Ad T1

ট্রাম্পের ‘নতুন গাজা’ হবে ফিলিস্তিনিমুক্ত বিনোদন কেন্দ্র

মোতালেব জামালী
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ৫৭
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি থেকে গাজায় অস্ত্রবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প গাজা উপত্যকাকে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে নেওয়ার বিষয়ে তার ‘রিভেরা অব দ্য মিডল ইস্ট’ বা ‘মধ্যপ্রাচ্যের তটভূমি’ পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। তার এই পরিকল্পনার মূল কথা হচ্ছে, গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনিকে প্রতিবেশী দেশগুলোয় অর্থাৎ মিসর, জর্ডানসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোয় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার পাঁচ কোটি টনেরও বেশি ধ্বংসস্তূপ, অবিস্ফোরিত বোমা ও অন্যান্য মারণাস্ত্র পরিষ্কার করে গাজাকে নতুন করে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী চমৎকার এই ভূখণ্ডটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র। নতুন এই গাজায় আমেরিকান ধনকুবেররাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনকুবেররা এসে এখানে আরাম-আয়েস করবেন, সময় কাটাবেন। কিন্তু কোনো ফিলিস্তিনি এখানে থাকতে পারবেন না। গাজা হবে সম্পূর্ণ ফিলিস্তিনিমুক্ত। এটি হবে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে থাকা বিনোদন ও পর্যটনের অসাধারণ একটি স্পট, যেখানে ক্যাসিনো, বার, নাইট ক্লাবসহ বিনোদনের সব ব্যবস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের শেখরাসহ বিশ্বের ধনকুবের ও সেরা সুন্দরীরা সাগর তীরবর্তী এই বিনোদন কেন্দ্রে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এখান থেকে আয় করা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢুকবে ট্রাম্প ও তার সহযোগী পুঁজিপতিদের পকেটে। একই সঙ্গে এটা হয়ে উঠবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে হাতের মুঠোয় নেওয়ার আমেরিকান-ইউরোপীয় চক্রান্তকারীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এটাই হচ্ছে ট্রাম্পের ‘রিভেরা অব দ্য মিডল ইস্ট’ প্রস্তাবের মূল কথা।
গাজা উপত্যকাকে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা আরব বিশ্ব ও ইউরোপের অনেক দেশ প্রত্যাখ্যান করলে কিছুটা দমে যান ট্রাম্প। তার এই প্রস্তাবের বিকল্প হিসেবে আরব দেশগুলো একটি প্রস্তাব চূড়ান্ত করলেও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু গাজা উপত্যকাকে ফিলিস্তিনিমুক্ত করার নতুন পরিকল্পনা হাতে নেন। এরপর অস্ত্রবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে পবিত্র রমজান মাসে (১৮ মার্চ) সাহরির সময় থেকে নতুন করে নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরাইল।
এরই মধ্যে উপত্যকাটির ৫০ শতাংশেরও বেশি এলাকা দখলে নিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। গত ৭ এপ্রিল এ খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। ইসরাইলি সেনাবাহিনী এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গাজা সীমান্তের আশপাশের ফিলিস্তিনিদের সব বাড়িঘর, কৃষিজমি এবং অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে অঞ্চলটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ইসরাইলি বাহিনী গাজায় তাদের সামরিক বাফার জোনের আকার দ্বিগুণ করেছে।
নেতজারিম করিডোর নামে পরিচিত জমিও দখল করেছে ইসরাইলি সেনারা। এই করিডোর গাজা শহরসহ উত্তরাঞ্চলকে উপত্যকার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এ এলাকায় ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির আবাসস্থল রয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরাইল আরেকটি করিডোর তৈরি করতে চায়, যা দক্ষিণ গাজার মধ্য দিয়ে রাফাহ শহরকে বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবেই গাজা উপত্যকাকে নিজেদের দখলে নিচ্ছে ইসরাইল। তারা বিভিন্ন এলাকার ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু লাখ লাখ ফিলিস্তিনি কোথায় যাবে, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
আর এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত সোমবার হোয়াইট হাউসে বৈঠককালে গাজা উপত্যকায় জোর-পূর্বক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করতে রাজি হতে পারেÑ এমন কিছু দেশ নিয়ে আলোচনা করেছেন ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু।
ট্রাম্প আবার গাজার দখল নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, গাজা উপত্যকা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ও মালিকানায় থাকলে তা ‘ভালো জিনিস’। গত সোমবার হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহু তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই বিতর্কিত মন্তব্য করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তি যদি গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা নেয়, তাহলে তা একটি ভালো বিষয় হবে।’
ট্রম্প বলেন, ‘আপনি যদি ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে পাঠিয়ে দেন এবং এমন অনেক দেশ আছে, যারা তা করতে রাজি, তাহলে আপনি সেখানে একটা মুক্ত অঞ্চল গড়ে তুলতে পারেন। আপনি এটিকে বলতে পারেন ফ্রিডম জোন, এমন একটি জায়গা, যেখানে প্রতিদিন মানুষ হত্যা করা হবে না।’ ট্রাম্প বলেন, তিনি এখনো বুঝতে পারেন না ‘ইসরাইল কেন গাজা ছেড়ে দিয়েছিল। ওটা অদ্ভুত একটা জায়গা। আমি একে বলি দারুণ একটা লোকেশন, কিন্তু যেখানে কেউই থাকতে চায় না।’
ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওমর বাদ্দার সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেছেন, এর আগে ধারণা করা হচ্ছিল যে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পরিত্যাগ করেছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তারা তাদের ওই পরিকল্পনা থেকে একটুও সরে আসেননি। তিনি এই দুই নেতার বৈঠককে ‘অত্যন্ত ঘৃণ্য’ অভিহিত করে বলেন, ‘তাদের এই বৈঠক প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইসরাইল এমন একটি রাষ্ট্র, যা সব আইনের ঊর্ধ্বে।’
ওমর বাদ্দারের মতে, গাজাকে ধ্বংস করে এটাকে বসবাসের অনুপযোগী করে তোলার জন্য ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুই দায়ী। তারা বলছেন, গাজা একটি বিপজ্জনক জায়গা, কিন্তু এটাকে তো তারাই বিপজ্জনক করে তুলেছেন। তারা বিরামহীনভাবে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে গাজাকে বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলেছেন। আপনি যদি কোনো এলাকার অবকাঠামো ধ্বংস করে এর জনগণকে বলেন, ‘এখানে থাকলে মরবেন, বাঁচতে হলে চলে যান’। এটা তো কোনোভাবেই স্বেচ্ছা পুনর্বাসন হতে পারে না। এটা সুস্পষ্ট সহিংস জাতিগত নির্মূল এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি। আমরা এখন সেটাই দেখছি।’
গাজা উপত্যকা দখলের ট্রাম্পের পরিকল্পনা নতুন কোনো বিষয় নয়। এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান মিশনারিরা গাজা উপত্যকাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনে তাদের উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করেছিল কয়েক দফায়। তাদের সেই চেষ্টা ছিল মূলত মিশনারি বা ধর্মীয় কার্যক্রমের আড়ালে আমেরিকান পুঁজিবাদী আদর্শ সম্প্রসারণে বিশ্বাসীদের মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশ স্থাপনের তৎপরতারই একটি অংশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূখণ্ডে আমেরিকান পুঁজিবাদী খ্রিষ্টান মিশনারিদের সেই চেষ্টা প্রতিহত করেছে।
শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতে বিশ্বাসী অংশটিকে বরাবরই পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারক-বাহক ও প্রচারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি বরাবরই পুঁজিবাদী দর্শনের একজন ভক্ত ও অনুসারী। তাদেরই প্রতিনিধি হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প একুশ শতকে এসে আবার গাজা উপত্যকা আমেরিকার দখলে নেওয়ার প্রস্তাবটি সামনে এনেছেন। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের মধ্যে যারা প্রেসবিটারিয়ান অর্থাৎ যারা প্রোটেস্ট্যান্ট ঐতিহ্যের সংস্কার করা আদর্শে বিশ্বাসী, আগে তাদেরই দলে ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু বর্তমানে কোনো বিশেষ গ্রুপে না থাকা একজন খ্রিষ্টান হিসেবে নিজেকে দাবি করেন তিনি। চার্চেও খুব একটা যান না।
কিন্তু বর্তমানে ইভানজেলিক্যাল প্রোটেস্ট্যান্ট আদর্শে বিশ্বাসীরা তার চারপাশে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইভানজেলিক্যাল প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানরা মনে করেন, ট্রাম্প তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পক্ষে লড়াই করছেন। দ্বিতীয় দফায় হোয়াইট হাউসে আসার পর ট্রাম্প আমেরিকান পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণের পক্ষে যে বৃহত্তর মিশনারি তৎপরতা শুরু করেছেন, তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি ইতোমধ্যে যেসব নির্বাহী আদেশ, ঘোষণাপত্র ও নীতিমালা জারি করেছেন, তার সবই আমেরিকান পুঁজিবাদী মিশনারি আদর্শ বিস্তারের বীজ লুকিয়ে আছে।
গাজা, গ্রিনল্যান্ড, পানামা খাল দখলের হুমকি, কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হওয়ার প্রস্তাব ও সর্বশেষ বিশ্বের সব দেশের ওপর বর্ধিত শুল্ক আরোপ করার ঘোণাকে অনেকেই পাগলামি বা ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের পরিচয় হিসেবে মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে এতে খ্রিষ্টান মিশনারি পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের লক্ষ্যই কাজ করেছে। অর্থ সামরিক শক্তির জোরে ট্রাম্প ও তার চারপাশে থাকা সহযোগীরা তাদের এই লক্ষ্য হাসিল করতে চান।
ট্রাম্পের গাজা পুনর্গঠনের পরিকল্পনার মূল কথা হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের এই ভূখণ্ডে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এসে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে, কিন্তু কোনো ফিলিস্তিনি সেখানে থাকতে পারবে না। গাজা থাকবে একেবারেই ফিলিস্তিনিমুক্ত। এটাই হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘নতুন গাজা’র প্রধান বৈশিষ্ট্য।
Ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত