আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

কে দেবেন উদীয়মান বাংলাদেশের নেতৃত্ব

ড. মো. ফরিদ তালুকদার
কে দেবেন উদীয়মান বাংলাদেশের নেতৃত্ব

৮ নভেম্বর ২০১৬, বাসা থেকে ট্রেনে চেপে ক্লাসে যাচ্ছি টেক্সাসের অন্যতম বড় শহর ডালাস ডাউনটাউনে। ট্রেনের মধ্যে বোঝার উপায় নেই যে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গণনা চলছে। কারো মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা বা পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক নেই। একটু পরই ট্রেনটি ইউনিভার্সিটির স্টেশনের কাছে থামল, আমি নেমে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালাম।

বিজ্ঞাপন

অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লাসে এলেন প্রফেসর ডক্টর ব্র্যান্ডন। তিনি ক্লাসের একপর্যায়ে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরেই নির্বাচনের ফলাফল দেখার জন্য গুগল সার্চ করলেন। তখন কিছু স্টেটের ফলাফল মাত্র আসতে শুরু করেছে। তখনো পর্যন্ত হিলারি ক্লিন্টন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে বেশ কিছু ইলেক্টোরাল ভোটে এগিয়ে। বিদেশি স্টুডেন্টের পাশাপাশি ক্লাসে ছিল বেশ কিছু আমেরিকান অর্থাৎ লোকাল স্টুডেন্ট। প্রফেসর এবং লোকাল স্টুডেন্টদের উচ্ছ্বাস দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে তারা সবাই চান যেন হিলারি ক্লিন্টন জয়ী হন। নির্বাচনের ফলাফল আসতে থাকল এবং আমাদের ক্লাসে নির্বাচন নিয়ে আলোচনাও জমে উঠল। আলোচনার একপর্যায়ে আমি বললাম, ডোনাল্ড ট্রাম্প উইল উইন (ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতবেন)। এ কথা শুনে প্রফেসর এবং ক্লাসের সবাই বিশেষ করে লোকাল স্টুডেন্টরা একটু অবাকই হলেন, কিন্তু আমাকে কেউ কিছু বললেন না।

তারপর কী হলো তা তো আমরা সবাই জানি। হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে জয়ী হোয়াইট হাউসে গেলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পরের সপ্তাহে ক্লাস শেষে প্রফেসর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কীভাবে বুঝেছিলে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতবেন?’ এই প্রশ্ন শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম, প্রফেসর কোনো গোয়েন্দা সংস্থার লোক কি না? কারণ আমেরিকায় কে গোয়েন্দা, কে গোয়েন্দা নন, তা বোঝা মুশকিল। তারপর আবার ভাবলাম, না এমন কিছু না। আর গোয়েন্দা হলেই কী, আমি তো খারাপ কিছু বলিনি।

তারপর প্রফেসরকে বললাম, আমেরিকাকে শুধু একটি দেশ হিসেবে ভাবলে এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের শুধু একটি মাধ্যম হিসেবে দেখলে আমরা বুঝতে পারব না কেন ট্রাম্প জিতলেন আর হিলারি ক্লিন্টন হারলেন। এটা বোঝার জন্য আমাদের আমলে নিতে হবে দেশ হিসেবে আমেরিকার অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক ক্ষমতা। একই সঙ্গে আমাদের আমলে নিতে হবে আমেরিকার ভৌগোলিক সীমানার বাইরে যে বাকি পৃথিবী আছে, সেখানে আমেরিকার অবস্থান এবং প্রভাব কেমন।

এ দুটি বিষয় আমলে নিয়ে চিন্তা করলে আমরা দেখব-আমেরিকা শুধু একটি দেশ হিসেবেই ফাংশন করে না, বরং সে ফাংশন করে পুরো একটি পৃথিবী হিসেবে। এখন আপনিই বলুন, আমেরিকার জনগণ কি এমন একজন নেতাকে নির্বাচিত করবে না, যিনি আমেরিকার অর্থনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক ক্ষমতার ভার বহন করে আমেরিকা তথা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে পারেন?

আমি প্রফেসরকে আরো বললাম, আমেরিকার নাগরিকরা মনে করেন তাদের দরকার এমন এক প্রেসিডেন্ট যিনি এবং যার দল চীন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান ক্ষমতার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমেরিকার একক বিশ্বনেতৃত্ব বজায় রাখার সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারেন। তাই তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেছে নিয়েছেন। আমার এই বিশ্লেষণ শুনে প্রফেসর বেশ অবাকই হলেন। কারণ, আমেরিকার অনেক নাগরিকই জানেন না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ আমেরিকাকে কীভাবে দেখে এবং মূল্যায়ন করে।

যাই হোক, ঠিক একই ঘটনা আবার ঘটেছে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ২০১৬ সালে আমি ছিলাম স্টুডেন্ট এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি আমার ক্লাসে নির্বাচনের আগে একই বিশ্লেষণ তুলে ধরে আমার ছাত্রদের বলেছিলাম, এবারও ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতবেন। নির্বাচনে ঠিকই আবার ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হারিসকে পরাজিত করেন।

ওপরের ঘটনা বর্ণনা করলাম বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরার জন্য। ২০২৫ সালে তথ্যপ্রযুক্তি, সামরিক ও রাজনীতিতে উন্নত এবং জটিল এক পৃথিবীকে আমরা দেখছি। তার মধ্যে বাংলাদেশে হয়েছে গণঅভ্যুত্থান। দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছে জুলুম-নির্যাতনকারী ভয়ংকর শাসক শেখ হাসিনা। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এমন একজন শাসক ও দলের হাতে বাংলাদেশকে দেখতে চায় যে এবং যার দল দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ভৌগোলিক এবং ব্যবসায়িকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২০ কোটি মানুষের এ দেশকে সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস মানুষের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের এই আকাঙ্ক্ষাকে আরো জোরদার করেছেন। কারণ, বর্তমান বিশ্বের আর কোনো দেশেই এই মুহূর্তে তার মতো এত যোগ্য ও বরেণ্য সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান নেই। তার নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশকে ঘিরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক, বিশেষত ভারতের ষড়যন্ত্রগুলো বানচাল হয়ে গেছে। এ কারণেই দেশের মানুষ ভবিষ্যতেও এমন নেতাকে খুঁজবেন, যিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতোই দেশীয়-আন্তর্জাতিক সব ধরনের ঝুঁকি ও ষড়যন্ত্র সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবেন।

বাংলাদেশ আর ১৯৯৬ বা ২০০১ সালের জায়গায় নেই। আজকের বাংলাদেশ একটি ভিন্ন বাস্তবতার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল রাখতে নিকটতম বড় প্রতিবেশী ভারত আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি তৎপর। এর পাশাপাশি, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে কৌশলগত লড়াই ক্রমাগত তীব্র হয়ে উঠছে। মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধ এই অঞ্চলে নতুন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলে স্বাধীনতার আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে নিষ্পেষিত ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা। পাশাপাশি বাংলাদেশের আছে প্রায় ২০ কোটি মানুষের বড় বাজার এবং ভৌগোলিকভাবে একটি অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থান। তাই আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিকভাবে ক্ষমতাধর সব রাষ্ট্রই চাইবে বাংলাদেশে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে। ফলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এসব দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়েই হাঁটতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার এবং উন্নয়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে রোবট এবং ড্রোন ইন্ডাস্ট্রির মতো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ইন্ডাস্ট্রি। আনতে হবে বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি যেমন টেসলা, টয়োটার বিনিয়োগ, সৃষ্টি করতে হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। বাংলাদেশের আয়তন এবং অধিক জনসংখ্যা কোনো সীমাবদ্ধতা নয়। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুর একটি ছোট দেশ, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। তবু তারা অর্থনীতি, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিতে অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

সুতরাং গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নয়নের সম্ভাবনাময় ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই বাংলাদেশের দায়িত্ব কে নেবেন? কে আছেন আমাদের এমন নেতা, যিনি এই উদীয়মান বাংলাদেশের ভার বহন করতে পারবেন? বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রদের নতুন দল কি এই নতুন বাংলাদেশের ভার বহন করতে পারবে? নাকি আগামীর শাসক/শাসকরা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পুরাতন, অনুপযোগী কৌশলেই ব্যবহার করবেন, যেমন আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম কিছুটা সচল রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কিছুটা বৃদ্ধি করা, নাগরিকদের নামমাত্র গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ দেওয়া, ভারতের আনুগত্য এবং দলের কর্মী বাহিনী দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা?

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ

ম্যাকনিজ স্টেট ইউনিভার্সিটি, লুইসিয়ানা, ইউসএ

mtalukder@mcneese.edu

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন