায় যেই ‘বাংলা’কে কবি ‘সোনার বাংলা’ বলে অভিহিত করেছেন, আমরা সাধারণত ধরে নিই যে, সেটা ভৌগোলিকভাবে ‘বাংলা’ হিসেবে পরিচিত ভূখণ্ডই। আপাতদৃষ্টিতে বাংলার এই পরিচয় সন্তোষজনক মনে হলেও বাস্তবে ‘বাংলা’ কোনো একক ভৌগোলিক স্থান নয়। ঐতিহাসিক পালাবদলের বাঁকে বাঁকে আমাদের কল্পনার এই বাংলার অবস্থান, আয়তন, চরিত্রের বদল হয়েছে। আবার বাংলায় বসবাসরত একেক জনগোষ্ঠীর কল্পনার বাংলা একেক অবয়বে নির্মিত ও কল্পিত হয়েছে।
বাস্তবে ‘সোনার বাংলা’ ধারণাটি বাঙালি সাংস্কৃতিক কল্পনায় একটি নস্টালজিক, আদর্শিক স্মৃতিময় বিষয় হিসেবে কাজ করে। সাংস্কৃতিক মিথ হিসেবে সোনার বাংলা শব্দটি বাংলার সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির ভূমি হিসেবে একটি রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায়। ১৯০৫ সালে বাংলা মায়ের অঙ্গচ্ছেদ রোধ করার জন্য স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত চরণ সাফল্যের সঙ্গে বাংলাকে বিভক্ত করা থেকে রক্ষা করতে পারলেও ১৯৪৭ সালে বাংলাকে হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিদের জন্য আলাদা দেশ ভারত (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ) এবং পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ) জুড়ে বিভক্ত করে। ১৯৭১-এ পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আবার বাংলা মায়ের কোলে ঠাঁই পায়, যা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ চরণকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনকারীদের বাংলা আর একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলা তো এক নয়। ১৯০৫ সালে যেখানে সমস্ত বদ্বীপই ছিল বাংলা, একাত্তরে সেই বাংলা শুধু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। আবার একাত্তরে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর অধিবাসী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না, একইভাবে ১৯০৫ সালেও বাঙ্গালার সমস্ত অধিবাসীই অখণ্ড বাংলার পক্ষে স্বদেশী আন্দোলন করেনি। তাহলে এটা পরিষ্কার যে, বাংলা নামক ভূখণ্ডের ধারণা একেক সময় একেক জনগোষ্ঠীর কল্পনায় একেক অবয়বে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উপস্থিত ছিল।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল জিওগ্রাফির অধ্যাপক এবং দেশের সীমানা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিস জোন্স এক গবেষণায় কল্পনার এই বাংলার পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন রূপ চিহ্নিত করেছেন। জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর পরিচয় হিসেবে বাঙালির জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ভৌগোলিক বাংলার ধারণাটির জন্ম হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যার পূর্ণ বিকাশ ঘটে স্বদেশী আন্দোলনে। বাংলার নবজাগরণ এবং জাতীয়তাবাদী সাহিত্যে (যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম) জন্ম নেওয়া ধারণা অনুযায়ী এই বাংলা একটি হিন্দু মাতৃভূমি। বাংলার এই ধারণার মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যের আহ্বান থাকলেও এটি প্রায়ই হিন্দু মূর্তিতত্ত্বের (যেমন দুর্গা, লক্ষ্মী) সঙ্গে স্বদেশকে সংযুক্ত করে। ফলে স্বভাবতই মুসলমানরা এই বাংলা থেকে বাদ পড়ে যায়।
জোন্স লক্ষ করেন যে, ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় প্যান-ইন্ডিয়ান এবং প্যান-ইসলামিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলার ঐক্যবদ্ধ ভৌগোলিক আকার এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় আবার বিভক্ত হয়ে বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান এবং তাদের নিজ নিজ দেশ যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়, যা ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।
সাধারণভাবে সাতচল্লিশে বাংলাকে বিভক্ত করার দায় মুসলমানদের ওপর দিলেও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জয়া চ্যাটার্জি তার ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গবেষণাগ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির ক্ষুদ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই সাতচল্লিশে বাংলা বিভাগের জন্য দায়ী। একইভাবে রিস জোন্সও দাবি করেন যে, যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব (১৯৪৭) ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিরোধিতার অভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি যুক্তবাংলার পক্ষে কিছু নেতার নাম উল্লেখ করে দাবি করেন যে, বাংলাকে অবিভক্ত রাখার জন্য হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিদের একটা অংশ সক্রিয় ছিল, যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক ও শরৎ বোস। এই রাজনীতিকরা ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের থেকে স্বাধীন একটি সার্বভৌম, অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তাদের মতে বাংলা একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একক।
একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে বাংলার আরেক রূপ দেখা যায়। জোন্সের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে একটি জাতিগত-ভাষাগত প্রকল্প হিসেবে রূপায়িত করা হয়েছিল, যা বিভিন্ন ধর্মের বাঙালিদের একত্রিত করেছিল। জাতীয় প্রতীক ‘সোনার বাংলা’ (এবং অন্যান্য প্রতীকসমূহ যেমন- রাষ্ট্রের নাম, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, ইত্যাদি) এই অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণাকে প্রতিফলিত করে। তবে জোন্সের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই আদর্শ ক্রমশ ইসলামি পরিচয়ের দিকে সরে যায়, যা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি দৃষ্টিভঙ্গিকে জটিল করে তোলে। তার এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমি দ্বিমত করি। আর আমার দ্বিমতের পক্ষে একটি প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চাই বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং ইউনেস্কোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে যে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, আনন্দ শোভাযাত্রা নামের এই আয়োজনটা সর্বপ্রথম ১৯৮৫ সালে হয় যশোরে। যশোরের চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামিল শামীম এই শোভাযাত্রাকে ঢাকার চারুকলায় নিয়ে আসেন ১৯৮৯ সালে। পরের বছর ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক আর শিল্পী এমদাদ হোসেন মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম প্রস্তাব করেন। সংক্ষেপে এ-ই হলো মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্মকথা।
নিজেরা বাঙালি আর দেশকে বাংলা হিসেবে বিশ্বাস করা সেক্যুলার, প্রগতিশীল, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাংলাদেশিরা পহেলা বৈশাখের এই শোভাযাত্রাকে রীতিমতো একটি ধর্মীয় আচারের মতো করে পালন করে এবং অন্যান্য বাংলাদেশির জন্য এই উদযাপনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাকে দেশপ্রেমের দাবি মনে করে। কিন্তু আনন্দ শোভাযাত্রা থেকে ক্রমেই রূপান্তরিত হতে হতে গত তিন দশকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় পরিণত হওয়ার মধ্যে পহেলা বৈশাখের আয়োজন রিস জোন্সের দাবির বিপরীতে বরং ক্রমেই হিন্দুয়ানির পরিচয়ের দিকে সরে যাওয়া সুস্পষ্টভাবেই লক্ষণীয়।
মঙ্গল প্রদীপ হলো হিন্দুদের পূজার একটি বাহন। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে তারা পূজা করে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় বাংলা ট্রিবিউন (৯ জুন ২০২০)-এর একটি প্রতিবেদন- “(শিরোনাম) করোনা থেকে বাঁচতে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা! করোনা থেকে রক্ষা পেতে নওগাঁয় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করেন হিন্দু নারীরা। তাদের বিশ্বাস, এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করলে (তা) এ মহামারির হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করবে।” একইভাবে, এই আয়োজনের আলপনাও হিন্দু ধর্মেরই একটি অনুষঙ্গ। বাংলাপিডিয়া লিখেছে, “আলপনা একধরনের লোকশিল্প এবং বলা যায় মানুষের সহজাত অভিব্যক্তি।... বাংলায় হিন্দু মহিলারা বেশ কয়েকটি ব্রত পালন করে। এ ব্রত পালনে কাদামাটির প্রতিকৃতি ও আলপনা একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে চলে আসে। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শেখা নকশায় তারা অলংকৃত করে তোলে তাদের গৃহ, রাঙায় ঘরের দেয়াল।” মঙ্গল শোভাযাত্রায় পশুপাখির প্রতিকৃতিগুলোও হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন। যেমন- পেঁচা ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, ময়ূর দেবতাদের সেনাপতি কার্ত্তিকের বাহন, হাঁস জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন, ইঁদুর গণেশ দেবতার বাহন, আর সিংহ দেবী দুর্গার বাহন।
সংস্কৃতি সতত পরিবর্তনশীল। কাজেই পহেলা বৈশাখের উদযাপনও এই নিয়মের অধীন, ক্রমাগত পরিবর্তিন হবে এই আয়োজনে। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রায় বর্তমান রূপ আপত্তিকর। কারণ, একে জাতীয় উৎসব হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধানতম সাংস্কৃতিক পরিচয় ইসলামকে ক্রমাগত ‘অপর’ করার মাধ্যমে। বাঙালি মুসলমানকে একসঙ্গে মুছে দিয়ে (erase) এবং দানবায়ন (demonization) করার মাধ্যমে। আর এই দাবির পক্ষে অন্যতম প্রমাণ হলো মঙ্গল শোভাযাত্রায় ইসলামিস্ট রাজনৈতিক নেতা খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসী বা অশুভ শক্তি হিসেবে দেখানো, কিংবা চাঁদতারা খচিত সবুজ পোশাকের (ইসলামের প্রতীক) গায়ে চাপাতি যুক্ত করে সন্ত্রাসী ব্যক্তি-অবয়বকে গেরুয়া (উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রতীক) হাতের থাবার মধ্যে রাখা।
এগুলো সংস্কৃতির স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার কোনো ব্যাপার নয়। এগুলো হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির রাজনীতি। এই রাজনীতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে (এবং একইসঙ্গে অন্যান্য সংখ্যালঘু নানান জাতিগোষ্ঠীকেও) অপরায়নের রাজনীতি।
বাংলাদেশের কালচারাল এলিট – সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বাঙালি হিসেবে দাবি করা শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তÑ এই রাজনীতিটা দেখেন ঠিকই, কিন্তু এটাকেই তারা স্বাভাবিক এবং অনিবার্য মনে করেন। তাদের কাছে জাতীয় সংস্কৃতি ক্রমেই হিন্দুত্ববাদী পরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়াটাই স্বাভাবিক।
কারণ, তারা এ বিষয়টিকে মূলধারার বাঙালি জাতীয়তাবাদের ডিস্কোর্সের মধ্যে দেখেন, যেখানে বাঙালি মানেই হিন্দু আর মুসলমান নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে কনভার্টেড তথা হিন্দুই। অতএব, হিন্দুত্ববাদের চিহ্নাদিকে মূল পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তৈরি করার ব্যাপারটা স্বাভাবিকই। মুসলমান যেহেতু হিন্দু থেকেই কনভার্টেড, অতএব তাদের আলাদা করে অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই।
ছায়ানটের সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক আর যারা নিজেদের মুসলমান পরিচয়কে উতরিয়ে সাংস্কৃতিক বাঙালিত্বকে ধারণ করে, তারাও একইভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে ক্রমাগত হিন্দুয়ানির নানান চিহ্ন, আচার, ইত্যাদির অন্তর্ভুক্তিকে মূলে ফিরে যাওয়া তথা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা হিসেবেই দেখে।
কিন্তু দেশের সবাই তো তাদের মতো করে নিজেদের মুসলমান পরিচয় ত্যাগ করে বাঙালি পরিচয় নিতে আগ্রহী নয়। সবাই তো বিশ্বাস করে না যে তাদের পূর্বপুরুষরা নিম্নবর্ণের হিন্দু থাইক্যা কনভার্টেড। ফলে তাদের কাছে মঙ্গল শোভাযাত্রার এই ক্রমাগত হিন্দু চরিত্র ধারণ করাটা স্বাভাবিক মনে হয় না। অতএব, তারা এটাকে জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মনে করে।
হিন্দুত্ববাদের সমর্থন নিয়ে দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে গেছে। রাজনৈতিক মুক্তির পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সংস্কারের যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, এই প্রেক্ষিতে বাংলা নববর্ষের উদযাপনকেও ঢেলে সাজাতে হবে এমনভাবে, যেন এই উৎসবের আয়োজনগুলোর মধ্যে বাঙালি মুসলমানসহ আর সব অহিন্দু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেন ধর্ম বর্ণ এথনিসিটি নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি এই উদযাপনের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার)
স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের শুরু হয় এই চরণ দিয়ে– আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। এই চরণ আপামর বাংলাদেশির মাঝে আবেগ তৈরি করে নিজেকে নিয়ে, নিজের দেশকে নিয়ে। সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেশপ্রেমজাত নানান কথায় ও কাজে স্বেচ্ছায় অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত এবং এই দেশটাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। আর আমাদের সেই গর্বটাই প্রকাশ করি ‘সোনার বাংলা’ শব্দ দুটি দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত এই জাতীয় সংগীতের মধ্যে দেশকে সোনার মতো মূল্যবান সম্পদের সঙ্গে তুলনা করার ব্যাপারটা অন্যান্য অনেক কবির লেখাতেও পাওয়া যায়। যেমন কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ও ভাই, খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি, আমার দেশের মাটি।’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন, ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা...’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে এমনকি মায়ের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। এসব রচনাই বাংলাদেশকে বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার করে আমাদের কল্পনায় নির্মাণ করে। দেশটি যেহেতু সোনার মতো মূল্যবান, একইসঙ্গে ব্যক্তি হিসেবে আমরা বাংলার মানুষও মূল্যবান। আমাদের দেশের মাটি মূল্যবান, এখানে ধান-ফুল-পাখি সবকিছু মিলিয়েই দেশ ও দেশের মানুষ, বাংলা ও বাঙালি।
বিশ শতকের শুরুতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরাজ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অঞ্চলকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া থেকে পৃথক করে বৃহত্তর আসামের (বর্তমানে ইন্ডিয়ার সেভেনসিস্টার নামে পরিচিত ভূখণ্ডের অধিকাংশ) সঙ্গে জুড়ে দিয়ে একটি নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলায় সহিংস আন্দোলন শুরু হয়, যা স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে স্বদেশী আন্দোলনের স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা রচনা করেন, যার প্রথম ১০টি চরণই আমাদের জাতীয় সংগীত। এই কবিতায় যেই ‘বাংলা’কে কবি ‘সোনার বাংলা’ বলে অভিহিত করেছেন, আমরা সাধারণত ধরে নিই যে, সেটা ভৌগোলিকভাবে ‘বাংলা’ হিসেবে পরিচিত ভূখণ্ডই। আপাতদৃষ্টিতে বাংলার এই পরিচয় সন্তোষজনক মনে হলেও বাস্তবে ‘বাংলা’ কোনো একক ভৌগোলিক স্থান নয়। ঐতিহাসিক পালাবদলের বাঁকে বাঁকে আমাদের কল্পনার এই বাংলার অবস্থান, আয়তন, চরিত্রের বদল হয়েছে। আবার বাংলায় বসবাসরত একেক জনগোষ্ঠীর কল্পনার বাংলা একেক অবয়বে নির্মিত ও কল্পিত হয়েছে।
বাস্তবে ‘সোনার বাংলা’ ধারণাটি বাঙালি সাংস্কৃতিক কল্পনায় একটি নস্টালজিক, আদর্শিক স্মৃতিময় বিষয় হিসেবে কাজ করে। সাংস্কৃতিক মিথ হিসেবে সোনার বাংলা শব্দটি বাংলার সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির ভূমি হিসেবে একটি রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায়। ১৯০৫ সালে বাংলা মায়ের অঙ্গচ্ছেদ রোধ করার জন্য স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত চরণ সাফল্যের সঙ্গে বাংলাকে বিভক্ত করা থেকে রক্ষা করতে পারলেও ১৯৪৭ সালে বাংলাকে হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিদের জন্য আলাদা দেশ ভারত (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ) এবং পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ) জুড়ে বিভক্ত করে। ১৯৭১-এ পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আবার বাংলা মায়ের কোলে ঠাঁই পায়, যা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ চরণকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনকারীদের বাংলা আর একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলা তো এক নয়। ১৯০৫ সালে যেখানে সমস্ত বদ্বীপই ছিল বাংলা, একাত্তরে সেই বাংলা শুধু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। আবার একাত্তরে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর অধিবাসী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না, একইভাবে ১৯০৫ সালেও বাঙ্গালার সমস্ত অধিবাসীই অখণ্ড বাংলার পক্ষে স্বদেশী আন্দোলন করেনি। তাহলে এটা পরিষ্কার যে, বাংলা নামক ভূখণ্ডের ধারণা একেক সময় একেক জনগোষ্ঠীর কল্পনায় একেক অবয়বে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উপস্থিত ছিল।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল জিওগ্রাফির অধ্যাপক এবং দেশের সীমানা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিস জোন্স এক গবেষণায় কল্পনার এই বাংলার পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন রূপ চিহ্নিত করেছেন। জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর পরিচয় হিসেবে বাঙালির জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ভৌগোলিক বাংলার ধারণাটির জন্ম হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যার পূর্ণ বিকাশ ঘটে স্বদেশী আন্দোলনে। বাংলার নবজাগরণ এবং জাতীয়তাবাদী সাহিত্যে (যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম) জন্ম নেওয়া ধারণা অনুযায়ী এই বাংলা একটি হিন্দু মাতৃভূমি। বাংলার এই ধারণার মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যের আহ্বান থাকলেও এটি প্রায়ই হিন্দু মূর্তিতত্ত্বের (যেমন দুর্গা, লক্ষ্মী) সঙ্গে স্বদেশকে সংযুক্ত করে। ফলে স্বভাবতই মুসলমানরা এই বাংলা থেকে বাদ পড়ে যায়।
জোন্স লক্ষ করেন যে, ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় প্যান-ইন্ডিয়ান এবং প্যান-ইসলামিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলার ঐক্যবদ্ধ ভৌগোলিক আকার এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় আবার বিভক্ত হয়ে বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান এবং তাদের নিজ নিজ দেশ যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়, যা ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।
সাধারণভাবে সাতচল্লিশে বাংলাকে বিভক্ত করার দায় মুসলমানদের ওপর দিলেও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জয়া চ্যাটার্জি তার ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ গবেষণাগ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির ক্ষুদ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই সাতচল্লিশে বাংলা বিভাগের জন্য দায়ী। একইভাবে রিস জোন্সও দাবি করেন যে, যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব (১৯৪৭) ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিরোধিতার অভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি যুক্তবাংলার পক্ষে কিছু নেতার নাম উল্লেখ করে দাবি করেন যে, বাংলাকে অবিভক্ত রাখার জন্য হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিদের একটা অংশ সক্রিয় ছিল, যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক ও শরৎ বোস। এই রাজনীতিকরা ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের থেকে স্বাধীন একটি সার্বভৌম, অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তাদের মতে বাংলা একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একক।
একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে বাংলার আরেক রূপ দেখা যায়। জোন্সের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে একটি জাতিগত-ভাষাগত প্রকল্প হিসেবে রূপায়িত করা হয়েছিল, যা বিভিন্ন ধর্মের বাঙালিদের একত্রিত করেছিল। জাতীয় প্রতীক ‘সোনার বাংলা’ (এবং অন্যান্য প্রতীকসমূহ যেমন- রাষ্ট্রের নাম, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, ইত্যাদি) এই অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণাকে প্রতিফলিত করে। তবে জোন্সের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই আদর্শ ক্রমশ ইসলামি পরিচয়ের দিকে সরে