চট্টগ্রামে গত এক বছরে সংঘটিত ৪১টি খুনের মধ্যে অন্তত ২১টির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে বিদেশি নম্বর ব্যবহারকারী সন্ত্রাসী চক্র। ভারত, সৌদি আরব, ওমান, দুবাই ও কাতারের সিম ব্যবহার করে পরিচালিত এ অপরাধ নেটওয়ার্কের খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, জমি দখলের নির্দেশ আসে হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ও টেলিগ্রামের এনক্রিপটেড কল ও ভয়েস নোটে।
পুলিশের একাধিক সংস্থা স্বীকার করেছে—বিদেশি নম্বরভিত্তিক এসব অ্যাপ ট্র্যাক করার সক্ষমতা তাদের নেই। ফলে পুলিশের কাছে চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড হয়ে গেছে এক ‘অদৃশ্য অনলাইন নেটওয়ার্ক।’
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে কমপক্ষে ১৪টি সক্রিয় গ্রুপের ৯০ শতাংশ সদস্য বিদেশি নম্বরনির্ভর অ্যাপে সক্রিয়। অপরাধ সংঘটনের আগে ও পরে নির্দেশ আসে এনক্রিপটেড ভয়েস নোট বা কলের মাধ্যমে, যেগুলো ট্র্যাক করা বর্তমানে পুলিশের সক্ষমতার বাইরে। ফলে ঘটনাস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান পাওয়া যায় না।
পুলিশের সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী, এসব গ্রুপের মধ্যে রয়েছে- হাটহাজারী, রাউজান ও বায়েজিদ এলাকায় সক্রিয় সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ বাহিনী, পাহাড়তলী ও ইপিজেডকেন্দ্রিক আজিজ বস গ্রুপ, বায়েজিদ-জালালাবাদ এলাকায় সাজ্জাদের রায়হান আলম গ্রুপ, চান্দগাঁওয়ে শহিদুল ইসলাম বুইস্সা গ্রুপ, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও এলাকায় মোবারক হোসেন ইমন গ্রুপ।
গোয়েন্দাদের দাবি, প্রতিটি গ্রুপের পেছনে রয়েছে ৩-৫ জন করে প্রবাসী সিমধারী মাস্টারমাইন্ড, যারা বিদেশে বসেই খুন, হামলা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের নির্দেশ দিয়ে থাকে। ফলে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এসব গ্রুপকে ট্র্যাক করা ও গ্রেপ্তার অভিযান চালানো আরো জটিল হয়ে উঠছে।
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বিষয়টি স্বীকার করে জানান, অনেক গ্রুপের নিজস্ব হ্যাকারও রয়েছে, যারা নম্বর ক্লোনিং, ভুয়া লোকেশন তৈরি, বিদেশি সিম সক্রিয় করা ইত্যাদিতে সহায়তা করে।
চট্টগ্রাম শহরে হত্যার হুমকি পাওয়া অন্তত পাঁচজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন আমার দেশের এই প্রতিবেদক। পাথর ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ সুলতান ইকরাম ভারত ও ফ্রান্সের নম্বর থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন। সন্ত্রাসী রায়হান তাকে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার হুমকি দিয়েছে। বায়েজিদের চালিতাতলীতে খুন হওয়া সরওয়ার হোসেন বাবলাকে হত্যার তিনদিন আগেই বিদেশি নম্বর থেকে হুমকি দিয়েছিলেন রায়হান। তার ছোট ভাই ইমরান খান আজিজকেও ভারতীয়, সৌদি ও দুবাইয়ের নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কালুরঘাট ও পাঁচলাইশের আরো দুই ব্যবসায়ী একইভাবে সাজ্জাদ–রায়হান পরিচয়ে হুমকি পেয়েছেন। যার অডিও রেকর্ড আমার দেশের কাছে সংরক্ষিত আছে।
পুলিশ জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বিদেশি নম্বর থেকে কমপক্ষে শতাধিক মানুষকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরে নগরে আটটি হত্যাকাণ্ডে বড় সাজ্জাদের রায়হান আলম, মোবারক ইমন ও শহিদুল ইসলাম বুইস্সার নাম আসছে। কিন্তু এই তিনজনকে ধরতে পারছে না পুলিশ।
জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, হুমকি-ধমকি দেওয়ার ক্ষেত্রেও সন্ত্রাসীরা একই কৌশল ব্যবহার করছে। এসব প্রযুক্তিগত জটিলতা মোকাবিলা করে তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের নিজস্ব টিম নিজেদের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কাজ করে যাচ্ছে।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, অপরাধীদের নিজস্ব একটি ‘ক্রিমিনাল সোসাইটি’ আছে, যেখানে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের গতিবিধি, খুন বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সব জানে। তিনি বলেন, জেলখানায় গিয়ে যখন এসব অপরাধী নিজেদের মধ্যে কথা বলে, সেখান থেকেও অনেক বড় ঘটনা বা অপরাধ সম্পর্কে আমরা তথ্য পাই। কিন্তু সেই তথ্যকে মাঠে কাজে লাগাতে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এখনো বড় বাধা হয়ে আছে।
টেক সহায়তা না পেয়ে অসহায় পুলিশ
এনক্রিপটেড অ্যাপ ট্র্যাক করার সক্ষমতা শুধুমাত্র একটি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে সীমাবদ্ধ থাকায় জেলা–উপজেলা পর্যায়ের পুলিশ প্রায়ই প্রয়োজনীয় সহায়তা পায় না। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সন্ত্রাসী বা সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের যোগাযোগ শনাক্ত করতে তারা প্রায়ই বিশেষ ওই সংস্থার কাছে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চেয়ে থাকে। তবে সংস্থাটির নিজস্ব নীতিমালা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের কারণে মাঠ পর্যায়ের এসব অনুরোধের অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যায় না। আবার এ ধরনের যোগাযোগ ট্র্যাক করতে যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মনিটরিং সিস্টেম ও ডিপ–প্যাকেট ইন্সপেকশন প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়, পুলিশ বিভাগের নিজস্ব অবকাঠামোতে তা নেই। ফলে মাঠে অপরাধীদের অবস্থান শনাক্ত করা বা তাদের অ্যাপভিত্তিক যোগাযোগ ভেঙে ফেলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এ কারণে সন্ত্রাসী ও সংগঠিত অপরাধ চক্রগুলো প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে এগিয়ে থাকছে, আর পুলিশ অনেক সময় ঘটনা ঘটার পর তদন্তে নামতে বাধ্য হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করছেন, দেশের সাইবার–ক্রাইম ও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড আরো শক্তিশালী করতে হলে পুলিশকে নিজস্ব পর্যায়ে উন্নত মনিটরিং সক্ষমতা গড়ে তোলা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড এখন পুরোপুরি ‘ডিজিটাল শিফট’-এ চলে গেছে। এই নেটওয়ার্ক থামাতে পুলিশকে আধুনিক ডিজিটাল নজরদারি প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক অ্যাপ কোম্পানির সঙ্গে তথ্যচুক্তি ও সাইবার গোয়েন্দা ইউনিটের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে জরুরিভিত্তিতে। নইলে এক সময় আন্ডারওয়ার্ল্ড পুরোপুরি ভার্চুয়াল অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা একেবারেই অসম্ভব পর্যায়ে চলে যাবে।


পাঠ্যবইয়ে যুক্ত হচ্ছে বাকশাল থেকে হাসিনার পলায়ন কাহিনী
রঙিন ব্যালটে গণভোট, ব্যাপক প্রচার চালাবে সরকার-ইসি