জুমাবারে ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে কাঁপল দেশ। বিশেষত, রাজধানী ঢাকাকে যেন হাতের তালুতে রেখে দুলিয়েছে। কম্পনের তীব্রতার দিক থেকে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার মাঝারি এই ভূমিকম্পকে স্মরণকালের মধ্যে মারাত্মক ও নজিরবিহীন বলছেন ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায়। প্রভাব পড়েছে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোয়। অন্তত ১১ জন মারা যাওয়ার খবর এসেছে। আহত হয়েছে ৬ শতাধিক মানুষ। এছাড়া বহু স্থাপনা ভেঙে বা হেলে গেছে। বিভিন্ন স্থানে দেয়াল ধসে পড়েছে। কোনো ভবনের রেলিং ও অংশবিশেষ ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। অনেকেই ভয়-আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মাত্র ২৬ সেকেন্ড স্থায়ী কম্পন নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায় উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ দশমিক ৭ ধরা পড়লেও মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে এটার উৎপত্তি। ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনি জনমনে বিশেষ করে ঢাকা নগরবাসীর মধ্যে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটি মহাবিপর্যয়ের আগে সতর্কসংকেত।
রিখটার স্কেলে ধরা পড়া মাত্রার চেয়ে শুক্রবারের ভূমিকম্পটির তীব্রতা এত বেশি কেন অনুভূত হলো, সেই আলোচনাই প্রাধান্য পাচ্ছে। ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভূমিকম্প ঢাকার খুব কাছে হয়েছে। সে কারণে দোলনার মতো দুলেছে মেগাসিটির অধিবাসীরা। এর আগে এখানে ৪ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়নি।
ইউএসজিএস বলছে, বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ হলেও কেন্দ্রীয় অঞ্চল তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে। ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকার ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ৫ দশমিক ৫ বা তার বেশি মাত্রার ১৪টি ভূমিকম্প হয়েছে—এর মধ্যে দুটি ছিল ৬ মাত্রার। আর শুক্রবার নরসিংদীর মাধবদীর ভূমিকম্পটি ছিল ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে।
জগতে যত ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে ভূমিকম্প। কারণ অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও ভূমিকম্পের আগে কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। ফলে এতে ব্যাপক জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভূমিকম্প মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের সতর্কবার্তা। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আল্লাহর কাছে অতি দ্রুত তওবা করার কথা বলা হয়েছে। তার কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা, মহান আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা ও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার তাগিদ রয়েছে।
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।’ কোরআনে ভূমিকম্প বিষয়ে ‘জিলজাল’ এবং ‘দাক্কা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘জিলজাল’ অর্থ হচ্ছে একটি বস্তুর নড়াচড়ায় আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা। ‘দাক্কা’ অর্থ হচ্ছে প্রচণ্ড কোনো শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোনো কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া।
ভূমিকম্পের বিভীষিকা সম্পর্কে আল্লাহ সুরা হজে বলেছেন, ‘হে মানব জাতি, তোমরা ভয় করো তোমাদের রবকে। নিশ্চয়ই কিয়ামত দিবসের ভূকম্পন হবে মারাত্মক। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, মা তার দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কথা ভুলে যাবে আর সব গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। মানুষকে মাতালের মতো দেখাবে, আসলে তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।’