যায়, যা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি দৃষ্টিভঙ্গিকে জটিল করে তোলে। তার এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমি দ্বিমত করি। আর আমার দ্বিমতের পক্ষে একটি প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চাই বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং ইউনেস্কোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে যে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, আনন্দ শোভাযাত্রা নামের এই আয়োজনটা সর্বপ্রথম ১৯৮৫ সালে হয় যশোরে। যশোরের চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামিল শামীম এই শোভাযাত্রাকে ঢাকার চারুকলায় নিয়ে আসেন ১৯৮৯ সালে। পরের বছর ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক আর শিল্পী এমদাদ হোসেন মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম প্রস্তাব করেন। সংক্ষেপে এ-ই হলো মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্মকথা।
নিজেরা বাঙালি আর দেশকে বাংলা হিসেবে বিশ্বাস করা সেক্যুলার, প্রগতিশীল, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাংলাদেশিরা পহেলা বৈশাখের এই শোভাযাত্রাকে রীতিমতো একটি ধর্মীয় আচারের মতো করে পালন করে এবং অন্যান্য বাংলাদেশির জন্য এই উদযাপনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাকে দেশপ্রেমের দাবি মনে করে। কিন্তু আনন্দ শোভাযাত্রা থেকে ক্রমেই রূপান্তরিত হতে হতে গত তিন দশকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় পরিণত হওয়ার মধ্যে পহেলা বৈশাখের আয়োজন রিস জোন্সের দাবির বিপরীতে বরং ক্রমেই হিন্দুয়ানির পরিচয়ের দিকে সরে যাওয়া সুস্পষ্টভাবেই লক্ষণীয়।
মঙ্গল প্রদীপ হলো হিন্দুদের পূজার একটি বাহন। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে তারা পূজা করে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় বাংলা ট্রিবিউন (৯ জুন ২০২০)-এর একটি প্রতিবেদন- “(শিরোনাম) করোনা থেকে বাঁচতে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা! করোনা থেকে রক্ষা পেতে নওগাঁয় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করেন হিন্দু নারীরা। তাদের বিশ্বাস, এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করলে (তা) এ মহামারির হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করবে।” একইভাবে, এই আয়োজনের আলপনাও হিন্দু ধর্মেরই একটি অনুষঙ্গ। বাংলাপিডিয়া লিখেছে, “আলপনা একধরনের লোকশিল্প এবং বলা যায় মানুষের সহজাত অভিব্যক্তি।... বাংলায় হিন্দু মহিলারা বেশ কয়েকটি ব্রত পালন করে। এ ব্রত পালনে কাদামাটির প্রতিকৃতি ও আলপনা একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে চলে আসে। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শেখা নকশায় তারা অলংকৃত করে তোলে তাদের গৃহ, রাঙায় ঘরের দেয়াল।” মঙ্গল শোভাযাত্রায় পশুপাখির প্রতিকৃতিগুলোও হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন। যেমন- পেঁচা ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, ময়ূর দেবতাদের সেনাপতি কার্ত্তিকের বাহন, হাঁস জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন, ইঁদুর গণেশ দেবতার বাহন, আর সিংহ দেবী দুর্গার বাহন।
সংস্কৃতি সতত পরিবর্তনশীল। কাজেই পহেলা বৈশাখের উদযাপনও এই নিয়মের অধীন, ক্রমাগত পরিবর্তিন হবে এই আয়োজনে। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রায় বর্তমান রূপ আপত্তিকর। কারণ, একে জাতীয় উৎসব হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধানতম সাংস্কৃতিক পরিচয় ইসলামকে ক্রমাগত ‘অপর’ করার মাধ্যমে। বাঙালি মুসলমানকে একসঙ্গে মুছে দিয়ে (erase) এবং দানবায়ন (demonization) করার মাধ্যমে। আর এই দাবির পক্ষে অন্যতম প্রমাণ হলো মঙ্গল শোভাযাত্রায় ইসলামিস্ট রাজনৈতিক নেতা খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসী বা অশুভ শক্তি হিসেবে দেখানো, কিংবা চাঁদতারা খচিত সবুজ পোশাকের (ইসলামের প্রতীক) গায়ে চাপাতি যুক্ত করে সন্ত্রাসী ব্যক্তি-অবয়বকে গেরুয়া (উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রতীক) হাতের থাবার মধ্যে রাখা।
এগুলো সংস্কৃতির স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার কোনো ব্যাপার নয়। এগুলো হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির রাজনীতি। এই রাজনীতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে (এবং একইসঙ্গে অন্যান্য সংখ্যালঘু নানান জাতিগোষ্ঠীকেও) অপরায়নের রাজনীতি।
বাংলাদেশের কালচারাল এলিট – সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বাঙালি হিসেবে দাবি করা শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তÑ এই রাজনীতিটা দেখেন ঠিকই, কিন্তু এটাকেই তারা স্বাভাবিক এবং অনিবার্য মনে করেন। তাদের কাছে জাতীয় সংস্কৃতি ক্রমেই হিন্দুত্ববাদী পরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়াটাই স্বাভাবিক।
কারণ, তারা এ বিষয়টিকে মূলধারার বাঙালি জাতীয়তাবাদের ডিস্কোর্সের মধ্যে দেখেন, যেখানে বাঙালি মানেই হিন্দু আর মুসলমান নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে কনভার্টেড তথা হিন্দুই। অতএব, হিন্দুত্ববাদের চিহ্নাদিকে মূল পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তৈরি করার ব্যাপারটা স্বাভাবিকই। মুসলমান যেহেতু হিন্দু থেকেই কনভার্টেড, অতএব তাদের আলাদা করে অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই।
ছায়ানটের সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক আর যারা নিজেদের মুসলমান পরিচয়কে উতরিয়ে সাংস্কৃতিক বাঙালিত্বকে ধারণ করে, তারাও একইভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে ক্রমাগত হিন্দুয়ানির নানান চিহ্ন, আচার, ইত্যাদির অন্তর্ভুক্তিকে মূলে ফিরে যাওয়া তথা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা হিসেবেই দেখে।
কিন্তু দেশের সবাই তো তাদের মতো করে নিজেদের মুসলমান পরিচয় ত্যাগ করে বাঙালি পরিচয় নিতে আগ্রহী নয়। সবাই তো বিশ্বাস করে না যে তাদের পূর্বপুরুষরা নিম্নবর্ণের হিন্দু থাইক্যা কনভার্টেড। ফলে তাদের কাছে মঙ্গল শোভাযাত্রার এই ক্রমাগত হিন্দু চরিত্র ধারণ করাটা স্বাভাবিক মনে হয় না। অতএব, তারা এটাকে জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মনে করে।
হিন্দুত্ববাদের সমর্থন নিয়ে দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে গেছে। রাজনৈতিক মুক্তির পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সংস্কারের যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, এই প্রেক্ষিতে বাংলা নববর্ষের উদযাপনকেও ঢেলে সাজাতে হবে এমনভাবে, যেন এই উৎসবের আয়োজনগুলোর মধ্যে বাঙালি মুসলমানসহ আর সব অহিন্দু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেন ধর্ম বর্ণ এথনিসিটি নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি এই উদযাপনের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার)
দেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। আওয়ামী লীগমুক্ত মাঠ রাজনীতির প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নতুন করে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলের আভাস মিলছে। মধ্যম ও পেছনের সারির রাজনৈতিক দলগুলো নতুন করে অবহেলা-অনাদরের শঙ্কা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অবশেষে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে – এমন একটা স্বস্তির আবহ যখন বাংলাদেশে বিরাজ করছে, তখন রোহিঙ্গারা এ নিয়ে কী ভাবছে? তারা কি আশ্বস্ত হয়েছে যে তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে? বিশেষ করে যারা মিয়ানমার সরকারের যোগ্যতার সূচকে দেশে ফেরার জন্য ‘যোগ্য’ বলে বিবেচিত হয়েছে
১১ ঘণ্টা আগেএকাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বছরে আমরা একটি জনগোষ্ঠীকে জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে দিইনি। বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করেছে।
১৩ ঘণ্টা আগেএযাবৎ দেশে যত এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের ৯৫ ভাগ নিজেদের স্ত্রী-সন্তানকে পরবর্তী এমপি বানাতে চেয়েছেন, অনেকেই এই প্রচেষ্টায় কামিয়াব হয়েছেন। দেশের ৯৮ ভাগ মন্ত্রী নিজেদের পোষ্যকে মন্ত্রী করার খায়েশ প্রকাশ করে গেছেন।
১ দিন আগে