ড. মো. খলিলুর রহমান
কলকাতা বন্দরকে নদীর পলির হাত থেকে রক্ষা করার অজুহাতে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে মাত্র ১১ মাইল ভেতরে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর গ্রামে নির্মাণ করা হয় ফারাক্কা বাঁধ। গঙ্গা নদীর ওপর ভারত এক হাজার ২৪৫ মিটার দীর্ঘ ও ২৩ মিটার উচ্চতার এই বাঁধ তৈরি করে, যা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলায় এটি অভিশপ্ত মারণবাঁধ হিসেবে পরিচিত। এই বাঁধ ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে একতরফাভাবে চালু হলেও আজ পর্যন্ত তা বন্ধ করা হয়নি। ভারত কোনো আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মানেনি, ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়েও দেখেনি, যা করেছে গায়ের জোরে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। তারা ভাটির দেশের ওপর কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাও তাকিয়ে দেখেনি। এরূপ বাঁধ উজানের দেশ স্থাপন করতে পারে না, চালু করতেও পারে না।
অপরদিকে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে তিস্তা নদীর উজানে ভারতীয় অংশে। ফলে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেছে। ১৯৯৮ সালে তিস্তা নদীর ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধ দিয়ে ৫৪টি ফটকের সাহায্যে তিস্তার পানি মূল প্রবাহ থেকে বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়।
প্রধানত, তিস্তার পানি ভারতের তিস্তা মহানন্দাখালে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়। দুই হাজার ৯১৮ কিলোমিটার লম্বা তিস্তা মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তাছাড়া বিহারের আন্তঃনদীর দিকে পানি প্রবাহিত করা হচ্ছে।
কার্যত তিস্তা নদীর পানিই গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। এদিকে পানির অভাবে তিস্তা বাঁধের দক্ষিণে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা নদীসহ অন্যান্য নদী জীবনমৃত রূপ ধারণ করেছে, কৃষিকাজ ও জলজ প্রাণীর যা-তা অবস্থা—এর কি প্রতিকার হবে? পৃথিবীর সর্বত্রই সব দেশই তাদের দক্ষিণের নামার দেশগুলোর দিকে নদীপ্রবাহে সমঝোতা করে চলে। এখানেই শুধু ব্যতিক্রম কেন?
বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন আমরা জীবনমরণ যুদ্ধে লিপ্ত, সেই সুযোগেই ভারত বাংলাদেশের জন্য মারণবাঁধ ফারাক্কা নির্মাণ করে তা চালু করে । শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি তারা উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে এবং সে সময় আমাদের কৃষিকাজের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পানিও আমরা পাচ্ছি না। অপরদিকে বর্ষায় আমাদের পানির দরকার না হলেও ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দিয়ে বন্যায় এদেশের অনেক অঞ্চল ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতি বছর। সত্যিকার অর্থেই ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম জেলাগুলোয় আজ হাহাকার রব উঠেছে।
আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার ওপর বাঁধ দেওয়া বেআইনি, কিন্তু কে শোনে কার কথা! ফারাক্কা বাঁধের ফলে এদেশের নদীপ্রবাহ, বন্যা, লবণাক্ততা, কৃষি ও মৎস্যসম্পদ নষ্ট, ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস, আর্সেনিক সমস্যা প্রভৃতি নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাই তো তিনি ১৯৭৬ সালে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চ করেছিলেন।
সব অভিন্ন নদীর উজানের পানি যদি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত তুলে নেয়, তা হলে আমাদের যে ক্ষতি হবে তা ভয়াবহ—আমাদের স্বাভাবিক জীবনধারা বদলে যাবে, সবকিছুর আমূল পরিবর্তন হবে, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ও নদীমার্তৃক বাংলাদেশের যে প্রাকৃতিক গুণ, তা আর থাকবে না। এর ফলে মানুষের মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, চেহারা সবকিছুরই পরিবর্তন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে, যে বাংলাদেশ থাকবে তা আর শস্য-শ্যামলা, নদীমার্তৃক, মায়াবী বাংলাদেশ থাকবে না, পরিণত হবে মৃত বাংলাদেশে। বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে, সমুদ্র থেকে পানি নদীতে ঢুকে সবকিছুতেই লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে, নদীতে সুস্বাদু পানির জীবজন্তু মাছ থাকবে না, আর্সেনিকের বিষাক্ত দশা পুরো বাংলাদেশকে গ্রাস করবে। এককালে যে অঞ্চল সবুজ শ্যামলিমাময় ছিল, পরিবেশগত প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় পরবর্তী সময়ে সে অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে, ইতিহাসে যার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এই সুফলা, শস্য-শ্যামলা রত্ন প্রসাধনী, দোয়েল, কোয়েল, পাপিয়া, কোকিল, চড়ই, ময়না ও টিয়ার আবাসস্থল শান্তির নীড় এই বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের মন নরম। রিমঝিম বৃষ্টির শব্দে, রাখালিয়া বাঁশির সুরে, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি কবি গানের সহজাত মন-মানসিকতার পূর্ণ মানবিক গুণের মানুষের বাস এখানে।
নদীতে পানি না থাকলে রুই, বোয়াল, পাঙাশ, কই, শিং, টেংরা, পাবদা, শৈল, চিতল, মলা, কাইকা, পুঁটি, কাতলা, বাটা, নদীর ডিমওয়ালা রুপালি চিংড়া, চেলা ইত্যাদি মাছগুলো কোথায় থাকবে, আর আমরাই বা এত স্বাদের মাছ কোথায় পাব? ভারতের এই সর্বনাশা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে তারা আমাদের ভাতে, মাছে ও পানিতে মারবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব সুস্বাদু মাছ খেতে পাবে না, ভাবা যায়! শুধু কি তাই, নদীগর্ভের অগাধ সম্পদের শেওলার, খালবিলের শাপলা ও কচুরিপাতার বিলুপ্তি ঘটবে। সাপ, বেজি ও বানরের স্বভাবেও পরিবর্তন ঘটবে। এগুলো আরো ভয়ানক স্বভাবের হবে। মরুভূমির অনেক ফলমূল বিষাক্ত হয় সাধারণভাবে পানির মাটির দোষে।
নদীর তল শুকিয়ে ভরে গেলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সহজেই নদীতে ঢুকে যাবে। আর লবণাক্ত পানিতে সুস্বাদু পানির মাছ থাকতে পারে না। সুন্দরবনের সব পরিবেশ নষ্ট হবে, সুন্দরী, গজারি, গোলপাতা, গেওড়া, মৌমাছি, বাঘ ও হরিণ এদেশে থাকবে না। ভাবা যায়, এমন দেশ! কিন্তু ভারতের নিষ্ঠুরতার তা হতে চলেছে। ফারাক্কার প্রভাবেই প্রধানত এদেশে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া হচ্ছে। এ সমস্যা ব্যাপক আকারে এদেশে দেখা দিচ্ছে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর ভয়াবহতা আরো বেড়ে যাবে। কারণ আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় শুধু একটি রোগ হয় না, অনেক রোগের সৃষ্টি হয়। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ভয়াবহতার মধ্যে রয়েছে ত্বকের ক্যানসার, লিভারের রোগ ও লিভার (যকৃৎ) নষ্ট হয়ে যাওয়া, ফুসফুসের রোগ, চামড়া নষ্ট হওয়া ও মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া। হার্টবিট কমে যায়, চোখ ছোট হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে কতটুকু আর্সেনিক প্রতিদিন গ্রহণ করা হচ্ছে এবং কতদিন গ্রহণ করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে বিষক্রিয়ার ভয়াবহতা। দীর্ঘদিন আর্সেনিকযুক্ত পানি খেলে টিস্যু বা অরগান সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়, স্নায়ুতন্ত্রের কাজে বিঘ্ন ঘটে, রক্ত চলাচল ও শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটে। শরীরে বিশ্রী দাগ পড়ে যায় এবং এ ধরনের রোগাক্রান্ত ছেলেমেয়েকে কেউ বিয়েও করতে চায় না। এ ছাড়া ব্রংকাইটিস, নিউরোপ্যাথি ও গ্যাংরিন হয় এবং বৃক্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এভাবে পুরো জাতি ধ্বংসের মুখে পতিত হতে বাধ্য। বিশেষ করে যে শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের সর্বনাশ হয়। সাধারণত আর্সেনিক বিষক্রিয়ার রোগ দীর্ঘদিন (দুই থেকে পাঁচ বছর) আর্সেনিকযুক্ত (প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি) পানি বা খাবার খেলে হয়। শরীরের ভেতরের সব টিস্যু ও অরগানের অনেক কার্যকারিতা নষ্ট করেই তবে উপসর্গ হাতে, পায়ে ও পিঠে দেখা যায়। তত দিনে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েই যায়। ‘আমাদের হাঁটা-চলাফেরা, বুদ্ধি, চিন্তা, ঘুম, ব্যবহার, যৌন-ক্রিয়া—সবকিছুই মস্তিষ্ক দিয়েই পরিচালিত হয়। পেশির সংকোচন, প্রসারণ ও স্মৃতিশক্তির সঙ্গেও মস্তিষ্ক জড়িত। মস্তিষ্কের এই কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিক দ্রব্য ও তাদের তৈরির এনজাইম। আমরা এ বিষয়ে গবেষণা করে দেখেছি, আর্সেনিক বিষক্রিয়াজনিত রোগীদের রক্তে নিউরোট্রান্সমিটার তৈরির এনজাইমের (যেমন, ডোপামিন বিটা হাইড্রোক্সিলেজ) পরিমাণ ও নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণ কমে যায়। এদের তৈরির কো-ফ্যাক্টর, কো-এনজাইমগুলোর পরিমাণ রক্তে কমে যায়। ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করেও অনুরূপ ফল পাওয়া গেছে। রক্ত ও মস্তিষ্ক উভয় ক্ষেত্রেই এসব প্রাণীর রাসায়নিক প্যারামিটারগুলোর পরিমাণ কমে যায়। আর্সেনিকযুক্ত পানির মাছ ও শাকসবজি খেলেও এরূপ হতে পারে। বোয়াল, রুই, চিতলসহ সব মাছের প্রকৃতি ও স্বাদও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আর্সেনিক বিষক্রিয়ার রোগীদের রক্তে বেশি ওজনের প্রোটিনগুলো (যেমন ১৪৫ কেডি, ১৩৫ কেডি, ২২৫ কেডি) জমে, আবার অল্প ওজনের প্রোটিনগুলো উধাও হয়ে যায়। বড় ধরনের রহস্য এর মাঝেই নিহিত। মস্তিষ্কের প্রোটিন প্রসেসিংয়ের পদ্ধতির ওপর আর্সেনিক আঘাত হানে বলে ধারণা করা যায়। এতে বাচ্চারা অথর্ব, হাবাগোবা ও অসুস্থ হয়ে পড়বে, সন্দেহ নেই। তাদের মেধার ওপর আঘাত হানে, ফলে তারা পড়াশোনাও মনে রাখতে পারবে না। জাতি হবে বিকলাঙ্গ। এ সবকিছুর পরিমাণ হবে ভয়াবহ। জাতিও ধ্বংস হবে, যদি ফারাক্কা সমস্যার সমাধান না করা যায় এবং ভারতকে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প থেকে যদি বিরত রাখা না যায়। যেসব ব্যারাজ তৈরি হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা স্থগিত করা উচিত, অথবা দুই দেশের স্বার্থে গ্রহণযোগ্য, বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
সাবেক প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিষ্ঠাতা, নিউরোসায়েন্স রিসার্চ সেন্টার অব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কলকাতা বন্দরকে নদীর পলির হাত থেকে রক্ষা করার অজুহাতে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে মাত্র ১১ মাইল ভেতরে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর গ্রামে নির্মাণ করা হয় ফারাক্কা বাঁধ। গঙ্গা নদীর ওপর ভারত এক হাজার ২৪৫ মিটার দীর্ঘ ও ২৩ মিটার উচ্চতার এই বাঁধ তৈরি করে, যা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলায় এটি অভিশপ্ত মারণবাঁধ হিসেবে পরিচিত। এই বাঁধ ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে একতরফাভাবে চালু হলেও আজ পর্যন্ত তা বন্ধ করা হয়নি। ভারত কোনো আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মানেনি, ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়েও দেখেনি, যা করেছে গায়ের জোরে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। তারা ভাটির দেশের ওপর কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাও তাকিয়ে দেখেনি। এরূপ বাঁধ উজানের দেশ স্থাপন করতে পারে না, চালু করতেও পারে না।
অপরদিকে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে তিস্তা নদীর উজানে ভারতীয় অংশে। ফলে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেছে। ১৯৯৮ সালে তিস্তা নদীর ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধ দিয়ে ৫৪টি ফটকের সাহায্যে তিস্তার পানি মূল প্রবাহ থেকে বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়।
প্রধানত, তিস্তার পানি ভারতের তিস্তা মহানন্দাখালে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়। দুই হাজার ৯১৮ কিলোমিটার লম্বা তিস্তা মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তাছাড়া বিহারের আন্তঃনদীর দিকে পানি প্রবাহিত করা হচ্ছে।
কার্যত তিস্তা নদীর পানিই গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। এদিকে পানির অভাবে তিস্তা বাঁধের দক্ষিণে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা নদীসহ অন্যান্য নদী জীবনমৃত রূপ ধারণ করেছে, কৃষিকাজ ও জলজ প্রাণীর যা-তা অবস্থা—এর কি প্রতিকার হবে? পৃথিবীর সর্বত্রই সব দেশই তাদের দক্ষিণের নামার দেশগুলোর দিকে নদীপ্রবাহে সমঝোতা করে চলে। এখানেই শুধু ব্যতিক্রম কেন?
বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন আমরা জীবনমরণ যুদ্ধে লিপ্ত, সেই সুযোগেই ভারত বাংলাদেশের জন্য মারণবাঁধ ফারাক্কা নির্মাণ করে তা চালু করে । শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি তারা উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে এবং সে সময় আমাদের কৃষিকাজের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পানিও আমরা পাচ্ছি না। অপরদিকে বর্ষায় আমাদের পানির দরকার না হলেও ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দিয়ে বন্যায় এদেশের অনেক অঞ্চল ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতি বছর। সত্যিকার অর্থেই ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম জেলাগুলোয় আজ হাহাকার রব উঠেছে।
আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার ওপর বাঁধ দেওয়া বেআইনি, কিন্তু কে শোনে কার কথা! ফারাক্কা বাঁধের ফলে এদেশের নদীপ্রবাহ, বন্যা, লবণাক্ততা, কৃষি ও মৎস্যসম্পদ নষ্ট, ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস, আর্সেনিক সমস্যা প্রভৃতি নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাই তো তিনি ১৯৭৬ সালে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চ করেছিলেন।
সব অভিন্ন নদীর উজানের পানি যদি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত তুলে নেয়, তা হলে আমাদের যে ক্ষতি হবে তা ভয়াবহ—আমাদের স্বাভাবিক জীবনধারা বদলে যাবে, সবকিছুর আমূল পরিবর্তন হবে, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ও নদীমার্তৃক বাংলাদেশের যে প্রাকৃতিক গুণ, তা আর থাকবে না। এর ফলে মানুষের মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, চেহারা সবকিছুরই পরিবর্তন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে, যে বাংলাদেশ থাকবে তা আর শস্য-শ্যামলা, নদীমার্তৃক, মায়াবী বাংলাদেশ থাকবে না, পরিণত হবে মৃত বাংলাদেশে। বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে, সমুদ্র থেকে পানি নদীতে ঢুকে সবকিছুতেই লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে, নদীতে সুস্বাদু পানির জীবজন্তু মাছ থাকবে না, আর্সেনিকের বিষাক্ত