এলাহী নেওয়াজ খান
সময়টা ১৯৮১ সালের মে মাস। আমি তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘দৈনিক দেশে’ জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছিলাম। সেদিনটি ছিল সম্ভবত ৩ মে ১৯৮১। দুপুরের দিকে আমি এবং সিনিয়র সাংবাদিক কাজী মন্টু দুজনে মিলে রাজারবাগের শফিকুল গনি স্বপন ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। স্বপন ভাই হচ্ছেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বড় ছেলে। প্রায়ই ওই বাসায় ভালো আড্ডা হতো। কারণ স্বপন ভাই ছিলেন দারুণ আড্ডাবাজ। তাই আমরা প্রায়ই ওখানে যেতাম।
সে যাই হোক মূল কথায় আসি। আমরা কথা বলতে বলতে সেখানে আকস্মিক উপস্থিত হলেন জিয়া ক্যাবিনেটের সবচেয়ে জুনিয়র মন্ত্রী নূর মুহাম্মদ খান। তখন তিনি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী। সবার কাছে তিনি খান ভাই হিসেবেই অধিক পরিচিত। পরে তিনি এরশাদের মন্ত্রী হয়েছিলেন। বর্তমানে বিএনপি নেতা। সেদিন তিনি অফিস থেকে সরাসরি এ বাসায় এসেছিলেন। চেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) আজ আমাকে বলেছেন, কি খান সাহেব, হাসিনা আসছে বলে কি ভয় পাচ্ছেন? এটা শুনে আমরা কিছুটা অবাকই হলাম। মনে হলো তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ভয় পাচ্ছেন!
এ ঘটনার ১৫ দিন পর অর্থাৎ ১৯ মে শেখ হাসিনা ভারতে স্বনির্বাসিত জীবনযাপন থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ঠিক এর ১১ দিনের মাথায় ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিদ্রোহী সৈনিকের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শহীদ হন। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ। জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পরপর শেখ হাসিনা আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আবার ভারতে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা তাকে আটকে দেন। তাকে ভারত যেতে দেওয়া হয়নি।
পরের ঘটনাবলি আরেক ইতিহাস। এই ইতিহাসের মূল কুশীলব হচ্ছেন ভারতের দেরাদুন প্রশিক্ষিত তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। তিনি কালক্ষেপণ না করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ করানোর কাজটি সম্পন্ন করাসহ সামরিক আদালতে বিদ্রোহী ঘাতকদের বিচার এবং দ্রুততম সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সহায়তা করে জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। এরপরই জেনারেল এরশাদের দেরাদুন খেলা শরু হয়। তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আস্থায় নিয়ে ৮২ সালের ২৪ মার্চ দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করে বসেন। এখানে বলে রাখা দরকার, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রশিক্ষণের জন্য এরশাদকে পাঠাতে চেয়েছিলেন ব্রিটেনের অভিজাত মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে। কিন্তু এরশাদ ভারতের মিলিটারি একাডেমি দেরাদুনকেই বেছে নেন।
যাই হোক, একটু ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে দেখুন- বিপুল ভোটে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টকে তার নির্বাচিত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় একটা ঠুনকো অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনাটা ছিল সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ, যা এখন পর্যন্ত প্রবহমান। সে সময় যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসা থেকে ইমদু নামে একজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেনারেল এরশাদ এ বিষয়টিকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করেন। আসলে এরশাদ অনেক আগে থেকেই ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে আসছিলেন। আর সেটা কতটা পরিকল্পিত ছিল, তা বোঝা যায় ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগের সুমধুর সম্ভাষণ দেখে। সামরিক শাসনের নিন্দা না জানিয়ে আওয়ামী লীগের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত ‘দৈনিক বাংলারবাণী’র হেডলাইন ছিল এভাবে- ‘একফোঁটাও রক্ত ঝরেনি’। আর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’। ফলে তখন অনেকেই মনে করতে থাকেন, এরশাদ ও শেখ হাসিনার মধ্যে কোনো গোপন সমঝোতার মধ্য দিয়ে ৮২-এর সামরিক অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছিল।
১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সময় সেই সমঝোতার বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। ওই নির্বাচন বিএনপি বয়কট করলেও আওয়ামী লীগ তাতে অংশগ্রহণ করে। কারণ এর মূল লক্ষ্য ছিল এরশাদকে বৈধতা দেওয়া। আর সে সময় থেকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যকার সম্পর্ক কতটা গভীরে প্রথিত ছিল, তা বোঝা যায় ৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। তখন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও সরকার গঠন করতে পারছিল না। কারণ সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ১৫১ আসন। আর আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন পেয়ে ধুঁকছিল। ঠিক সে সময় এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলের দলীয় জোট ও জামায়াতে ইসলামীর সমন্বয়ে পরিচালিত ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করলেও ৯৬-এর ওই নির্বাচনে ১১৬ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন লাভ করলেও বিএনপির সরকার গঠনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কারণ জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত ৩২ আসন এবং ইসলামী ঐক্যজোটের একজন, জাসদের (রব) একজন ও স্বতন্ত্র একজন অর্থাৎ নির্বাচিত এই তিনজন এমপির সমর্থন পেলেই বিএনপি সরকার গঠন করতে পারত। জামায়াত তিনটি আসন লাভ করলেও আওয়ামী লীগের সহযোগী আন্দোলনকারী হওয়ায় হিসাবে রাখা হয়নি।
এ রকম একটা সংখ্যার হিসাব-নিকাশ নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। তখন ঘটনাপ্রবাহ আরও জটিল হয়ে উঠেছিল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এইচ এম এরশাদের কারাবাসের কারণে। এ রকম পরিস্থিতিতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আমাকে জানালেন, জেনারেল এরশাদ বিএনপিকে সরকার গঠন করতে লিখিত সমর্থন দিয়েছে। এই গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে আমার তখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই আমরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, বিএনপিই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আরও যে খবর বদ্ধমূল করে দিয়েছিল তা হচ্ছে, ওই তিন এমপির সমর্থন।
তখন দ্রুত সময় বয়ে যাচ্ছিল। বিএনপির দিক থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটায় ঐতিহাসিক সম্পর্কের জের ধরে অতিদ্রুত আওয়ামী লীগ এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এরশাদ আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়ে দেন এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
আরেকটু পেছনে ফিরে ৮৬ সালের নির্বাচনের পটভূমি পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সম্পর্কের গভীরতা। ওই সময় প্রেসিডেন্ট এরশাদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে এই মর্মে হুমকি দেন- রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না এলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরশাদের হুমকির এক দিন কিংবা দুদিন আগে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছিলেন, ‘যারা নির্বাচনে যাবে, তারা জাতীয় বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হবে।’ কিন্তু এরশাদের ভাষণের পরের দিন তিনি এবং তার ১৫-দলীয় জোট সবার আগে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ‘আমরা সিনিয়র-জুনিয়র রিপোর্টার সবাই দলবেঁধে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম ১৫ দলের সেই সভার রিপোর্ট করার জন্য। শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি তখন হয়ে উঠেছিল একজন মিলিটারি একনায়ককে বৈধতা প্রদানের উৎসব কেন্দ্রে। আমরা বন্ধ জানালায় কান পেতে শুনছিলাম নির্বাচনে যাওয়ার কথাগুলো।’ হঠাৎ শুনলাম এক সময়ের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড তোয়াহা ভাই জোর গলায় বলছেন, এখনই নির্বাচনে যেতে হবে মা হাসিনা। তোয়াহা ভাইয়ের মায়ের নাম হাসিনা বানু। সে কারণে তিনি শেখ হাসিনা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। যাই হোক, অবশেষে ১৫-দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। মূলত, এটা ছিল এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের নীলনকশার ধারাবাহিকতা। এখন পাঠক বলুন, পাকিস্তান আমলে এক সময় যে ৩২ নম্বর ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হয়ে গেল নিষ্ঠুর নিপীড়নমূলক একদলীয় শাসনের কেন্দ্র। আবার ৮৬ সালে সেই ৩২ নম্বর পরিণত হয় সামরিক একনায়ক শাসকের সহযোগীদের বৈঠকখানায়।
অন্যদিকে সেদিন বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলের বৈঠক চলছিল ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বাড়িতে। আমরা ১৫ দলের সিদ্ধান্ত শুনে ওখানে উপস্থিত হলাম। আমরা ছিলাম তিনজন। বাকি দুজন হলেন, বিখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ও আবদুর রহিম। তখন গিয়াস ভাই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় এবং আব্দুর রহিম ভাই ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এ নিউজ এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা আজ আমাদের মাঝে নেই। যা হোক, আমরা ওখানে যাওয়ার পর সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি বলে ফেললাম, ১৫ দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সাত দলের নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) প্রশ্ন করে বললেন, কেন ঠিক হবে না? উত্তরটা বুঝি আমার মুখে লেগেই ছিল। আমি বলে উঠলাম ম্যাডাম, এটা হবে একটি নীলনকশার নির্বাচন। আওয়ামী লীগ হবে প্রধান বিরোধী দল, বিএনপি তৃতীয়। গিয়াস ভাই ও রহিম ভাই আমাকে সমর্থন জানালেন। পরে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে একটা মজার বিষয় ঘটে গেছে। সেটা হলো- যে আওয়ামী লীগ সব সময় বিএনপিকে সামরিক আইনের প্রডাক্ট বলে সমালোচনা করত, সেই আওয়ামী লীগ এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্রকে বৈধতা দিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল আর বিএনপি গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে এরশাদের পাতানো নির্বাচন বয়কট করল।
তারপর থেকে রাতের ভোট, বিনাভোটসহ সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দিয়ে আসছে জাতীয় পার্টি। এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভারত, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পরিপূরক শক্তি।
সময়টা ১৯৮১ সালের মে মাস। আমি তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘দৈনিক দেশে’ জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছিলাম। সেদিনটি ছিল সম্ভবত ৩ মে ১৯৮১। দুপুরের দিকে আমি এবং সিনিয়র সাংবাদিক কাজী মন্টু দুজনে মিলে রাজারবাগের শফিকুল গনি স্বপন ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। স্বপন ভাই হচ্ছেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বড় ছেলে। প্রায়ই ওই বাসায় ভালো আড্ডা হতো। কারণ স্বপন ভাই ছিলেন দারুণ আড্ডাবাজ। তাই আমরা প্রায়ই ওখানে যেতাম।
সে যাই হোক মূল কথায় আসি। আমরা কথা বলতে বলতে সেখানে আকস্মিক উপস্থিত হলেন জিয়া ক্যাবিনেটের সবচেয়ে জুনিয়র মন্ত্রী নূর মুহাম্মদ খান। তখন তিনি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী। সবার কাছে তিনি খান ভাই হিসেবেই অধিক পরিচিত। পরে তিনি এরশাদের মন্ত্রী হয়েছিলেন। বর্তমানে বিএনপি নেতা। সেদিন তিনি অফিস থেকে সরাসরি এ বাসায় এসেছিলেন। চেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) আজ আমাকে বলেছেন, কি খান সাহেব, হাসিনা আসছে বলে কি ভয় পাচ্ছেন? এটা শুনে আমরা কিছুটা অবাকই হলাম। মনে হলো তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ভয় পাচ্ছেন!
এ ঘটনার ১৫ দিন পর অর্থাৎ ১৯ মে শেখ হাসিনা ভারতে স্বনির্বাসিত জীবনযাপন থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ঠিক এর ১১ দিনের মাথায় ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিদ্রোহী সৈনিকের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শহীদ হন। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ। জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পরপর শেখ হাসিনা আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আবার ভারতে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা তাকে আটকে দেন। তাকে ভারত যেতে দেওয়া হয়নি।
পরের ঘটনাবলি আরেক ইতিহাস। এই ইতিহাসের মূল কুশীলব হচ্ছেন ভারতের দেরাদুন প্রশিক্ষিত তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। তিনি কালক্ষেপণ না করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ করানোর কাজটি সম্পন্ন করাসহ সামরিক আদালতে বিদ্রোহী ঘাতকদের বিচার এবং দ্রুততম সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সহায়তা করে জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। এরপরই জেনারেল এরশাদের দেরাদুন খেলা শরু হয়। তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আস্থায় নিয়ে ৮২ সালের ২৪ মার্চ দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করে বসেন। এখানে বলে রাখা দরকার, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রশিক্ষণের জন্য এরশাদকে পাঠাতে চেয়েছিলেন ব্রিটেনের অভিজাত মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে। কিন্তু এরশাদ ভারতের মিলিটারি একাডেমি দেরাদুনকেই বেছে নেন।
যাই হোক, একটু ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে দেখুন- বিপুল ভোটে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টকে তার নির্বাচিত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় একটা ঠুনকো অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনাটা ছিল সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ, যা এখন পর্যন্ত প্রবহমান। সে সময় যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসা থেকে ইমদু নামে একজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেনারেল এরশাদ এ বিষয়টিকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করেন। আসলে এরশাদ অনেক আগে থেকেই ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে আসছিলেন। আর সেটা কতটা পরিকল্পিত ছিল, তা বোঝা যায় ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগের সুমধুর সম্ভাষণ দেখে। সামরিক শাসনের নিন্দা না জানিয়ে আওয়ামী লীগের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত ‘দৈনিক বাংলারবাণী’র হেডলাইন ছিল এভাবে- ‘একফোঁটাও রক্ত ঝরেনি’। আর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’। ফলে তখন অনেকেই মনে করতে থাকেন, এরশাদ ও শেখ হাসিনার মধ্যে কোনো গোপন সমঝোতার মধ্য দিয়ে ৮২-এর সামরিক অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছিল।
১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সময় সেই সমঝোতার বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। ওই নির্বাচন বিএনপি বয়কট করলেও আওয়ামী লীগ তাতে অংশগ্রহণ করে। কারণ এর মূল লক্ষ্য ছিল এরশাদকে বৈধতা দেওয়া। আর সে সময় থেকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যকার সম্পর্ক কতটা গভীরে প্রথিত ছিল, তা বোঝা যায় ৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। তখন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও সরকার গঠন করতে পারছিল না। কারণ সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ১৫১ আসন। আর আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন পেয়ে ধুঁকছিল। ঠিক সে সময় এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলের দলীয় জোট ও জামায়াতে ইসলামীর সমন্বয়ে পরিচালিত ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করলেও ৯৬-এর ওই নির্বাচনে ১১৬ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন লাভ করলেও বিএনপির সরকার গঠনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কারণ জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত ৩২ আসন এবং ইসলামী ঐক্যজোটের একজন, জাসদের (রব) একজন ও স্বতন্ত্র একজন অর্থাৎ নির্বাচিত এই তিনজন এমপির সমর্থন পেলেই বিএনপি সরকার গঠন করতে পারত। জামায়াত তিনটি আসন লাভ করলেও আওয়ামী লীগের সহযোগী আন্দোলনকারী হওয়ায় হিসাবে রাখা হয়নি।
এ রকম একটা সংখ্যার হিসাব-নিকাশ নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। তখন ঘটনাপ্রবাহ আরও জটিল হয়ে উঠেছিল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এইচ এম এরশাদের কারাবাসের কারণে। এ রকম পরিস্থিতিতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আমাকে জানালেন, জেনারেল এরশাদ বিএনপিকে সরকার গঠন করতে লিখিত সমর্থন দিয়েছে। এই গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে আমার তখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই আমরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, বিএনপিই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আরও যে খবর বদ্ধমূল করে দিয়েছিল তা হচ্ছে, ওই তিন এমপির সমর্থন।
তখন দ্রুত সময় বয়ে যাচ্ছিল। বিএনপির দিক থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটায় ঐতিহাসিক সম্পর্কের জের ধরে অতিদ্রুত আওয়ামী লীগ এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এরশাদ আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়ে দেন এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
আরেকটু পেছনে ফিরে ৮৬ সালের নির্বাচনের পটভূমি পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সম্পর্কের গভীরতা। ওই সময় প্রেসিডেন্ট এরশাদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে এই মর্মে হুমকি দেন- রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না এলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরশাদের হুমকির এক দিন কিংবা দুদিন আগে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছিলেন, ‘যারা নির্বাচনে যাবে, তারা জাতীয় বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হবে।’ কিন্তু এরশাদের ভাষণের পরের দিন তিনি এবং তার ১৫-দলীয় জোট সবার আগে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ‘আমরা সিনিয়র-জুনিয়র রিপোর্টার সবাই দলবেঁধে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম ১৫ দলের সেই সভার রিপোর্ট করার জন্য। শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাড়িটি তখন হয়ে উঠেছিল একজন মিলিটারি একনায়ককে বৈধতা প্রদানের উৎসব কেন্দ্রে। আমরা বন্ধ জানালায় কান পেতে শুনছিলাম নির্বাচনে যাওয়ার কথাগুলো।’ হঠাৎ শুনলাম এক সময়ের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড তোয়াহা ভাই জোর গলায় বলছেন, এখনই নির্বাচনে যেতে হবে মা হাসিনা। তোয়াহা ভাইয়ের মায়ের নাম হাসিনা বানু। সে কারণে তিনি শেখ হাসিনা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। যাই হোক, অবশেষে ১৫-দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। মূলত, এটা ছিল এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের নীলনকশার ধারাবাহিকতা। এখন পাঠক বলুন, পাকিস্তান আমলে এক সময় যে ৩২ নম্বর ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হয়ে গেল নিষ্ঠুর নিপীড়নমূলক একদলীয় শাসনের কেন্দ্র। আবার ৮৬ সালে সেই ৩২ নম্বর পরিণত হয় সামরিক একনায়ক শাসকের সহযোগীদের বৈঠকখানায়।
অন্যদিকে সেদিন বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলের বৈঠক চলছিল ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বাড়িতে। আমরা ১৫ দলের সিদ্ধান্ত শুনে ওখানে উপস্থিত হলাম। আমরা ছিলাম তিনজন। বাকি দুজন হলেন, বিখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ও আবদুর রহিম। তখন গিয়াস ভাই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় এবং আব্দুর রহিম ভাই ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এ নিউজ এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা আজ আমাদের মাঝে নেই। যা হোক, আমরা ওখানে যাওয়ার পর সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি বলে ফেললাম, ১৫ দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সাত দলের নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) প্রশ্ন করে বললেন, কেন ঠিক হবে না? উত্তরটা বুঝি আমার মুখে লেগেই ছিল। আমি বলে উঠলাম ম্যাডাম, এটা হবে একটি নীলনকশার নির্বাচন। আওয়ামী লীগ হবে প্রধান বিরোধী দল, বিএনপি তৃতীয়। গিয়াস ভাই ও রহিম ভাই আমাকে সমর্থন জানালেন। পরে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে একটা মজার বিষয় ঘটে গেছে। সেটা হলো- যে আওয়ামী লীগ সব সময় বিএনপিকে সামরিক আইনের প্রডাক্ট বলে সমালোচনা করত, সেই আওয়ামী লীগ এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্রকে বৈধতা দিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল আর বিএনপি গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে এরশাদের পাতানো নির্বাচন বয়কট করল।
তারপর থেকে রাতের ভোট, বিনাভোটসহ সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দিয়ে আসছে জাতীয় পার্টি। এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভারত, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পরিপূরক শক্তি।
পূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল। আমার দেশ-এর পুনঃপ্রকাশনা সেই রক্ত লালের সংগ্রামেরই একটা অংশ। আমাদের মতো লোকেরা আমার দেশ-এর মতো পত্রিকার প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই। আল্লাহপাক মজলুমের পক্ষে।
১৭ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা যদি বারবার দেশ থেকে পালানোর বাণী উচ্চারণ না করতেন, তবুও কথা ছিল। খালেদা জিয়া তো ২০০৮-এর নির্বাচনে পরাজিত হয়ে পালাননি। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি তো যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে সফরে গিয়েও দেশে ফিরে গেছেন। স্বৈরশাসক এরশাদও তার পতন অবশ্যম্ভাবী দেখেও দেশ ছেড়ে পালাননি। তারা দুজনই তাদের বিরুদ্ধে সরক
১৮ ঘণ্টা আগেফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য ইন্দিরা গান্ধীর আমলে কারাগারে যাওয়া গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছেন, ‘যেখানে লোভ, হিংসা আর মিথ্যার শাসন, ফ্যাসিবাদ সেখানেই প্রভু। যেখানে অন্যায় আর অবিচার, দমন আর পীড়ন, ফ্যাসিবাদ সেখানেই প্রভু।
১৯ ঘণ্টা আগেকিউসি অনার জাহাজটির মালিক ছিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার এবং সে ঘটনার রাতেই জাহাজটি চট্টগ্রামে নোঙর করে। এ দুটি মিলই যথেষ্ট ছিল এই মতলববাজদের জন্য। কিন্তু তলিয়ে দেখেনি যে, কনটেইনারবাহী জাহাজ কখনোই বহির্নোঙরে এভাবে কনটেইনার খালাস করতে পারে না।
২০ ঘণ্টা আগে