
মেহেদী হাসান

ঢাকা শহরে যাতায়াত মানে এক ধরনের যুদ্ধ। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া-আসার পথে এ যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয় লাখ লাখ মানুষকে। অশেষ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় অন্য যাতায়াতকারীদেরও। যানজটে মূল্যবান সময় অপচয় আর যানবাহনের তেলই শুধু পুড়ছে না; বরং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব বহুমাত্রিক। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী রাজধানীকে যানজটমুক্ত করতে গত ১০ বছরে ব্যয় করা হয়েছে কমপক্ষে ১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০৫ সাল থেকে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা এসটিপির বিভিন্ন প্রকল্পসহ যানজট নিরসনের নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে কিন্তু যানজট থেকে মুক্তি মেলেনি রাজধানীবাসীর। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অনেক শহরের চিত্রও কমবেশি একই। এ অবস্থায় যানজট দূর করার নামে সংশোধিত এসটিপির অধীনে আগামী ২০ বছরে আরো ৫৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ১০ বছরে লক্ষাধিক কোটি টাকা ব্যয়ের পরও যেখানে যানজট কমেনি, সেখানে ভবিষ্যতে এত বিপুল অর্থ খরচের পরিণতি কী হবে তা নিয়ে। বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ করেও যানজট না কমার মূল কারণ হিসেবে সামনে এসেছে ভুল পরিকল্পনার বিষয়টি। ভুল পরিকল্পনার কারণে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট বিআরটির পেছনে চার হাজার কোটি টাকা খরচের পর বাতিল করা হয়েছে প্রকল্পটি। সমন্বয়হীনতার কারণে নান্দনিক পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়কের বড় একটি অংশ ভাঙার কথা বলা হচ্ছে মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য। এভাবে ভুল পরিকল্পনার কারণে অন্য আরো অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও আসছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল। যানজট দূর করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি দীর্ঘ উড়ালসড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আরো একাধিক দীর্ঘ উড়ালসড়ক নির্মাণাধীন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন উড়ালসড়কের ওপরই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকছে প্রায় প্রতিদিন। যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক তার প্রমাণ।
যানজট দূর করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মাল্টি বিলিয়ন ডলার খরচ করে অনেক উড়ালসড়ক নির্মাণ করেছে কিন্তু যানজট দূর হয়নি; বরং বেড়েছে। ব্যাংককসহ বিভিন্ন শহরে বিদেশি ঋণে ব্যাপকভিত্তিক উড়ালসড়ক নির্মাণ করেও যানজট দূর করার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সুফল পায়নি। কিন্তু তা থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে একই পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। বস্তুত যানজট দূর করার নামে লোকদেখানো উন্নয়ন, বিদেশি ঋণের অর্থ লুটপাটের জন্য রাজনৈতিক বিবেচনাই এসব মেগা প্রকল্প গ্রহণের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যানজট দূর করার নামে, ভ্রান্ত উন্নয়নের মোড়কে বিশ্বের অনেক দেশ এখন শিকারে পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণ ব্যবসায়ী ও প্রাইভেট কার আমদানিকারক চক্রের। উড়ালসড়ক নির্মাণ করে বিশ্বের বিভিন্ন শহর ও দেশকে পরিণত করা হয়েছে প্রাইভেট কারের ডাম্পিং স্টেশনে। বাংলাদেশও অগ্রসর হচ্ছে একই পরিণতির দিকে।
২০ বছর আগে খুবই অল্প খরচে যানজট দূর করার ক্ষেত্রে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করে কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোতা। যানজট দূর করার জন্য বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পাতাল রেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বোগোতার তৎকালীন মেয়র ও নগর-পরিকল্পনাবিদ এনরিক পেনালোসা এসব প্রস্তাব বাতিল করে বাসনির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থা বিআরটি সিস্টেম চালু করেন। বিআরটি হলো সড়কে শুধু বাসের জন্য আলাদা একটি লেন তৈরি করা। বোগোতার ৬৯ শতাংশ যাত্রী বর্তমানে এ পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করে।
কলাম্বিয়া ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শতাধিক শহরে খুবই সফলভাবে বিআরটি সিস্টেম চালু থাকলেও বাংলাদেশে ১২ বছর ধরে একটি বিআরটি প্রকল্পের পেছনে ৪ হাজার কোটি টাকা অপচয় ও লুটপাট শেষে বন্ধ করা হয়েছে এ প্রকল্প।
যানজট দূর করতে হলে প্রথমে চিহ্নিত করা দরকার যানজট কেন সৃষ্টি হয়। যে কারণে যানজট সৃষ্টি হয়, সেই গোড়ার কারণ দূর না করে যানজট দূর করার নামে যতই বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প গ্রহণ করা হোক না কেন, যানজট কখনোই দূর হবে না।
যানজটের মূল কারণগুলো যদি চিহ্নিত করা হয়, তবে শীর্ষে যেসব কারণ স্থান পাবে সেগুলো হলোÑঅনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট কার, উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকা, বিকেন্দ্রীকরণ না করা এবং অব্যবস্থাপনা।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যেখানে অনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট কার যানজটের মূল কারণ সেখানে ব্যক্তিগত এ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ না করে বরং একের পর এক উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, যা মূলত প্রাইভেট কার ব্যবহারকে আরো উৎসাহিত করছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলো প্রাইভেট কারবান্ধব একটি পরিবহন ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী আর বড় অনেক দেশের অনেক শহরে দেখা যায় এই প্রাইভেট কারনির্ভর পরিবহন ব্যবস্থা। কিন্তু ঢাকার মতো এত বিপুল জনসংখ্যা আর স্বল্প আয়ের মানুষের দেশে কখনোই এই ব্যবস্থা সঠিক কোনো পরিবহন পরিকল্পনা হতে পারে না।
যেখানে দরকার ছিল বিকেন্দ্রীকরণ, সেখান্যে অব্যাহতভাব সারা দেশের সব মানুষকে ঢাকায় ডেকে আনার আয়োজন চলছে। মূলত তিনটি কারণে মানুষ রাজধানীসহ উন্নত শহরে যায়। এগুলো হলো শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও চিকিৎসা। এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে যদি বিকেন্দ্রীকরণ করা যেত এবং জেলা, উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়নপর্যায়ে সুষমভাবে মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেত, তাহলে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের ওপর মানুষের চাপ অনেক কমে যেত। উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার অভাবে অনেক সাধারণ রোগীকেও অশেষ হয়রানি আর বিপুল অর্থ খরচ করে এখনো ঢাকায় আসতে হয়, যা মেনে নেওয়ার মতো নয়। সারা দেশের সব স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সমভাবে একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা হতো, তাহলে প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর লাখ লাখ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের রাজধানীসহ এক এক জেলা থেকে আরেক জেলায় হন্যে হয় ছুটতে হতো না। যদি সারা দেশে সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো, তাহলে জীবিকার সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ ঢাকামুখী হতো না।
যদি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, বাস ও ট্রেননির্ভর উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় এবং সঠিক উপায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, তাহলে যানজট আপনা-আপনি দূর হয়ে যাবে। যানজট দূর করার নামে এভাবে লাখো কোটি টাকা খরচ করে মেগা প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব বিষয়ে বাস্তভিত্তিক চিন্তা ও পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্টদের।
যানজট দূর করার বিষয়টি নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা, পরিবহন ব্যবস্থাসহ অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত। এটা একটি বিশেষায়িত শাখা। কিন্তু যানজট দূর করাবিষয়ক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে অতীতে যারা যুক্ত ছিলেন এবং এখনো যারা রয়েছেন, তাদের অনেকেরই এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিশেষায়িত জ্ঞান নেই। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে যানজট দূর করার ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে শুধু অনুমানের ভিত্তিতে। অনুমাননির্ভর এসব প্রকল্পে দেশ ও জাতি লাভবান না হলেও লাভবান হয়েছে এর সঙ্গে জড়িত বিশেষ গোষ্ঠী।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে লেভেলক্রসিংয়ের ওপর বক্সকালভার্ট থাকে। ফলে লেভেলক্রসিংয়ে কোনো সিগন্যাল থাকে না, কোনো জনবল রাখারও প্রয়োজন হয় না। ঢাকায় ১৪০ বছর হলো রেলের ইতিহাস কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো একটি লেভেলক্রসিংয়ের ওপর সামান্য খরচের বক্সকালভার্ট নির্মাণ করা হয়নি। অথচ লেভেলক্রসিংয়ে সৃষ্ট যানজটের জন্য অজ্ঞতাবশত দোষারোপ করা হচ্ছে রেলব্যবস্থাকে এবং অনেক সময় যানজটের অজুহাতে রেলকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো আত্মঘাতী প্রস্তাবও এসেছে। অন্যদিকে কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন লেভলক্রসিংয়ের ওপর এমনভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ফলে ভবিষ্যতে কোনোদিন আর বক্সকালভার্ট নির্মাণ সম্ভব হবে না। তাছাড়া বিভিন্ন রেললাইনের উপরে উড়ালসড়ক নির্মাণ করে ভবিষ্যতে রেলব্যবস্থা সম্প্রসারণের সুযোগও চিরদিনের জন্য রুদ্ধ করা হচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক, টোকিওর মতো বিশ্বের সব বড় মেগাসিটিতে যানজট দূর করার ক্ষেত্রে প্রথমেই তারা ঠিক করেছে নির্দিষ্ট একটি সময় পর শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা কত হবে, সেসব বিষয়। এসব বিষয় নির্ধারণ না করে আজ যানজট দূর করতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে, ১০ বছর পর তা মানুষের চাপে অকার্যকর হয়ে যাবে।
ক্ষুদ্র গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, সহজ উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিকেন্দ্রীকরণ না করে শহরে যতই ব্যয়বহুল উড়ালসড়ক আর পাতাল রেল নির্মাণ করা হোক না কেন, তা দীর্ঘ মেয়াদে যানজট দূর করতে পারবে না।
যানজট থেকে আমাদের অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেটি কত মূল্যের বিনিময়ে। আমাদের মতো একটি দেশের পেছনে আর কত অর্থ খরচ করবে? দেশে কি আর কোনো সমস্যা নেই? জ্বালানি ও বিদ্যুৎসংকট, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান সংকট, বন্ধ শিল্প-কারখান চালুকরণ, সমরাস্ত্র ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্বলতাসহ শত শত জরুরি সমস্যা রয়েছে দেশে। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে শুধু যানজট আর রাস্তার পেছনে আর কত অর্থ খরচ করবে এ জাতি? সম্প্রতি খবর বের হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ১০ লেনে উন্নীত করতে ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব করা হয়েছে। রেল ও নৌপথকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু এই সড়কনির্ভর যোগাযোগ কাঠামো তৈরি, প্রতিবছর সড়ক মেরামতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আর লুটপাট থেকে জাতি কি মুক্তি পাবে না?
লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

ঢাকা শহরে যাতায়াত মানে এক ধরনের যুদ্ধ। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া-আসার পথে এ যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয় লাখ লাখ মানুষকে। অশেষ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় অন্য যাতায়াতকারীদেরও। যানজটে মূল্যবান সময় অপচয় আর যানবাহনের তেলই শুধু পুড়ছে না; বরং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব বহুমাত্রিক। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী রাজধানীকে যানজটমুক্ত করতে গত ১০ বছরে ব্যয় করা হয়েছে কমপক্ষে ১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০৫ সাল থেকে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা এসটিপির বিভিন্ন প্রকল্পসহ যানজট নিরসনের নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে কিন্তু যানজট থেকে মুক্তি মেলেনি রাজধানীবাসীর। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অনেক শহরের চিত্রও কমবেশি একই। এ অবস্থায় যানজট দূর করার নামে সংশোধিত এসটিপির অধীনে আগামী ২০ বছরে আরো ৫৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ১০ বছরে লক্ষাধিক কোটি টাকা ব্যয়ের পরও যেখানে যানজট কমেনি, সেখানে ভবিষ্যতে এত বিপুল অর্থ খরচের পরিণতি কী হবে তা নিয়ে। বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ করেও যানজট না কমার মূল কারণ হিসেবে সামনে এসেছে ভুল পরিকল্পনার বিষয়টি। ভুল পরিকল্পনার কারণে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট বিআরটির পেছনে চার হাজার কোটি টাকা খরচের পর বাতিল করা হয়েছে প্রকল্পটি। সমন্বয়হীনতার কারণে নান্দনিক পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়কের বড় একটি অংশ ভাঙার কথা বলা হচ্ছে মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য। এভাবে ভুল পরিকল্পনার কারণে অন্য আরো অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও আসছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল। যানজট দূর করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি দীর্ঘ উড়ালসড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আরো একাধিক দীর্ঘ উড়ালসড়ক নির্মাণাধীন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন উড়ালসড়কের ওপরই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকছে প্রায় প্রতিদিন। যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক তার প্রমাণ।
যানজট দূর করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মাল্টি বিলিয়ন ডলার খরচ করে অনেক উড়ালসড়ক নির্মাণ করেছে কিন্তু যানজট দূর হয়নি; বরং বেড়েছে। ব্যাংককসহ বিভিন্ন শহরে বিদেশি ঋণে ব্যাপকভিত্তিক উড়ালসড়ক নির্মাণ করেও যানজট দূর করার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সুফল পায়নি। কিন্তু তা থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে একই পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। বস্তুত যানজট দূর করার নামে লোকদেখানো উন্নয়ন, বিদেশি ঋণের অর্থ লুটপাটের জন্য রাজনৈতিক বিবেচনাই এসব মেগা প্রকল্প গ্রহণের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যানজট দূর করার নামে, ভ্রান্ত উন্নয়নের মোড়কে বিশ্বের অনেক দেশ এখন শিকারে পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণ ব্যবসায়ী ও প্রাইভেট কার আমদানিকারক চক্রের। উড়ালসড়ক নির্মাণ করে বিশ্বের বিভিন্ন শহর ও দেশকে পরিণত করা হয়েছে প্রাইভেট কারের ডাম্পিং স্টেশনে। বাংলাদেশও অগ্রসর হচ্ছে একই পরিণতির দিকে।
২০ বছর আগে খুবই অল্প খরচে যানজট দূর করার ক্ষেত্রে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করে কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোতা। যানজট দূর করার জন্য বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পাতাল রেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বোগোতার তৎকালীন মেয়র ও নগর-পরিকল্পনাবিদ এনরিক পেনালোসা এসব প্রস্তাব বাতিল করে বাসনির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থা বিআরটি সিস্টেম চালু করেন। বিআরটি হলো সড়কে শুধু বাসের জন্য আলাদা একটি লেন তৈরি করা। বোগোতার ৬৯ শতাংশ যাত্রী বর্তমানে এ পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করে।
কলাম্বিয়া ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শতাধিক শহরে খুবই সফলভাবে বিআরটি সিস্টেম চালু থাকলেও বাংলাদেশে ১২ বছর ধরে একটি বিআরটি প্রকল্পের পেছনে ৪ হাজার কোটি টাকা অপচয় ও লুটপাট শেষে বন্ধ করা হয়েছে এ প্রকল্প।
যানজট দূর করতে হলে প্রথমে চিহ্নিত করা দরকার যানজট কেন সৃষ্টি হয়। যে কারণে যানজট সৃষ্টি হয়, সেই গোড়ার কারণ দূর না করে যানজট দূর করার নামে যতই বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প গ্রহণ করা হোক না কেন, যানজট কখনোই দূর হবে না।
যানজটের মূল কারণগুলো যদি চিহ্নিত করা হয়, তবে শীর্ষে যেসব কারণ স্থান পাবে সেগুলো হলোÑঅনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট কার, উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকা, বিকেন্দ্রীকরণ না করা এবং অব্যবস্থাপনা।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যেখানে অনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট কার যানজটের মূল কারণ সেখানে ব্যক্তিগত এ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ না করে বরং একের পর এক উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, যা মূলত প্রাইভেট কার ব্যবহারকে আরো উৎসাহিত করছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলো প্রাইভেট কারবান্ধব একটি পরিবহন ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী আর বড় অনেক দেশের অনেক শহরে দেখা যায় এই প্রাইভেট কারনির্ভর পরিবহন ব্যবস্থা। কিন্তু ঢাকার মতো এত বিপুল জনসংখ্যা আর স্বল্প আয়ের মানুষের দেশে কখনোই এই ব্যবস্থা সঠিক কোনো পরিবহন পরিকল্পনা হতে পারে না।
যেখানে দরকার ছিল বিকেন্দ্রীকরণ, সেখান্যে অব্যাহতভাব সারা দেশের সব মানুষকে ঢাকায় ডেকে আনার আয়োজন চলছে। মূলত তিনটি কারণে মানুষ রাজধানীসহ উন্নত শহরে যায়। এগুলো হলো শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও চিকিৎসা। এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে যদি বিকেন্দ্রীকরণ করা যেত এবং জেলা, উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়নপর্যায়ে সুষমভাবে মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেত, তাহলে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের ওপর মানুষের চাপ অনেক কমে যেত। উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার অভাবে অনেক সাধারণ রোগীকেও অশেষ হয়রানি আর বিপুল অর্থ খরচ করে এখনো ঢাকায় আসতে হয়, যা মেনে নেওয়ার মতো নয়। সারা দেশের সব স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সমভাবে একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা হতো, তাহলে প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর লাখ লাখ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের রাজধানীসহ এক এক জেলা থেকে আরেক জেলায় হন্যে হয় ছুটতে হতো না। যদি সারা দেশে সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো, তাহলে জীবিকার সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ ঢাকামুখী হতো না।
যদি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, বাস ও ট্রেননির্ভর উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় এবং সঠিক উপায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, তাহলে যানজট আপনা-আপনি দূর হয়ে যাবে। যানজট দূর করার নামে এভাবে লাখো কোটি টাকা খরচ করে মেগা প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব বিষয়ে বাস্তভিত্তিক চিন্তা ও পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্টদের।
যানজট দূর করার বিষয়টি নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা, পরিবহন ব্যবস্থাসহ অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত। এটা একটি বিশেষায়িত শাখা। কিন্তু যানজট দূর করাবিষয়ক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে অতীতে যারা যুক্ত ছিলেন এবং এখনো যারা রয়েছেন, তাদের অনেকেরই এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিশেষায়িত জ্ঞান নেই। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে যানজট দূর করার ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে শুধু অনুমানের ভিত্তিতে। অনুমাননির্ভর এসব প্রকল্পে দেশ ও জাতি লাভবান না হলেও লাভবান হয়েছে এর সঙ্গে জড়িত বিশেষ গোষ্ঠী।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে লেভেলক্রসিংয়ের ওপর বক্সকালভার্ট থাকে। ফলে লেভেলক্রসিংয়ে কোনো সিগন্যাল থাকে না, কোনো জনবল রাখারও প্রয়োজন হয় না। ঢাকায় ১৪০ বছর হলো রেলের ইতিহাস কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো একটি লেভেলক্রসিংয়ের ওপর সামান্য খরচের বক্সকালভার্ট নির্মাণ করা হয়নি। অথচ লেভেলক্রসিংয়ে সৃষ্ট যানজটের জন্য অজ্ঞতাবশত দোষারোপ করা হচ্ছে রেলব্যবস্থাকে এবং অনেক সময় যানজটের অজুহাতে রেলকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো আত্মঘাতী প্রস্তাবও এসেছে। অন্যদিকে কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন লেভলক্রসিংয়ের ওপর এমনভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ফলে ভবিষ্যতে কোনোদিন আর বক্সকালভার্ট নির্মাণ সম্ভব হবে না। তাছাড়া বিভিন্ন রেললাইনের উপরে উড়ালসড়ক নির্মাণ করে ভবিষ্যতে রেলব্যবস্থা সম্প্রসারণের সুযোগও চিরদিনের জন্য রুদ্ধ করা হচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক, টোকিওর মতো বিশ্বের সব বড় মেগাসিটিতে যানজট দূর করার ক্ষেত্রে প্রথমেই তারা ঠিক করেছে নির্দিষ্ট একটি সময় পর শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা কত হবে, সেসব বিষয়। এসব বিষয় নির্ধারণ না করে আজ যানজট দূর করতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে, ১০ বছর পর তা মানুষের চাপে অকার্যকর হয়ে যাবে।
ক্ষুদ্র গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, সহজ উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিকেন্দ্রীকরণ না করে শহরে যতই ব্যয়বহুল উড়ালসড়ক আর পাতাল রেল নির্মাণ করা হোক না কেন, তা দীর্ঘ মেয়াদে যানজট দূর করতে পারবে না।
যানজট থেকে আমাদের অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেটি কত মূল্যের বিনিময়ে। আমাদের মতো একটি দেশের পেছনে আর কত অর্থ খরচ করবে? দেশে কি আর কোনো সমস্যা নেই? জ্বালানি ও বিদ্যুৎসংকট, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান সংকট, বন্ধ শিল্প-কারখান চালুকরণ, সমরাস্ত্র ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্বলতাসহ শত শত জরুরি সমস্যা রয়েছে দেশে। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে শুধু যানজট আর রাস্তার পেছনে আর কত অর্থ খরচ করবে এ জাতি? সম্প্রতি খবর বের হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ১০ লেনে উন্নীত করতে ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব করা হয়েছে। রেল ও নৌপথকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু এই সড়কনির্ভর যোগাযোগ কাঠামো তৈরি, প্রতিবছর সড়ক মেরামতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আর লুটপাট থেকে জাতি কি মুক্তি পাবে না?
লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

লৌহমানবীখ্যাত মার্গারেট থ্যাচার যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, তখন তার ছেলে ট্রাফিক আইনলঙ্ঘন করার দায়ে জরিমানার শিকার হয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সন্তান বলে রক্ষা পাননি। কারণ ইংল্যান্ডে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, প্রধানমন্ত্রী, লর্ড, ব্যারন কিংবা সাধারণ মানুষ যেই হন না কেন। এই তো অতিসম্প্রতি ব্রিটেনে
১৫ ঘণ্টা আগে
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত সংবাদ দেখা যাচ্ছে, ভারতে মুসলিমরা তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই খবরগুলো দুঃখজনক একটা বাস্তবতা সামনে এনেছে। ভারতের গণতন্ত্র তাদের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। এখন আর এটি বলার উপায় নেই যে, এই ঘটনাগুলো বিরল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। হঠাৎ করে
১৫ ঘণ্টা আগে
কী করে যেন একই সময়ে দেখা গেল পশ্চিমি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ভারতে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের পতিত শাসক শেখ হাসিনার বর্বর হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করে নির্বিকার সাফাই চেষ্টা এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে দেশে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। এটা কি শুধুই কাকতালীয় ব্যাপার?
১৬ ঘণ্টা আগে
জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘গ্লোবাল মাইগ্রেশন এজেন্ডা’র বিরুদ্ধে তার ভাষণে সরব হন, তখন সেটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে না দেখে এক বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকেত হিসেবে দেখা উচিত, যা জাতীয়তাবাদী ও বর্জনমুখী শাসনব্যবস্থাগুলোর জন্য এক
২ দিন আগে