ভূমিকম্প সম্পর্কে হাদিসেও বিভিন্ন বর্ণনা ও সতর্কবার্তা পাওয়া যায়। তিরমিজিতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এই উম্মত ভূমিকম্প, বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণের মুখোমুখি হবে। একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, কখন সেটা হবে হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রসার ঘটবে এবং মদপানের সয়লাব হবে।’ অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘ভূমিকম্প হচ্ছে কিয়ামতের একটি অন্যতম আলামত। কিয়ামত যতই নিকটবর্তী হবে, ভূমিকম্পের প্রবণতা ততই বাড়তে থাকবে’।
হাদিসগ্রন্থ তিরমিজি শরিফের আরেকটি বর্ণনায় ভূমিকম্পের বেশকিছু প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখলে তা আত্মসাৎ করা হবে, জাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে, ধর্মীয় শিক্ষাবর্জিত বিদ্যা অর্জন করা হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর বাধ্যগত হয়ে মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিয়ে বাবাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে শোরগোল (কথাবার্তা) হবে, সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি সমাজের শাসক হবে, সে সময় তোমরা অপেক্ষা করো—রক্তিম বর্ণের ঝড়ের, ভূকম্পনের, ভূমিধসের, লিঙ্গ পরিবর্তনের, পাথর বৃষ্টির এবং সুতো ছেঁড়া (তাসবিহ) দানার মতো একটির পর একটি নিদর্শনগুলোর জন্য।’
গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে দেখা যাবে, হাদিসে বর্ণিত সব কারণই বাংলাদেশে বিদ্যমান। শুধু বিদ্যমান বললে ভুল হবে, প্রবলভাবে এসব বিরাজমান। ভূমিকম্পের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে আমরা যতটা গুরুত্ব দিই, মহান প্রতিপালকের সতর্কবার্তাকে আমরা ততটাই উপেক্ষা করি। শুক্রবারের ভূমিকম্পটি যদি মাত্রগত দিক থেকে আরো এক বা দুই বেশি হতো, কেন্দ্রটি যদি নরসিংদীর মাধবদী না হয়ে রাজধানীর পল্টন হতো, স্থায়িত্ব যদি আর মিনিটখানেক হতো, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াত আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি? বিপর্যয় কত ভয়াবহ হতো, তা কি আঁচ করতে পারছি? ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিমিষে কি সাঙ্গ হয়ে যেত না? সনদ, পিআর, ইলেকশন, রাষ্ট্রক্ষমতা—সবই চাপা পড়তে পারত ধ্বংসস্তূপের নিচে। ভূমিকম্প ২৬ সেকেন্ডে থাকলেও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে ভেসে বেড়ানো সিসিটিভির কয়েকটি ফুটেজ এখনো হৃৎকম্পন সৃষ্টি করছে। বুকটা ধড়পড় করে।
ভূমিকম্পের পর সবার অকপট স্বীকারোক্তি ছিল—‘এত ভয় কখনো পাইনি’। কিন্তু পরক্ষণেই যেন ভয়কে জয় করে ফেলেছেন সবাই! ভূমিকম্পের আড়াই ঘণ্টা পর রাজধানীর কাকরাইলসংলগ্ন সার্কিট হাউস মসজিদে জুমা আদায় করতে গেলাম। খুতবায় খতিব সাহেব বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন। নামাজ শুরুর সময় দেখলাম সামনের সারির ফাঁকা জায়গায় কোনো মুসল্লি এগোতে চাচ্ছিলেন না। কারণ, জামাত শেষে দ্রুত বের হতে অসুবিধা হবে। দুরাকাত নামাজ শেষে অধিকাংশ মুসল্লি হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলেন। পরের অবশ্য আদায়যোগ্য সুন্নত পড়ার সময় নেই। খতিব তওবা-ইস্তেগফার করে হৃদয়স্পর্শী মোনাজাতে আল্লাহর কাছে বালা-মুসিবত থেকে পানাহ চাইলেন। তাতেও অংশ নিলেন না অধিকাংশ মুসল্লি। সাংঘাতিক ব্যস্ত সবাই! ধারণা করি, এ মসজিদের অধিকাংশ মুসল্লি সরকারি চাকুরে। আশপাশে সরকারি আবাসনই বেশি। ছুটির দিনে কীসের এত ব্যস্ততা, বোধগম্য হয়নি। আসলে কোনো সতর্কবার্তাই আমাদের সেভাবে স্পর্শ করে না।
শুক্রবার সকালে ছোট ছেলে রিমনকে (১২) নিয়ে মাংস কিনতে বেরিয়েছিলেন আবদুর রহিম (৪৮)। ভূমিকম্পের সময় পুরান ঢাকার বংশালের কসাইটুলীতে একটি মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা। এ সময় পাশের এক ভবনের ছাদের রেলিং ধসে মৃত্যু হয়েছে বাবা ও ছেলের। কসাইটুলীর সেই ভবনের পাশেই মা নুসরাত জাহানের সঙ্গে ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম (২০)। তারাও সেখানে মাংস কিনতে গিয়েছিলেন। ছাদের রেলিং ধসে রাফিউল মারা গেছেন। তার মা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিতে পরিবারগুলোর মাতম আমাদের পাষাণ হৃদয়কে বিদীর্ণ করে না। সবকিছু তো স্বাভাবিকই চলছে!
