Ad

এর পরে কী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯: ৪৬

৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে যা ঘটেছে, সেটা হয়তো অনেকেই বা হতে পারে কেউই আশঙ্কা কিংবা আশা করতে পারেননি। তবে যে ধরনের ফ্যাসিবাদী নিষ্পেষণ দেশে কায়েম হয়েছিল এবং ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছিল, তার শেষ যে একভাবে না একভাবে ঘটবে- সেটা সুবিধাভোগী অল্পকিছু মানুষ ছাড়া বাদবাকিরা আশা করেছিলেন। অসন্তোষ ও ক্ষোভ দুটোই বাড়ছিল এবং সরকার ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। সরকারি মুখপাত্ররা যেভাবে গলা উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছিলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছিল তাদের ভেতরটা খালি হয়ে এসেছে। মুখে যতই চিৎকার করে জানাচ্ছিলেন তারা ভয় পাওয়ার পাত্র নন, দেশ ছেড়ে পালাবেন- এমন কাপুরুষ নন, ততই টের পাওয়া যাচ্ছিল যে তারা ভয় পেয়েছেন।

ঘটনাটা ঘটাল ছাত্ররা। এই তরুণরাই অতীতে বড় বড় ঘটনা ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তারাই ছিল সংগঠক; এমনকি তার আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তাদেরকেই দেখা গেছে সামনের সারিতে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররা সামনে না থাকলে বিজয় সম্ভব হতো না। মুক্তিযুদ্ধেও তরুণরাই ছিল প্রধান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনও তারাই শুরু করেছিল। শেখ হাসিনার পতনও তরুণদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটল।

কিন্তু আসলে ঘটেছেটা কী? সেটার বিবেচনা খুবই জরুরি। কেউ বলছেন আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলাম। কারো কারো ধারণা আরও অগ্রসর। তারা বলছেন দেশে একটা বিপ্লবই ঘটে গেছে। বাস্তবে কিন্তু দুটির কোনোটাই ঘটেনি। যেটা ঘটেছে, তা হলো নৃশংস একটি সরকারের পতন। এ দেশে মানুষ অনেক রকমের সরকার দেখেছে; ব্রিটিশ সরকার আলাদা, সেটা ছিল বিদেশি, পাকিস্তানি শাসকরাও বিদেশিই ছিল; কিন্তু পতিত সরকারটির মতো স্বদেশি সরকার আগে কেউ কখনো দেখেনি। আমাদের দুর্ভাগ্য কোনো সরকারই জনগণের পক্ষে ছিল না, সব সরকারই ছিল জনবিরোধী। শাসকরা নানাভাবে শোষণ করেছে, যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কিন্তু যে সরকারকে জনগণ এবার বিতাড়িত করল, সেই সরকারের মতো নিষ্ঠুর ও বধির সরকার আর দেখা যায়নি। এই সরকার কোনো আইনকানুন মানেনি, নিষ্পেষণের জন্য নতুন নতুন আইন ও বিধি জারি করেছে, গুম করেছে, হামলা ও মামলা দিয়ে হয়রানির একশেষ ঘটিয়েছে এবং কতটা যে নির্মম হতে পারে, তার প্রমাণ দিয়েছে পতনের আগের কয়েকটি দিনে। নিহতের সংখ্যা হাজারের ওপর। আর আহত মানুষের সংখ্যা তো বেশুমার। তালিকা পাওয়া গেছে নিহত ৬৫ জন শিশু-কিশোরের; তালিকার বাইরে কত শিশু শেষ হয়ে গেছে কে জানে। নিহত ও আহতদেরও অধিকাংশই তরুণ। ইহুদিবাদী ইসরাইলিরা গাজাকে শৈশবশূন্য করেছে, হাসিনা সরকারও মনে হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে তারুণ্য মুছে ফেলবে, যা আগে কখনো ঘটেনি, তা হলো হেলিকপ্টার থেকে বোমা ও গুলিবর্ষণ। এবার সেটাও ঘটল। মানুষ মারার কোনো কায়দাই বাদ রইল না এবং পরিণতি দাঁড়াল চূড়ান্ত রকমের ফ্যাসিবাদী ওই সরকারের পতন।