দশা পুরো বাংলাদেশকে গ্রাস করবে। এককালে যে অঞ্চল সবুজ শ্যামলিমাময় ছিল, পরিবেশগত প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় পরবর্তী সময়ে সে অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে, ইতিহাসে যার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এই সুফলা, শস্য-শ্যামলা রত্ন প্রসাধনী, দোয়েল, কোয়েল, পাপিয়া, কোকিল, চড়ই, ময়না ও টিয়ার আবাসস্থল শান্তির নীড় এই বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের মন নরম। রিমঝিম বৃষ্টির শব্দে, রাখালিয়া বাঁশির সুরে, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি কবি গানের সহজাত মন-মানসিকতার পূর্ণ মানবিক গুণের মানুষের বাস এখানে।
নদীতে পানি না থাকলে রুই, বোয়াল, পাঙাশ, কই, শিং, টেংরা, পাবদা, শৈল, চিতল, মলা, কাইকা, পুঁটি, কাতলা, বাটা, নদীর ডিমওয়ালা রুপালি চিংড়া, চেলা ইত্যাদি মাছগুলো কোথায় থাকবে, আর আমরাই বা এত স্বাদের মাছ কোথায় পাব? ভারতের এই সর্বনাশা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে তারা আমাদের ভাতে, মাছে ও পানিতে মারবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব সুস্বাদু মাছ খেতে পাবে না, ভাবা যায়! শুধু কি তাই, নদীগর্ভের অগাধ সম্পদের শেওলার, খালবিলের শাপলা ও কচুরিপাতার বিলুপ্তি ঘটবে। সাপ, বেজি ও বানরের স্বভাবেও পরিবর্তন ঘটবে। এগুলো আরো ভয়ানক স্বভাবের হবে। মরুভূমির অনেক ফলমূল বিষাক্ত হয় সাধারণভাবে পানির মাটির দোষে।
নদীর তল শুকিয়ে ভরে গেলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সহজেই নদীতে ঢুকে যাবে। আর লবণাক্ত পানিতে সুস্বাদু পানির মাছ থাকতে পারে না। সুন্দরবনের সব পরিবেশ নষ্ট হবে, সুন্দরী, গজারি, গোলপাতা, গেওড়া, মৌমাছি, বাঘ ও হরিণ এদেশে থাকবে না। ভাবা যায়, এমন দেশ! কিন্তু ভারতের নিষ্ঠুরতার তা হতে চলেছে। ফারাক্কার প্রভাবেই প্রধানত এদেশে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া হচ্ছে। এ সমস্যা ব্যাপক আকারে এদেশে দেখা দিচ্ছে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর ভয়াবহতা আরো বেড়ে যাবে। কারণ আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় শুধু একটি রোগ হয় না, অনেক রোগের সৃষ্টি হয়। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ভয়াবহতার মধ্যে রয়েছে ত্বকের ক্যানসার, লিভারের রোগ ও লিভার (যকৃৎ) নষ্ট হয়ে যাওয়া, ফুসফুসের রোগ, চামড়া নষ্ট হওয়া ও মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া। হার্টবিট কমে যায়, চোখ ছোট হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে কতটুকু আর্সেনিক প্রতিদিন গ্রহণ করা হচ্ছে এবং কতদিন গ্রহণ করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে বিষক্রিয়ার ভয়াবহতা। দীর্ঘদিন আর্সেনিকযুক্ত পানি খেলে টিস্যু বা অরগান সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়, স্নায়ুতন্ত্রের কাজে বিঘ্ন ঘটে, রক্ত চলাচল ও শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটে। শরীরে বিশ্রী দাগ পড়ে যায় এবং এ ধরনের রোগাক্রান্ত ছেলেমেয়েকে কেউ বিয়েও করতে চায় না। এ ছাড়া ব্রংকাইটিস, নিউরোপ্যাথি ও গ্যাংরিন হয় এবং বৃক্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এভাবে পুরো জাতি ধ্বংসের মুখে পতিত হতে বাধ্য। বিশেষ করে যে শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের সর্বনাশ হয়। সাধারণত আর্সেনিক বিষক্রিয়ার রোগ দীর্ঘদিন (দুই থেকে পাঁচ বছর) আর্সেনিকযুক্ত (প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি) পানি বা খাবার খেলে হয়। শরীরের ভেতরের সব টিস্যু ও অরগানের অনেক কার্যকারিতা নষ্ট করেই তবে উপসর্গ হাতে, পায়ে ও পিঠে দেখা যায়। তত দিনে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েই যায়। ‘আমাদের হাঁটা-চলাফেরা, বুদ্ধি, চিন্তা, ঘুম, ব্যবহার, যৌন-ক্রিয়া—সবকিছুই মস্তিষ্ক দিয়েই পরিচালিত হয়। পেশির সংকোচন, প্রসারণ ও স্মৃতিশক্তির সঙ্গেও মস্তিষ্ক জড়িত। মস্তিষ্কের এই কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিক দ্রব্য ও তাদের তৈরির এনজাইম। আমরা এ বিষয়ে গবেষণা করে দেখেছি, আর্সেনিক বিষক্রিয়াজনিত রোগীদের রক্তে নিউরোট্রান্সমিটার তৈরির এনজাইমের (যেমন, ডোপামিন বিটা হাইড্রোক্সিলেজ) পরিমাণ ও নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণ কমে যায়। এদের তৈরির কো-ফ্যাক্টর, কো-এনজাইমগুলোর পরিমাণ রক্তে কমে যায়। ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করেও অনুরূপ ফল পাওয়া গেছে। রক্ত ও মস্তিষ্ক উভয় ক্ষেত্রেই এসব প্রাণীর রাসায়নিক প্যারামিটারগুলোর পরিমাণ কমে যায়। আর্সেনিকযুক্ত পানির মাছ ও শাকসবজি খেলেও এরূপ হতে পারে। বোয়াল, রুই, চিতলসহ সব মাছের প্রকৃতি ও স্বাদও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আর্সেনিক বিষক্রিয়ার রোগীদের রক্তে বেশি ওজনের প্রোটিনগুলো (যেমন ১৪৫ কেডি, ১৩৫ কেডি, ২২৫ কেডি) জমে, আবার অল্প ওজনের প্রোটিনগুলো উধাও হয়ে যায়। বড় ধরনের রহস্য এর মাঝেই নিহিত। মস্তিষ্কের প্রোটিন প্রসেসিংয়ের পদ্ধতির ওপর আর্সেনিক আঘাত হানে বলে ধারণা করা যায়। এতে বাচ্চারা অথর্ব, হাবাগোবা ও অসুস্থ হয়ে পড়বে, সন্দেহ নেই। তাদের মেধার ওপর আঘাত হানে, ফলে তারা পড়াশোনাও মনে রাখতে পারবে না। জাতি হবে বিকলাঙ্গ। এ সবকিছুর পরিমাণ হবে ভয়াবহ। জাতিও ধ্বংস হবে, যদি ফারাক্কা সমস্যার সমাধান না করা যায় এবং ভারতকে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প থেকে যদি বিরত রাখা না যায়। যেসব ব্যারাজ তৈরি হয়েছে, সেগুলোর কার্যকারিতা স্থগিত করা উচিত, অথবা দুই দেশের স্বার্থে গ্রহণযোগ্য, বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
সাবেক প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিষ্ঠাতা, নিউরোসায়েন্স রিসার্চ সেন্টার অব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুলহাস যা তৈরি করেছেন, তা মূলত একটি বড় আকারের খেলনা। জুলহাসের এই প্রতিভাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু তাকে নিয়ে আমরা অনেকেই যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি, তা রীতিমতো ভয়ংকর!
১৬ মিনিট আগেএকটি দেশের গণমাধ্যম তার চেতনার দর্পণ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু যখন সেই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয় অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থ, তখন গণমাধ্যম আর স্বাধীন থাকে না, হয়ে ওঠে এক অভিনব উপনিবেশ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কতটা ছিল, সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
১ দিন আগেআমার এই লেখা যেদিন দৈনিক আমার দেশ-এ ছাপা হবে তার আগের দিন অর্থাৎ ১৩ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশে এসে পৌঁছানোর কথা চার দিনের সফরে। আমাদের স্বাধীনতার মাসে ও পবিত্র রমজানে এদেশের বেশিরভাগ মানুষের ধর্মানুভূতির প্রতি সম্মান দেখাতে তিনি নাকি একদিন রোজা রাখবেন বলেও কথা রটেছে।
১ দিন আগেআওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে পরাজিত করে। সে নির্বাচনটি যে পুরোপুরি নিরপেক্ষ ছিল, তা অধিকাংশ জনগণই মনে করে না; কারণ ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনই ছিল পুরোপুরি সুষ্ঠু নির্বাচন। সে নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে, যে সত্য সর্বজনস্বীকৃত।
১ দিন আগে