করোনা মহামারির সময়ের কথা স্মরণ আছে নিশ্চয়ই। সে কী ভয়! আল্লাহর দরবারে আহাজারি! ফেসবুকের ওয়াল সয়লাব হয়ে যায় আল্লাহর কাছে ক্ষমার আকুতিতে। ভাইরাস আক্রান্ত স্বজনদের থেকে প্রিয়জনরা কীভাবে দূরে সরে গেছেন এবং সংক্রমিত গর্ভধারিণী মাকে কীভাবে জঙ্গলে ফেলে আসা হয়েছিল—তা বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়। একটি শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপের মালিক করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী থাকাকালে বারবার আকুতি জানিয়েও স্ত্রী-সন্তানদের একনজর দেখতে পাননি। তখন পারলে জীবনের বিনিময়ে লাখ কোটি টাকার সম্পদ আল্লাহর দরবারে সমর্পণেও প্রস্তুত দেখা গেছে অনেককে। কিন্তু মহামারির ভয়াবহতা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুন উদ্যমে অপকর্ম-আনাচার শুরু হয়ে যায়।
ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বলছে—পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এ রকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূতত্ত্বের মধ্যে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটি যখন শিলার ধারণ ক্ষমতা পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূপৃষ্ঠে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।
বাংলাদেশকে ঘিরে ভূমিকম্পের দুটি উৎস কাছাকাছি। সাব-ডাকশন জোনটিই হলো ভয়ংকর। ঢাকা থেকে ৭০-১৫০ কিলোমিটার দূরে এ জোন। যে কারণে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকার অবস্থা ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে—ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং এখানকার ভবনগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতা অনেক বেশি। এ শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত উপায়ে এবং সরকারের প্রস্তুতি ও জনসচেতনতার অভাব প্রকট। অর্থাৎ ঝুঁকির তীব্রতা বাড়াতে যা যা দরকার, সবই ঢাকায় বিদ্যমান।
তীব্রতা ও স্থায়িত্ব আরেকটু হলে শুক্রবারই থেমে যেতে পারত আমাদের দম্ভপূর্ণ বেপরোয়া জীবন। ১০টা ৩৮ মিনিটের ভূমিকম্পের মাত্রাটি ৫ দশমিক ৭ না হয়ে ৭ দশমিক ৭ হলেই রিমন, রহিম, রাফিউলদের মতো নিভে যেতে পারত রঙিন জীবনের ঝলমলে আলো। তবু আমরা যেন অনুভূতিহীন। কয়েকটি মিডিয়া হাউসের সিসিটিভি ফুটেজ ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে এসেছে। ভূমিকম্পের সময় কর্মরত সংবাদকর্মী বন্ধুদের বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা চোখে পড়েছে। আল্লাহ তাদের হেফাজত করেছেন, এ জন্য শুকরিয়া। কিন্তু অনেক মিডিয়া হাউসে যেসব অনাচারের খবর আসে, তারা কি সতর্ক হবেন? বদলাবেন? জীবনটা যে কত ঠুনকো, তা কি অনুভবে আসবে? বিবেককে তাড়িত করবে? সম্ভাবনা কম। আল্লাহই বলেছেন—নাফরমান কিছু মানুষের হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন। সতর্কবার্তা গ্রাহ্য করলে যে মহান প্রতিপালকের আদেশ-নিষেধ মান্য করতে হবে তাদের। মোজ-মাস্তি চলবে না। আর তা করলে তো তথাকথিত প্রগতিশীলতার রঙিন বেলুন ফুটো হয়ে যায়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