সরকার পরিবর্তনটা শান্তিপূর্ণভাবেই ঘটতে পারত, যদি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হতো। কিন্তু সরকার তাতে সম্মত ছিল না। নির্বাচনের নামে একের পর এক প্রহসন ঘটিয়ে টিকে থাকার আয়োজন করেছে। ফলে পতন শেষ পর্যন্ত ঘটল; তবে সহিংস উপায়ে। তাতে বহু মানুষ হতাহত হলো, সম্পদ ও স্থাপনা নষ্ট হলো। পুলিশ আগেই জনবিচ্ছিন্ন ছিল। এবার তাদের যে ভূমিকায় নামানো হলো, তাতে তাদের ভাবমূর্তি দাঁড়াল জনশত্রুতে। থানা আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ সদস্যরাও হতাহত হয়েছে, পুলিশ বাহিনীর পক্ষে জনসমক্ষে হাজির হওয়া হয়ে পড়েছিল রীতিমতো বিপজ্জনক।

পতনে পরিবর্তন অবশ্যই ঘটেছে। পুরোনোরা বিদায় নিয়েছে, নতুন মানুষ এসেছে সামনে। একটি দৈনিক পত্রিকা কৌতুকভরে সংবাদ শিরোনাম করেছে, ‘খালেদা জিয়া জেল খেটে মুক্ত হলেন, শেখ হাসিনা জেল খাটিয়ে দেশ ছেড়ে পালালেন’। কথাটা তো মিথ্যা নয়। বুর্জোয়াদের রাজনীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিহিংসার রূপ নেয়; চরম অধঃপতন ঘটলে সে রাজনীতির দশাটা কী দাঁড়ায়, তার নিদর্শন বাংলাদেশে পাওয়া গেলো বৈকি! কিন্তু ওই পর্যন্তই। একের পতনে অপরের উত্থান। পরিবর্তন ঘটবে না বলে ক্ষমতাসীনরা দম্ভ করেছিলেন; সে দম্ভ মিথ্যায় পরিণত হয়েছে। তারা পতিত হয়েছে, তাদের পক্ষে ‘থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়’ দশা দাঁড়িয়েছে। তারা পলায়নে তৎপর হয়েছে; না পারলে লুকিয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টায় অস্থির না হয়ে পারেনি; পানি শুকালে মাছের যেমন অবস্থা!

কিন্তু পরিবর্তনটা কী শুধুই একটি সরকারের পতন এবং নতুন একটি সরকারের আগমন? মনে হবে তার চেয়ে অনেক অনেক বড় একটা কিছু। তার প্রধান কারণ মানুষের প্রাণপণ প্রতিরোধ এবং সরকারের দিক থেকে ধ্বংসের তাণ্ডব। এর বাইরে আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলাম, অথবা একটি বিপ্লব ঘটে গেছে, এটা ধারণা করা যতটা আশার ব্যাপার, ততটা বাস্তবিক সত্য নয়। স্বাধীন তো আমরা আগেও হয়েছি, একবার নয়, দু-দুবার। প্রথমে হই সাতচল্লিশে। ‘স্বাধীন’ হবার পরপরই টের পাই পড়ে গেছি পরাধীনতার নতুন ফাঁদে। সে জন্য আবার আমাদের যেতে হলো আন্দোলনে, মুখোমুখি হতে হলো ইতিহাসের নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যার, নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধ করতে হলো সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে। একাত্তরে সে পথেই আমরা আবার স্বাধীন হলাম। সেটাই তো ছিল আমাদের দ্বিতীয় ও প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু যা কাঙ্ক্ষিত ছিল, সেটা হলো মুক্তি। আসলে মুক্তির জন্যই লড়ছিলাম আমরা। পাকিস্তান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতাই নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিরও। আর একাত্তরের যুদ্ধকে তো আমরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বলেই জানি।

না, সে মুক্তি পাকিস্তান দেয়নি, বাংলাদেশও দেয়নি। বাংলাদেশের তেপ্পান্ন বছরের ইতিহাস মুক্তির স্বপ্ন থেকে ধারাবাহিকভাবে পিছু হটার ইতিহাস। কিন্তু এমনটা কেন ঘটল? ব্রিটিশ শাসকরা প্রায় ২০০ বছর ধরে আমাদের শোষণ করেছে, পাচার করেছে আমাদের সম্পদ। যখন তারা আসে, তখন ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ হয়, দুর্ভিক্ষ তারাই বাধায়। ওই দুর্ভিক্ষে তখনকার বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিদায় নেওয়ার সময়ও তারা একটা দুর্ভিক্ষ বাধিয়ে ছিল, যাতে ৩৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। পাকিস্তানি শাসকরাও একই ধারায় শোষণের জন্য শাসন চালায় এবং আমাদের সম্পদ নিংড়ে নিয়ে যেতে থাকে। রুখে দাঁড়ানোতে তারা গণহত্যা চালায়। প্রাণ যায় ৩০ লাখ মানুষের, সম্ভ্রমহানি ঘটে কমপক্ষে তিন লাখ নারীর। ওইসব বিদেশি শয়তানদের আমরা তাড়িয়েছি।

কিন্তু মুক্তি পেয়েছি কি? স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হয়। সেই দুর্ভিক্ষ নিয়ে আলোচনা করেছেন একজন গবেষক। তার বইতে তিনি বলছেন, দুর্ভিক্ষে মৃত্যু ঘটেছে ১০ লাখ মানুষের।

স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে কতজনের যে প্রাণহানি ঘটেছে, তার হিসাব আমরা জানি না এবং যে ধরনের নৃশংসতায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একাংশ, তা তুলনাবিরহিত। এরপর সেনা শাসন আসে; প্রথমে জিয়ার, পরে এরশাদের। হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকে। লক্ষ্যবস্তু ছিলেন মূলত বামপন্থিরা; কারণ মুক্তির জন্য আন্দোলনটা তারাই করে থাকে। শেখ হাসিনার শাসনকালে পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে যেভাবে মানুষ গুম হয়েছে, তার তুলনা তো আমাদের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। নির্যাতনের অভিনব সব পন্থা উদ্ভাবন করা হয়েছিল। যারা ফেরত আসতে পেরেছেন, তারাও সাহস পাননি মুখ খুলতে। তুলে নিয়ে যাওয়া একজন বিএনপি নেতা নিজেকে আবিষ্কার করেছেন সীমান্তের অপর পাড়ে, কেমন করে গেলেন তিনি স্মরণ করতে পারেননি। হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়নের আগের দিন কটিতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যেভাবে নির্বিচারে ও দ্রুততায় মানুষকে হত্যা ও জখম করা হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। জনতার যে ঢল কার্ফ্যু ভেঙে এগিয়ে আসছিল, সেনাবাহিনী যদি তাকে প্রতিহত করতে সম্মত হতো, তাহলে ব্যাপক গণহত্যা ঘটত। এতে রক্তের স্রোত যে কী ধারায় প্রবাহিত হতো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করেছেন এবং সেনাবাহিনীর সংরক্ষণে নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তাতে তার নিজের জন্য তো বটেই, দেশের মানুষের জন্যও বড় একটা বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তার নিকটজনদের অন্তিম পরামর্শটি যে সদ্বুদ্ধিজাত ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

আসল কাজটা অবশ্য তরুণরাই করেছে। ৫২ এবং ৬৯-এর মতো এবারও। তরুণদের বয়স অল্প, তবে তারুণ্য যে বয়সনির্ভর- এমনটা বলা যাবে না। তরুণরাও দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে যেতে পারে যদি তারুণ্য হারায়, আবার বৃদ্ধরাও তরুণ থাকতে পারেন যদি ভেতরে তারুণ্য থাকে। তারুণ্যের গুণ বিদ্রোহ, উদ্দীপনা ও সৃষ্টিশীলতা, যা এবারকার আন্দোলনে বিশেষভাবে দেখা গেছে। এতে তরুণদের সঙ্গে অন্য মানুষও যুক্ত হয়েছে, সেসব মানুষ যাদের মধ্যে তারুণ্য টগবগ করছিল। তারা নানা পেশার, নানা বয়সের। অধিকাংশই অবশ্য অল্প বয়সি। তারা সবাই ছুটে এসেছেন এবং ফ্যাসিবাদী একটি দুঃশাসনকে পরাভূত করেছেন- গোপনে নয়, ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে নয়, প্রকাশ্য রাজপথে, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে, সমাবেশে ও মিছিলে সমবেত হয়ে।

আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল সাদামাটাভাবেই এবং ন্যায্য একটা দাবি নিয়ে; সেটা হলো সরকারি চাকরিতে কিছু গোষ্ঠীর জন্য বড় একটা ভাগ সংরক্ষিত রাখার বিদ্যমান বন্দোবস্তের পরিবর্তনের। সংরক্ষিত ভাগটা কেবল বড় নয়, ছিল খুব বড়, শতকরা ৫৬। এতে বাদবাকি চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছিলেন। সমস্যাটা ছিল মূলত শিক্ষার্থীদের জন্যই; শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে যারা চাকরির সন্ধানে নামবেন, বিশেষভাবে তাদের জন্য। শতকরা ৫৬টি চাকরি যদি নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠীই নিয়ে নেয়, তাহলে অন্যদের জন্য পাওয়ার সুযোগ আর কতটা থাকে!

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

আমার দেশ
ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত