সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতের আগ্রায় মার্বেল পাথরে নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত একটি সমাধিসৌধ তাজমহল। এটি প্রেমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতীকী স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। এই স্থাপনাটি ঘিরে ভারতে ‘দ্য তাজ স্টোরি’ নামে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র রিলিজ হতে যাচ্ছে। এটিতে অভিনয় করছেন প্রবীণ ভারতীয় অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। তিনি দাবি করেছেন, এই চলচ্চিত্র তাজমহলের পেছনের ‘সত্য’ উন্মোচন করবে।
চলচ্চিত্রটির মূল ধারণা খুব পরিচিত। দাবি করা হচ্ছে, ভারতের সবচেয়ে পরিচিত এ স্থাপনাটি একসময় তেজো মহালয়া নামের একটি হিন্দু মন্দির ছিল। এরপর মোগল সম্রাট শাহজাহান নাকি সেটি ‘দখল’ করেন। এটি নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। কয়েক বছর পরপর তত্ত্বটিকে সামনে নিয়ে আসা হয়।
প্রতিবার আগের তুলনায় আরো জোরালোভাবে হাজির করা হয়। শুধু কল্পকাহিনি হিসেবে নয়, বরং এটিকে উপস্থাপন করা হয় দেশপ্রেমিকদের সত্য উন্মোচনের ঘটনা হিসেবে। বারবার এ বিষয়টি যে সামনে আসছে, তা কোনো ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের কারণে নয়; বরং সামনে আসছে বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে মিথের ব্যবহারের কারণে।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তাজমহল ভারতের সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় স্থাপনা। সাম্প্রতিক সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ সালে এটি ৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন (৬৯ লাখ) দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করেছে।
তাজমহল নির্মাণ মোগল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রামাণ্য অধ্যায়গুলোর একটি। সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মুমতাজ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। এরপর শাহজাহান ১৬৩১ সালে মুমতাজ মহলের স্মৃতি রক্ষায় এই সমাধিসৌধ নির্মাণের নির্দেশ দেন। প্রায় ২০ হাজার কারিগর ও শ্রমিক ২২ বছরে এটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন।
সম্রাটের সরকারি ইতিহাসগ্রন্থ ‘পাদশাহনামা’ এই নির্মাণ প্রকল্পের প্রতিটি ধাপ লিপিবদ্ধ করেছে। স্থপতিদের নাম, মোট ব্যয়, এমনকি জমির দলিলও সেখানে উল্লেখ আছে। জমিটি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজস্থান রাজ্যের আম্বরের রাজা জয় সিংহের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল।
শিলালিপিতে উল্লেখ আছে, মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা নির্মাণের প্রধান স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ আহমদ লাহৌরি এবং ক্যালিগ্রাফির কাজ করেছিলেন আমানত খান শিরাজি।
ফারসি, সংস্কৃত কিংবা ঔপনিবেশিক যুগের কোনো নথিতে তেজো মহালয়া নামে কোনো মন্দিরের উল্লেখ নেই। স্থাপনাটির নকশায় ফারসি, তিমুরীয় ও ভারতীয় শৈলীর মিশ্রণ রয়েছে। এই সমন্বয়ই মোগল স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য। এটি অনুকরণ নয়, বরং সৃজনশীল সংমিশ্রণ।
তাজমহল আগে মন্দির ছিল বলে যে তত্ত্বটি চালু আছে, তা প্রথম উত্থাপন করেন পুরুষোত্তম নাগেশ ওক (পিএন ওক), যিনি নিজেকে পুনর্বিবেচনামূলক ইতিহাসবিদ বা রিভিশনিস্ট হিস্টোরিয়ান বলে পরিচয় দিতেন। তার আশির দশকের বই ‘তাজ মহল: দ্য ট্রু স্টোরি’ কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করে, শাহজাহান নাকি একটি শিব মন্দিরকে রূপান্তর করে তাজমহল বানিয়েছিলেন।
ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগও এই দাবিকে ‘অনির্ভরযোগ্য কল্পকাহিনি’ হিসেবে বাতিল করে দিয়েছে এবং কোনো পিয়ার-রিভিউড গবেষণা এই তত্ত্বকে সমর্থন করেনি।
তবুও ওকের এই তত্ত্বটি টিকে আছে—এ কারণে নয় যে, এটি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরে; বরং এ কারণে টিকে আছে যে, এই তত্ত্বের মাধ্যমে কিছু লোকের মানসিক চাহিদা পূরণ হয়। এটা এমন এক কাহিনি, যেখানে ভারতের মুসলিম শাসকদের হিন্দু গৌরব ছিনতাইকারী হিসেবে দেখানো যায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আমলে এ ধরনের ভুয়া ইতিহাস প্রান্তিক অবস্থান থেকে একেবারে মূলধারায় চলে এসেছে। স্কুলের পাঠ্যবই থেকেও মোগল শাসনামলের ওপর লেখা অধ্যায়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। ইসলামি নামযুক্ত শহরগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে এবং সরকারি কর্তাব্যক্তিরা প্রকাশ্যে ভারতীয় সভ্যতায় মুসলিম অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
সিনেমা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন বিকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে গেছে। তবে এখানে প্রমাণের চেয়ে আবেগেই বেশি গুরুত্ব পায়।
এই যখন অবস্থা, তখন ‘দ্য তাজ স্টোরি’কে সাধারণ কোনো চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এটি একটি আদর্শিক অস্ত্র। ভুল প্রমাণিত একটি দাবিকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করার পেছনে একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক প্রকল্প রয়েছে, যেখানে ভারতের অতীতকে একটি নিরবচ্ছিন্ন হিন্দু ইতিহাস হিসেবে দেখানো হয়, যা নাকি মুসলিম শাসনের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
এ ধরনের তৎপরতার প্রভাব দ্বিমুখী। এটি ক্ষোভ উসকে দেয় এবং বর্জনকে বৈধতা দেয়। এসব সিনেমার মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। একদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উসকে দেওয়া যায়, অন্যদিকে মুসলমানদের ভারতে বহিরাগত হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
তাজমহলকে তেজো মহালয়া হিসেবে উল্লেখ করে পিটিশন করা হয়েছে। এমনকি এগুলো ভারতের আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালতে প্রতিটি আবেদনই খারিজ হয়েছে, কিন্তু তারপরও প্রতিবার পিটিশনের সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন করে ক্ষোভ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আদালত কী রায় দেয়, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভুয়া তত্ত্বটির প্রচারই আসল উদ্দেশ্য, যাতে বারবার এই মিথটিকে সামনে এনে কল্পকাহিনি জীবন্ত রাখা যায়, আর সত্যকে ভুলিয়ে দেওয়া যায়।
তাজমহলের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে নতুন পরিচয় দেওয়া একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। ইসলামি স্থাপত্যকে ‘বিদেশি’ এবং হিন্দু প্রতীকগুলোকে ‘জাতীয়’ হিসেবে উপস্থাপন করা মূলত বিজেপির ন্যারেটিভের অংশ। এর ফলে বিচিত্র ইতিহাসকে মাত্র দুটি ভাগে ভাগ করা হয়—স্বদেশি ইতিহাস বনাম আক্রমণকারী মুসলিমদের ইতিহাস। এতে ভারতের ২০ কোটির বেশি মুসলমানকে বহিরাগত হিসেবে দেখানো যায়। অথচ এই দেশ নির্মাণে মুসলমানদের ব্যাপক অবদান রয়েছে।
এসব কর্মকাণ্ডে বিজেপির খুব নগদ লাভ হয়। যে মিথ আগে অখ্যাত সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা মূলধারায় ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে বিজেপি মুসলমান বনাম হিন্দু বিভাজন তৈরি করে ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা হাসিল করে আসছে।
অর্থাৎ ইতিহাসের পুনর্লিখন কখনো শুধু একাডেমিক কাজ নয়। এটি বর্তমান সময়ের রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। যখন সরকারি ন্যারেটিভ প্রামাণ্য ইতিহাসের চেয়ে মিথকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তখন তা দৈনন্দিন জীবনে বৈষম্যের বৈধতা তৈরি করে।
তাজমহল ঘিরে বিতর্কটি প্রতীকী মনে হতে পারে; কিন্তু আসলে তা নয়। এর মাধ্যমে ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেখানে তথ্য-প্রমাণের দরকার নেই, বিশ্বাসই যথেষ্ট। কিন্তু এটি সত্যের গভীরতর পরিবর্তনকে প্রকাশ করে—যাচাইযোগ্য বিষয় থেকে বিশ্বাসযোগ্য বিষয়ে রূপান্তর করে।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব বলেছিলেন, ‘ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে যদি সত্যের চেয়ে বিশ্বাস বেশি গুরুত্ব পায়, তখন ইতিহাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
সমসাময়িক ভারতে সেই ক্ষতি শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি নাগরিকত্ব, অধিকারবোধ এমনকি পরিচয় পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করে। উপমহাদেশ যে একসময় বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে বিকশিত হয়েছিল, তাজমহল এখনো তার প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
তাজমহলের ঐতিহাসিক সত্য রক্ষা করা শুধু একটি স্থাপনার ইতিহাস রক্ষার প্রশ্ন নয়, এটি ভারতের ইতিহাস রক্ষারও প্রশ্ন। কারণ যখন ক্ষমতা ঠিক করে দেয় ইতিহাস কী হবে, তখন সত্য ও বিকৃতির মধ্যকার সীমারেখা অদৃশ্য হয়ে যায়।
টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা


ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কেন মাধবদী