কদিন আগে রংপুরের পীরগাছা ঘুরে এলাম। মনে হলো নির্বাচনি প্রচারণা পুরোদমে শুরু হয়েছে। দেখলাম গাছে ও দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নির্বাচনি পোস্টার; কোথাও কোথাও গাছের ডালে ঝুলছে। বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন প্রার্থী ও তার সমর্থকরা। এখন সারা দেশের গ্রামে গ্রামে একই দৃশ্য বিরাজ করছে। উঠোন বৈঠক চলছে সমানে। ঢাকাও তার ব্যতিক্রম নয় বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকায় জামায়াতে ইসলামের নারী সংগঠনের নেত্রীরা প্রতিটি দুয়ারে টোকা দিয়ে চলেছেন। এই তো দুদিন আগে দুজন নারী আমাদের বাসায় এসেছিলেন জামায়াতের নির্বাচনি বার্তা নিয়ে। তারা ভোটার তালিকা দেখে দেখে ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। সম্ভবত এদিক দিয়ে জামায়াতের নারী নেত্রী ও কর্মীরা অন্য দলগুলোর থেকে অনেক এগিয়ে আছে।
তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনি হাওয়ায় পাল তোলার কাজটা সবার আগে করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দলটির শীর্ষ নেতারা নির্বাচনের আগাম বার্তা জনগণকে দিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার আগেই কোনো দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার ঘটনা বুঝি এই প্রথম ঘটল। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়, নির্বাচন বানচাল করার নানা মহলের নানা অপতৎপরতাকে বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির এই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা কার্যকর একটা কৌশল। এটা বিএনপি নেতাদের দূরদর্শিতার পরিচয়ও বহন করছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিএনপির অনেক নেতা ঠিক সময়ে নির্বাচন হওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন।
অন্যদিকে এটাও বলা যায়, আগেভাগে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সব ষড়যন্ত্রকে বিএনপি রুখে দিয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং অন্য দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করেছে। তাই নির্বাচন হবে কি হবে না, তা নিয়ে এখন আর সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশের অবকাশ নেই। যদিও বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন না হওয়ারও ইতিহাস রয়েছে। সেটা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারো হিসেবে পরিচিত। সে সময় সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ জোরপূর্বক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছিলেন। এটা ছিল একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে দীর্ঘস্থায়ী ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়েছিল।
এদিকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, বিএনপি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে শরিকদের জন্য ৬৩টি আসন রিজার্ভ রেখেছে। এর মধ্য দিয়ে দলটি একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াসকে গুরুত্ব দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ধরনের প্রচেষ্টার পরিধি ভবিষ্যতে আরো বাড়লে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে এটা নির্ভর করবে বিএনপিসহ অন্য সব দলের নেতাদের মন-মানসিকতার ওপর।

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের নিবর্তনমূলক শাসনামলে যেভাবে বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হয়েছেন, যেভাবে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন লাখ লাখ নেতাকর্মী, যেভাবে মামলায় মামলায় পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছিলেন তারা, যেভাবে স্থগিত হয়ে পড়েছিল দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড—সেই পটভূমিতে এরকম গোছানো একটি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা রীতিমতো চমক সৃষ্টি করেছিল। তবে জানা গেছে, একাধিক বিশ্বাসযোগ্য জরিপের ভিত্তিতে এই প্রার্থী তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।
অনেকে মনে করেন, এই তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে নেপথ্যে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রার্থী তালিকা দেখে সেটা অনুমান করা যায়। কারণ তালিকায় স্থান পাওয়া অধিকাংশই প্রার্থীই হচ্ছেন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সাথি। নিপীড়নমূলক শাসন আমলে দীর্ঘ ১৭ বছরে তিনি অন্যায়ভাবে জেল খেটেছেন, গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি। তবুও তার মনোবল কখনো ভাঙেনি। এখনো কঠিন সংকটকালে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে তিনি পিছপা হন না। সেটা প্রতিফলিত হয়েছে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. প্রফেসর মো. ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকে। এখনো বেগম খালেদা জিয়া পেছনে থেকে হাল ধরে আছেন, তা-ই স্পষ্ট বোঝা যায় এই প্রার্থী তালিকা দেখে।
এসব সত্ত্বেও অনেক আসনের প্রার্থিতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বঞ্চিতরা মিটিং-মিছিল করে চলেছেন। এর প্রেক্ষাপটে এরই মধ্যে অনেক স্থানে প্রার্থী বদল করা হয়েছে। এছাড়া পরীক্ষিত বেশ কিছু পুরোনো নেতা মনোনয়ন না পাওয়ায় দলের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো সামাল দিতেও শীর্ষ নেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। অন্যদিকে ৬৩টা আসন শরিক দলগুলোর জন্য রিজার্ভ রাখা হলেও এগুলো বণ্টনের ক্ষেত্রে জটিলতার বিষয়টি রয়েই গেছে। যেহেতু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে মাঠে নেই, সেহেতু সবাই মনে করছেন, ধানের শীষের প্রতীক পেলেই নির্বাচনে জিতে যাবেন। ফলে শরিক দলগুলো যেমন আসন নিয়ে দর-কষাকষি করবে, তেমনি বিএনপির নেতারাও নমিনেশন পাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাবেন। এর ফলে অনেক আসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। আর সেটা হলে বিএনপিকে আরো বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
বিএনপি নেতারা যদি এসব ক্ষোভ নিরসন করতে ব্যর্থ হন এবং বিভিন্ন স্থানে যদি বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যান, তাহলে আরেকটি সংকট শীর্ষ নেতাদের ভাবিয়ে তুলতে পারে। যদিও বিএনপি নেতারা ঘটনাগুলো আমলে নিয়ে শোধরানোর চেষ্টা করছেন।
এছাড়া আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়েও অনেকের মধ্যে আশঙ্কা রয়ে গেছে। তারা এই আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে জুলাই বিপ্লবে পরাজিতরা খুব পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা ছড়াতে পারেন। গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি প্রচারণা মিছিলে রক্তাক্ত হামলা তারই ইঙ্গিত বহন করছে। ওই দিন চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এবং মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদুল্লার ওপর অতর্কিত গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে তিনি আহত হন। তার পায়ে গুলি লেগেছিল। এছাড়া বাবুল নামে একজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। এই ঘটনা নির্বাচনের সহিংসতার ইঙ্গিত বহন করছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১৭ নভেম্বর পতিত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করায় দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেশী একটি দেশের প্ররোচনায় নির্বাচনকালে অবাঞ্ছিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা একদমই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এরই মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নাগরিকদের বেশ শঙ্কিত করে তুলেছে।
তবে মৃত্যুদণ্ড রায়ের প্রতিবাদে শেখ হাসিনার ডাকা লকডাউন সুপার ফ্লপ হওয়ায় এ ধারণা করা যায়, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ঝুঁকি নিতে চান না। তারা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থসম্পদ নিরাপদ রাখতে বড় ধরনের কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইবেন না। অন্যদিকে দলটির নেতাকর্মীরা এতদিন ভেবে আসছেন যে, দেশের উন্নয়নের কারণে শেখ হাসিনা অনেক জনপ্রিয় এবং জুলাই বিপ্লব ছিল একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। কিন্তু শেখ হাসিনা কর্তৃক কমপ্লিট লকডাউন ঘোষণা দেওয়ার পর জনগণ তাতে সাড়া না দেওয়ায় তার জনপ্রিয়তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এটাও দলের নেতাকর্মীদের ভাবিয়ে তুলেছে। ফলে নির্বাচন বানচাল করতে তারা কতটা সক্ষম হবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
সুতরাং যে যেভাবেই ভাবুক না কেন আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি রয়েছে। সেইসঙ্গে এটাও জোরের সঙ্গে বলা যায়, আগামী ফেব্রুয়ারিতে যথাসময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক


ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কেন মাধবদী
‘তাজ স্টোরি’ সিনেমা এবং হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি