আবদুল লতিফ মাসুম
২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি অনিবার্য মাইলফলক। একটি দেশ ও জাতি তার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পরিচালিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছার বিপরীতে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মতির মাধ্যমে শাসনের কথা বলে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকরা শক্তির জোরে শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারা মানুষের অধিকারকে অগ্রাহ্য করে বেপরোয়াভাবে শক্তির শাসন (Coercive Governance) কায়েম করেছে। জোর যার মুল্লুক তার নীতির মাধ্যমে এবার তারা বিভীষিকার বেড়াজাল তৈরি করেছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শেখ রেজিমের অবসান ঘটে রক্তপাতের মাধ্যমে। ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানকারীরা একে ‘বিপ্লব’ বলে চিহ্নিত করে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের ক্ষমতায় আসেন এবং শক্তির শাসন ২০২৪ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। কি আশ্চর্য মিল- দুই শাসনকালের অবসানে। এবারও রক্তপাতের মাধ্যমে আওয়ামী শাসনকালের অবসান ঘটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ৩৬ জুলাই ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নকে ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেন। গণঅভ্যুত্থান তথা গণবিপ্লবের পার্থক্য নির্ণয় করতে গেলে দেখা যাবে পার্থক্য খুব একটা নেই। স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের তাৎপর্য অনুধাবনের অপেক্ষা রাখে।
রাজনৈতিকভাবে বিপ্লব শব্দটির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ আছে। মানবজাতির ইতিহাস প্রমাণ করে যে যখনই সমাজ, রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় অসম্ভব রকমের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তখন মানুষ তাকে বিপ্লব বলে অভিহিত করেছে। তাহলে বিপ্লব মানেই হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে যে মহিমান্বিত বিপ্লব ঘটে ১৬৮৮ সালে, সেটিই সম্ভবত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথমবারের মতো গৌরবময় বিপ্লব বলে অভিহিত। এরপরে ফরাসি বিপ্লব ১৭৮৯, বলশেভিক বিপ্লব ১৯১৭ এবং ইরানের ইসলামি বিপ্লব ১৯৭৯ পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর এই অঞ্চলে বড় বড় গণআন্দোলন হয়েছে। ১৯৬৯ সালে এ দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকেও রক্তক্ষয়ী বিপ্লব বলা যায়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনকে তারা বিপ্লব বলতে চেয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটে, তাকেও সিপাহি-জনতার বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন একই অভিধায় অভিহিত। অবশেষে হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটে, তাকেও বিপ্লব বা গণবিপ্লব বলা যায়। আমরা আগেই বলেছি, বিপ্লবের মাঝে অসম্ভব গণপ্রত্যাশা থাকে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের বর্ষাবিপ্লব ২০২৪ ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের গত অর্ধশতাব্দীতে ইতিবাচক রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটেনি। বিশেষত গত ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসনে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কালচার ও রাজনৈতিক ব্যবহার শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী স্বৈরাচার ন্যূনতমভাবেও ভিন্নমতকে সহ্য করেনি। বরং অন্যায়-অত্যাচার, মামলা-হামলা, হত্যা ও গুমের মাধ্যমে বাংলাদেশে আওয়ামী জাহেলিয়াত কায়েম করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লব উত্তরকালে মানুষের রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ ও প্রতিরোধের বহ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রীর আবাস কিংবা অফিস যেভাবে মানুষের ঘৃণার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল।
যেকোনো বিপ্লব, গণবিপ্লব অথবা গণআন্দোলন ব্যাকরণমাফিক অগ্রসর হয় না। পরিবেশ পরিস্থিতি, সময় সমস্যা ও দেশজ গতিপ্রকৃতি বিপ্লবকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেভাবে বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লব ২০২৪ অবশ্যই স্ববৈশিষ্ট্য ও স্ব-প্রকৃতিতে উদ্ভাসিত। বিপ্লব সম্পর্কে মার্ক্সীয় দর্শন যেমন করে বলে শ্রেণি-সংগ্রামের কথা, বাংলাদেশের এই তার বিপ্লবে চিহ্ন মাত্র ছিল না। তবে সন্দেহ নেই এটি ছিল শোষক-পোষক (Patrons Client) সম্পর্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এটি নিকৃষ্ট লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিফল। মানবেন্দ্রনাথ রায় বিপ্লবের এক ভিন্ন সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। তার মতে, অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করাই বিপ্লবের একমাত্র লক্ষ্য নয়। মানুষের সহজ সম্ভাবনা বিকাশে বাধাস্বরূপ যেকোনো সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নির্মূল করাই বিপ্লবের আদর্শ। বিগত ১৫ বছরের দুঃশাসন, মানুষের দৈহিক অস্তিত্ব ও মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সতত স্বাভাবিক সহজাত আদর্শ ও জীবনবোধকে তারা নির্মূল করে দিতে চায়। তারা শত্রুকে মিত্র ও মিত্রকে শত্রু করার অপপ্রয়াস চালায়। তাই মানসিক, দৈহিক, নৈতিক পরিবর্তনের একটি অপরিহার্যতা অনুভূত হয়। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষকে রক্তপাতকে উপেক্ষা করতে শেখায়। যে আবু সাঈদ বুক ও বাহু উদ্বেল করে আত্ম-উৎসর্গের মহিমা স্থাপন করেছে, তার অন্তর্গত শিক্ষা ও দীক্ষা কী ছিল অন্যত্র এবং সর্বত্র সেটিই বিপ্লবের বাংলার বর্ষা আন্দোলনের উৎস ভূমি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। একটি নতুন আদর্শ, একটি নতুন প্রেরণা এবং একটি নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা জনমানুষকে উদ্বেল করে তোলে। তাই তো শোনা যায় সেই ভাইরাল হওয়া পুলিশি উক্তি। ‘গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করলে মরে একটা কিংবা আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ তাহলে বোঝা যায় মুক্তির লক্ষ্যে জীবনকে উৎসর্গ করার শপথ ছিল এসব শিক্ষার্থী। মুক্তি ও আদর্শের আলোয় উদ্ভাসিত ছিল তারা। আলোকিত মন থেকে নৈতিক বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে তারা। আন্দোলন জুড়ে এই ছিল হৃদয়ের স্পন্দন।
এই বিপ্লবের আদর্শিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের নিঃশেষও কাম্য ছিল। এটি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হয়নি। বরং ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে হাজারো-লাখো গুণে। বৈষম্যহীন মানে শুধু পেশার বৈষম্যের অবসান নয়। সর্বত্র শোষণ বৈষম্য ও দুর্নীতির মূল উৎপাটন আন্দোলনের অব্যক্ত অনুভূতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আন্দোলন-পরবর্তী অভিব্যক্তি ও প্রকাশ প্রমাণ করে, সাংস্কৃতিক গোলামি ও বাংলাদেশের মৌল আদর্শে ফিরে যাওয়াও একটি বড় ধরনের উদ্দেশ্য ছিল। জনগণের অব্যক্ত ভাষা রাজপথে ও তথাকথিত ভাস্কর্যের উৎপাটনে প্রতিফলিত হয়েছে। আজ্ঞা ও আদেশহীন এসব কর্ম তৎপরতাকেই হয়তো উত্তর আধুনিকতা নামে অভিহিত করা যায়। অব্যক্ত অথচ অনুচ্চারিত শব্দাবলি আকীর্ণ করেছে গোটা আন্দোলনকে। মানুষের সামনে পুঞ্জীভূত হিমালয়সম সমস্যা সমাধানের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়েছে। বিপ্লব আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে তারা প্রথমত চেয়েছে হত্যাকারীদের বিচার। দ্বিতীয়ত, অন্যায়-অত্যাচারী অপশাসকদের শাস্তি। তৃতীয়ত, একটি স্বাভাবিক ও নিরাপদ জনজীবন। চতুর্থত, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের অবসান। পঞ্চমত, বিপ্লব-উত্তর জনগণ একটি সুশাসনের প্রত্যাশা করে।
বিপ্লবের বা গণআন্দোলনের প্রতিভূ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর এর শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশের গৌরব, পৃথিবীর অনেক মানুষের শ্রদ্ধাশীল মানুষ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জাদুকর নন। আলাদিনের চেরাগ নেই তার হাতে। তবে আছে কোটি মানুষের আশা-প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে মানুষের ভালো করার প্রতিজ্ঞা রয়েছে তাদের। বিপ্লব-উত্তর কোটি কোটি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে তাদের ঘিরে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেসব জঞ্জাল জমা হয়েছে, তার সংস্কার চায় মানুষ। রাজনৈতিকভাবে দ্বিতীয়বার স্বৈরাচারের মুখোমুখি হতে চান না মানুষ। তাই সংবিধান সংস্কার অথবা পুনর্লিখনের দাবি। ক্ষমতা যাতে একক কর্তৃত্বে আবর্তিত ও বিবর্তিত না হয়, সে জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা চায় জনগণ। এসব সংস্কারের প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
যেখানেই বিপ্লব ঘটে, সেখানেই প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। ফরাসি বিপ্লবের পর ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লব-পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে দার্শনিক কদরেসে শব্দটি ব্যবহার করেন। বিপ্লবের বিপরীতমুখী যাত্রা বোঝাতে তিনি এই টার্মটি ব্যবহার করেন। প্রচলিত অর্থে বিপ্লবের মাঝে ঘাপটি মেরে থাকা শত্রুপক্ষের প্রতিক্রিয়া হিসেবেও এটি দেখা হয়। কেতাবি ভাষায় বলা যায়, যেকোনো ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠী যখন অনুষ্ঠিত বিপ্লব বা আন্দোলনকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে, তখনই প্রতিবিপ্লব ঘটে। এ ধরনের প্রচেষ্টা পূর্ববর্তী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে পুনঃস্থাপনের প্রয়াস নেয়। বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত বর্ষাবিপ্লব ২০২৪-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জনগণ দেখেছে কার্যত পুলিশ বাহিনী অসহযোগিতার মাধ্যমে বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে চেয়েছে। এরপর সর্বোচ্চ বিচারালয় ‘জুডিশিয়াল ক্যু’র মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। আনসার বাহিনীর মতো দুর্বলতম শক্তিও প্রতি বিপ্লবের কারণ ঘটায়। আসু বিপদের কথা হলো প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। সচিবালয়ের অস্থির ঘটনাবলি এর প্রমাণ। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে পরাজিত শক্তির আস্ফালন। এর দুটি অংশ- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর ওপর আঘাত হানা হয়। বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীকে তারা হত্যা ও জখম করে। আর শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশে বসে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব আপদ-বিপদের প্রতিকার করছে। আসার কথা যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন অটুট রয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দল পুনঃপুনঃ নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে। অবশ্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে রাজি হয়েছেন। সর্বশেষ জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। প্রধান ইসলামি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী সরকারকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেছে। ডান ও বাম সব ধারার রাজনৈতিক দলগুলো একই মনোভাব প্রদর্শন করেছে। তবে সবারই লক্ষ্য আগামী নির্বাচন। এই নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, ততই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিতর্ক তীব্রতর হবে। সেই অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় এনে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রসর হতে হবে। সংস্কারের জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে সংস্কারের নীতিগত প্রধান প্রধান কার্যব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল নির্ধারণ করা। রাজনৈতিক দলগুলো অস্থিরতা ও অসহযোগিতা করলে অন্তর্বর্তী সরকার অকার্যকর হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রয়োজন।
বিগত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের দুঃসময়কে অনেক বিদ্বজ্জন ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদের ফলাফল বলে বর্ণনা করেন। বড় ব্যবসায়ীরা সব সময়ই রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। অর্থের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোরও ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরতা একবারে কম নয়। ব্যবসা ও রাজনীতির এই পরস্পর নির্ভরশীলতাকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন অর্থনীতিতে নতুন একটি পুঁজিবাদী ধারা তৈরি হয়েছে। সহজ অর্থে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ মহলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসা ও প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়া। স্বজনতোষী পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো। নীতিনৈতিকতার লঙ্ঘন। একটি বড় ব্যবসা বা প্রকল্পের কাজ পেতে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাজ দেওয়া হয়। সে কারণে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অনৈতিক লেনদেনেও জড়িয়ে পড়েন। বিগত ১৫ বছরের বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের সবচেয়ে যে বড় ক্ষতিটি হয়েছে তা হলো নীতিনৈতিকতার অবসান। দেশের সব ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার মতো সংবেদনশীল বিষয়ে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের উৎপাত লক্ষ করা যায়। এ সময় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রাতিষ্ঠানিকতা করে। সেই সঙ্গে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণও ঘটে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আওয়ামী জাতীয় সংসদগুলো ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সর্বত্রই ব্যবসায়ীদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। সর্বোচ্চ ‘থ্রি এম’ অর্থাৎ মানি, মাসল ও মিডিয়ার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এই থ্রি এমের অধীন হয়ে ওঠে। অর্থই যে পতিত স্বৈরাচারের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লব-পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়, এস আলমের কাজের বুয়ার কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স থাকে, পুলিশ অফিসারের কার্যালয়ে ২৫ কোটি টাকা নগদ পাওয়া যায় এবং একজন মন্ত্রীর পাঁচটি দেশে ৫০০টি বাড়ির সন্ধান মেলে, সে দেশটি নিকৃষ্টতার কোন স্তরে পৌঁছেছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এ নিয়ে মহাকাব্য রচিত হতে পারে।
এই ব্যক্তিক, দলীয় ও রাষ্ট্রিক লুটপাটে বাংলাদেশ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ প্রায় শেষ হয়ে আসে। মেগা প্রকল্পগুলোয় মেগা চুরির পর অর্থের ঘাটতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে। ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্যসংকটে ভোগে। অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় মুদ্রাস্ফীতি। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়ায়। খুব সংগতভাবেই মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ভাবে। আশার কথা, অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়। তিনি যখন জাতিসংঘে যান, পৃথিবীর তাবৎ উন্নত রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের সহায়তায় অবারিতভাবে হস্ত প্রসারিত করে। অন্তর্বর্তী সরকারে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে যথাযথ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া বৃদ্ধি রোধ করতে না পারায় মানুষের হতাশা সৃষ্টি হয়।
আমরা জানি, স্বৈরাচারী শাসনামলে গণতন্ত্র পরিত্যক্ত হয়। নির্বাচনব্যবস্থা নির্বাসিত হয়। বিচারব্যবস্থা অধীনস্থ হয়ে পড়ে। আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়। জাতীয় সংসদ তথা ন্যাশনালন এ দেশের একজন রাজনীতিকের ভাষায় পার্লামেন্ট ‘শুয়ারের খোয়ার’-এ পর্যবসিত হয়। সুশাসনের পরিবর্তে রাষ্ট্রে দুঃশাসন জেঁকে বসে। ২০২৪ সালের গণবিপ্লবের পর মানুষ এসব থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার সহজ নয়। তাই বিপ্লবোত্তর গণআকাঙ্ক্ষা হয়ে দাঁড়ায় সংস্কার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রবাদ তুললে বাক্যটি এ রকম, ‘A politician things for the election. But a statesman things for the nation.’ এ ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ৩৬ জুলাইয়ের পর যতই সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে, ততই বিষয়টি বিতর্কিত হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা খুব সংগতভাবেই শিগগিরই নির্বাচন চাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মতো রাষ্ট্রনায়করা সংস্কারের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করছেন। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সংস্কারের লক্ষ্যে কঠিন অবস্থানের জানান দিচ্ছেন।
বলতে গেলে, গোটা জাতি সংস্কারের প্রশ্নে উদ্বেল ও উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসবে অংশগ্রহণ করছেন বিদ্বজ্জন, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদরা। অন্তর্বর্তী সরকার এসব সংস্কার সাধনের জন্য এ পর্যন্ত অনেক কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন হচ্ছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন ইত্যাদি। এ ছাড়া আগে থেকে কার্যকর স্থায়ী কমিশনগুলো মেরামতের কাজ চলছে। এগুলো হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন ও জনপ্রশাসন ইত্যাদি। সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ঘাটতি আছে। কিন্তু তাদের আন্তরিকতায় কেউ সন্দেহ পোষণ করে না। যেভাবে কমিশন গঠন করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সফলতা আসবে। কতটা আসবে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশেষ করে অস্থির হতাশায় নিমগ্ন, দুর্নীতিতে আকীর্ণ এজাতির উদ্ধার সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে অনেক কথা বলেন। কিন্তু ক্ষমতায়িত হওয়ার পর আর ‘রা’ করেন না। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ত্রি-দলীয় ঐক্যজোটের ঘোষণার কথা বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষিত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটায়নি। ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী প্রতিশ্রুত সংস্কারের ক্ষেত্রে কী ঘটবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। এভাবে জাতীয় সমঝোতা (National Consensus) এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে সংস্কার বাস্তবায়ন সহজতর হতে পারে।
দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা কিন্তু খুবই সামান্য। তারা দুবেলা খেতে পারলেই খুশি। তারা চায় রাতবিরাতে নিরাপদে চলতে, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে। তারা স্বাভাবিক জীবনের দৃশ্যতা চায়। তারা তাদের সম্পদের সুরক্ষা চায়। তারা যার যা প্রাপ্য, সেটুকু পেলেই আনন্দিত। তারা চায় সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে সমাজে বসবাস করতে। তাদের আশা, আগামীতে তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
অতিক্রান্ত প্রায় ১৫০ দিনের অভিজ্ঞতায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না বাংলাদেশের জনগণ। তারা এ সময় জীবনের জন্য প্রথম ও প্রধান বিষয়ে রীতিমতো বিপদগ্রস্ত। জিনিসপত্রের দাম আওয়ামী আমলে যা ছিল, তার চেয়ে বেড়েছে অনেক। যথা পূর্বাং তথায় যদি পরং হয় তাহলে, সন্তুষ্টির জায়গা কোথায়? সেই সিন্ডিকেট যদি বহাল থাকে তাহলে পরে পরিবর্তন কী হলো? জনগণ যদি বলে, ‘আগেই ভালো ছিলাম’ তাহলে তার চেয়ে অপমানজনক বিষয় আর কী হতে পারে? জনজীবনের জন্য দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। এত দিনেও সন্তুষ্টি লাভের কোনো কারণ ঘটেনি। পুলিশকে সম্পূর্ণভাবে সুশৃঙ্খল করা যায়নি। বিগত ১৫ বছরে হিমালয়সম যে জঞ্জাল জমেছে, তা এত অল্প সময়ে পরিষ্কার সম্ভব নয়। তাই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চায় জনগণ। তারা চায় সংস্কারে রূপরেখা ঘোষিত হোক। সংস্কার প্রস্তাবনা যা ঘোষিত হয়েছে, রেহমান সোবহানের কথায় তার পরিপূর্ণতা বিধানে চার-পাঁচ বছর সময় দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো অত সময় দিতে চায় না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত স্বল্প সময়ে মৌলিক সংস্কারের প্রাথমিক ভিত্তি নির্মাণ। আমরা বিশ্বাস করি, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এই জাতির একজন পিতৃপুরুষ হিসেবে কল্যাণ কামনায় নিমগ্ন। সুতরাং জনগণ চায়, তার হাত দিয়েই যথার্থ সংস্কার সম্পন্ন হোক। তবে জনগণের এই আশার মধ্যে আশঙ্কাও আছে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের পার্থক্য এরই মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং আমাদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আর তাতেই গোটা জাতির মঙ্গল। সুন্দর হোক, কুসুমিত হোক ও সুশোভিত হোক বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি অনিবার্য মাইলফলক। একটি দেশ ও জাতি তার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পরিচালিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছার বিপরীতে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মতির মাধ্যমে শাসনের কথা বলে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকরা শক্তির জোরে শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারা মানুষের অধিকারকে অগ্রাহ্য করে বেপরোয়াভাবে শক্তির শাসন (Coercive Governance) কায়েম করেছে। জোর যার মুল্লুক তার নীতির মাধ্যমে এবার তারা বিভীষিকার বেড়াজাল তৈরি করেছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শেখ রেজিমের অবসান ঘটে রক্তপাতের মাধ্যমে। ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানকারীরা একে ‘বিপ্লব’ বলে চিহ্নিত করে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের ক্ষমতায় আসেন এবং শক্তির শাসন ২০২৪ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। কি আশ্চর্য মিল- দুই শাসনকালের অবসানে। এবারও রক্তপাতের মাধ্যমে আওয়ামী শাসনকালের অবসান ঘটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ৩৬ জুলাই ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নকে ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেন। গণঅভ্যুত্থান তথা গণবিপ্লবের পার্থক্য নির্ণয় করতে গেলে দেখা যাবে পার্থক্য খুব একটা নেই। স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের তাৎপর্য অনুধাবনের অপেক্ষা রাখে।
রাজনৈতিকভাবে বিপ্লব শব্দটির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ আছে। মানবজাতির ইতিহাস প্রমাণ করে যে যখনই সমাজ, রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় অসম্ভব রকমের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তখন মানুষ তাকে বিপ্লব বলে অভিহিত করেছে। তাহলে বিপ্লব মানেই হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে যে মহিমান্বিত বিপ্লব ঘটে ১৬৮৮ সালে, সেটিই সম্ভবত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথমবারের মতো গৌরবময় বিপ্লব বলে অভিহিত। এরপরে ফরাসি বিপ্লব ১৭৮৯, বলশেভিক বিপ্লব ১৯১৭ এবং ইরানের ইসলামি বিপ্লব ১৯৭৯ পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর এই অঞ্চলে বড় বড় গণআন্দোলন হয়েছে। ১৯৬৯ সালে এ দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকেও রক্তক্ষয়ী বিপ্লব বলা যায়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনকে তারা বিপ্লব বলতে চেয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটে, তাকেও সিপাহি-জনতার বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন একই অভিধায় অভিহিত। অবশেষে হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটে, তাকেও বিপ্লব বা গণবিপ্লব বলা যায়। আমরা আগেই বলেছি, বিপ্লবের মাঝে অসম্ভব গণপ্রত্যাশা থাকে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের বর্ষাবিপ্লব ২০২৪ ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের গত অর্ধশতাব্দীতে ইতিবাচক রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটেনি। বিশেষত গত ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসনে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কালচার ও রাজনৈতিক ব্যবহার শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী স্বৈরাচার ন্যূনতমভাবেও ভিন্নমতকে সহ্য করেনি। বরং অন্যায়-অত্যাচার, মামলা-হামলা, হত্যা ও গুমের মাধ্যমে বাংলাদেশে আওয়ামী জাহেলিয়াত কায়েম করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লব উত্তরকালে মানুষের রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ ও প্রতিরোধের বহ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রীর আবাস কিংবা অফিস যেভাবে মানুষের ঘৃণার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল।
যেকোনো বিপ্লব, গণবিপ্লব অথবা গণআন্দোলন ব্যাকরণমাফিক অগ্রসর হয় না। পরিবেশ পরিস্থিতি, সময় সমস্যা ও দেশজ গতিপ্রকৃতি বিপ্লবকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেভাবে বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লব ২০২৪ অবশ্যই স্ববৈশিষ্ট্য ও স্ব-প্রকৃতিতে উদ্ভাসিত। বিপ্লব সম্পর্কে মার্ক্সীয় দর্শন যেমন করে বলে শ্রেণি-সংগ্রামের কথা, বাংলাদেশের এই তার বিপ্লবে চিহ্ন মাত্র ছিল না। তবে সন্দেহ নেই এটি ছিল শোষক-পোষক (Patrons Client) সম্পর্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এটি নিকৃষ্ট লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিফল। মানবেন্দ্রনাথ রায় বিপ্লবের এক ভিন্ন সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। তার মতে, অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করাই বিপ্লবের একমাত্র লক্ষ্য নয়। মানুষের সহজ সম্ভাবনা বিকাশে বাধাস্বরূপ যেকোনো সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নির্মূল করাই বিপ্লবের আদর্শ। বিগত ১৫ বছরের দুঃশাসন, মানুষের দৈহিক অস্তিত্ব ও মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সতত স্বাভাবিক সহজাত আদর্শ ও জীবনবোধকে তারা নির্মূল করে দিতে চায়। তারা শত্রুকে মিত্র ও মিত্রকে শত্রু করার অপপ্রয়াস চালায়। তাই মানসিক, দৈহিক, নৈতিক পরিবর্তনের একটি অপরিহার্যতা অনুভূত হয়। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষকে রক্তপাতকে উপেক্ষা করতে শেখায়। যে আবু সাঈদ বুক ও বাহু উদ্বেল করে আত্ম-উৎসর্গের মহিমা স্থাপন করেছে, তার অন্তর্গত শিক্ষা ও দীক্ষা কী ছিল অন্যত্র এবং সর্বত্র সেটিই বিপ্লবের বাংলার বর্ষা আন্দোলনের উৎস ভূমি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। একটি নতুন আদর্শ, একটি নতুন প্রেরণা এবং একটি নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা জনমানুষকে উদ্বেল করে তোলে। তাই তো শোনা যায় সেই ভাইরাল হওয়া পুলিশি উক্তি। ‘গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করলে মরে একটা কিংবা আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ তাহলে বোঝা যায় মুক্তির লক্ষ্যে জীবনকে উৎসর্গ করার শপথ ছিল এসব শিক্ষার্থী। মুক্তি ও আদর্শের আলোয় উদ্ভাসিত ছিল তারা। আলোকিত মন থেকে নৈতিক বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে তারা। আন্দোলন জুড়ে এই ছিল হৃদয়ের স্পন্দন।
এই বিপ্লবের আদর্শিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের নিঃশেষও কাম্য ছিল। এটি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হয়নি। বরং ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে হাজারো-লাখো গুণে। বৈষম্যহীন মানে শুধু পেশার বৈষম্যের অবসান নয়। সর্বত্র শোষণ বৈষম্য ও দুর্নীতির মূল উৎপাটন আন্দোলনের অব্যক্ত অনুভূতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আন্দোলন-পরবর্তী অভিব্যক্তি ও প্রকাশ প্রমাণ করে, সাংস্কৃতিক গোলামি ও বাংলাদেশের মৌল আদর্শে ফিরে যাওয়াও একটি বড় ধরনের উদ্দেশ্য ছিল। জনগণের অব্যক্ত ভাষা রাজপথে ও তথাকথিত ভাস্কর্যের উৎপাটনে প্রতিফলিত হয়েছে। আজ্ঞা ও আদেশহীন এসব কর্ম তৎপরতাকেই হয়তো উত্তর আধুনিকতা নামে অভিহিত করা যায়। অব্যক্ত অথচ অনুচ্চারিত শব্দাবলি আকীর্ণ করেছে গোটা আন্দোলনকে। মানুষের সামনে পুঞ্জীভূত হিমালয়সম সমস্যা সমাধানের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়েছে। বিপ্লব আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে তারা প্রথমত চেয়েছে হত্যাকারীদের বিচার। দ্বিতীয়ত, অন্যায়-অত্যাচারী অপশাসকদের শাস্তি। তৃতীয়ত, একটি স্বাভাবিক ও নিরাপদ জনজীবন। চতুর্থত, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের অবসান। পঞ্চমত, বিপ্লব-উত্তর জনগণ একটি সুশাসনের প্রত্যাশা করে।
বিপ্লবের বা গণআন্দোলনের প্রতিভূ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর এর শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশের গৌরব, পৃথিবীর অনেক মানুষের শ্রদ্ধাশীল মানুষ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জাদুকর নন। আলাদিনের চেরাগ নেই তার হাতে। তবে আছে কোটি মানুষের আশা-প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে মানুষের ভালো করার প্রতিজ্ঞা রয়েছে তাদের। বিপ্লব-উত্তর কোটি কোটি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে তাদের ঘিরে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেসব জঞ্জাল জমা হয়েছে, তার সংস্কার চায় মানুষ। রাজনৈতিকভাবে দ্বিতীয়বার স্বৈরাচারের মুখোমুখি হতে চান না মানুষ। তাই সংবিধান সংস্কার অথবা পুনর্লিখনের দাবি। ক্ষমতা যাতে একক কর্তৃত্বে আবর্তিত ও বিবর্তিত না হয়, সে জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা চায় জনগণ। এসব সংস্কারের প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
যেখানেই বিপ্লব ঘটে, সেখানেই প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। ফরাসি বিপ্লবের পর ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লব-পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে দার্শনিক কদরেসে শব্দটি ব্যবহার করেন। বিপ্লবের বিপরীতমুখী যাত্রা বোঝাতে তিনি এই টার্মটি ব্যবহার করেন। প্রচলিত অর্থে বিপ্লবের মাঝে ঘাপটি মেরে থাকা শত্রুপক্ষের প্রতিক্রিয়া হিসেবেও এটি দেখা হয়। কেতাবি ভাষায় বলা যায়, যেকোনো ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠী যখন অনুষ্ঠিত বিপ্লব বা আন্দোলনকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে, তখনই প্রতিবিপ্লব ঘটে। এ ধরনের প্রচেষ্টা পূর্ববর্তী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে পুনঃস্থাপনের প্রয়াস নেয়। বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত বর্ষাবিপ্লব ২০২৪-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জনগণ দেখেছে কার্যত পুলিশ বাহিনী অসহযোগিতার মাধ্যমে বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে চেয়েছে। এরপর সর্বোচ্চ বিচারালয় ‘জুডিশিয়াল ক্যু’র মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। আনসার বাহিনীর মতো দুর্বলতম শক্তিও প্রতি বিপ্লবের কারণ ঘটায়। আসু বিপদের কথা হলো প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। সচিবালয়ের অস্থির ঘটনাবলি এর প্রমাণ। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে পরাজিত শক্তির আস্ফালন। এর দুটি অংশ- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর ওপর আঘাত হানা হয়। বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীকে তারা হত্যা ও জখম করে। আর শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশে বসে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব আপদ-বিপদের প্রতিকার করছে। আসার কথা যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন অটুট রয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দল পুনঃপুনঃ নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে। অবশ্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে রাজি হয়েছেন। সর্বশেষ জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। প্রধান ইসলামি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী সরকারকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেছে। ডান ও বাম সব ধারার রাজনৈতিক দলগুলো একই মনোভাব প্রদর্শন করেছে। তবে সবারই লক্ষ্য আগামী নির্বাচন। এই নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, ততই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিতর্ক তীব্রতর হবে। সেই অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় এনে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রসর হতে হবে। সংস্কারের জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে সংস্কারের নীতিগত প্রধান প্রধান কার্যব্যবস্থা সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল নির্ধারণ করা। রাজনৈতিক দলগুলো অস্থিরতা ও অসহযোগিতা করলে অন্তর্বর্তী সরকার অকার্যকর হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রয়োজন।
বিগত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের দুঃসময়কে অনেক বিদ্বজ্জন ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদের ফলাফল বলে বর্ণনা করেন। বড় ব্যবসায়ীরা সব সময়ই রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। অর্থের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোরও ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরতা একবারে কম নয়। ব্যবসা ও রাজনীতির এই পরস্পর নির্ভরশীলতাকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন অর্থনীতিতে নতুন একটি পুঁজিবাদী ধারা তৈরি হয়েছে। সহজ অর্থে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ মহলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসা ও প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়া। স্বজনতোষী পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো। নীতিনৈতিকতার লঙ্ঘন। একটি বড় ব্যবসা বা প্রকল্পের কাজ পেতে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাজ দেওয়া হয়। সে কারণে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অনৈতিক লেনদেনেও জড়িয়ে পড়েন। বিগত ১৫ বছরের বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের সবচেয়ে যে বড় ক্ষতিটি হয়েছে তা হলো নীতিনৈতিকতার অবসান। দেশের সব ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার মতো সংবেদনশীল বিষয়ে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের উৎপাত লক্ষ করা যায়। এ সময় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রাতিষ্ঠানিকতা করে। সেই সঙ্গে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণও ঘটে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আওয়ামী জাতীয় সংসদগুলো ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সর্বত্রই ব্যবসায়ীদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। সর্বোচ্চ ‘থ্রি এম’ অর্থাৎ মানি, মাসল ও মিডিয়ার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এই থ্রি এমের অধীন হয়ে ওঠে। অর্থই যে পতিত স্বৈরাচারের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লব-পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়, এস আলমের কাজের বুয়ার কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স থাকে, পুলিশ অফিসারের কার্যালয়ে ২৫ কোটি টাকা নগদ পাওয়া যায় এবং একজন মন্ত্রীর পাঁচটি দেশে ৫০০টি বাড়ির সন্ধান মেলে, সে দেশটি নিকৃষ্টতার কোন স্তরে পৌঁছেছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এ নিয়ে মহাকাব্য রচিত হতে পারে।
এই ব্যক্তিক, দলীয় ও রাষ্ট্রিক লুটপাটে বাংলাদেশ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ প্রায় শেষ হয়ে আসে। মেগা প্রকল্পগুলোয় মেগা চুরির পর অর্থের ঘাটতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে। ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্যসংকটে ভোগে। অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় মুদ্রাস্ফীতি। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়ায়। খুব সংগতভাবেই মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ভাবে। আশার কথা, অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়। তিনি যখন জাতিসংঘে যান, পৃথিবীর তাবৎ উন্নত রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের সহায়তায় অবারিতভাবে হস্ত প্রসারিত করে। অন্তর্বর্তী সরকারে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে যথাযথ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া বৃদ্ধি রোধ করতে না পারায় মানুষের হতাশা সৃষ্টি হয়।
আমরা জানি, স্বৈরাচারী শাসনামলে গণতন্ত্র পরিত্যক্ত হয়। নির্বাচনব্যবস্থা নির্বাসিত হয়। বিচারব্যবস্থা অধীনস্থ হয়ে পড়ে। আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়। জাতীয় সংসদ তথা ন্যাশনালন এ দেশের একজন রাজনীতিকের ভাষায় পার্লামেন্ট ‘শুয়ারের খোয়ার’-এ পর্যবসিত হয়। সুশাসনের পরিবর্তে রাষ্ট্রে দুঃশাসন জেঁকে বসে। ২০২৪ সালের গণবিপ্লবের পর মানুষ এসব থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার সহজ নয়। তাই বিপ্লবোত্তর গণআকাঙ্ক্ষা হয়ে দাঁড়ায় সংস্কার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রবাদ তুললে বাক্যটি এ রকম, ‘A politician things for the election. But a statesman things for the nation.’ এ ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ৩৬ জুলাইয়ের পর যতই সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে, ততই বিষয়টি বিতর্কিত হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা খুব সংগতভাবেই শিগগিরই নির্বাচন চাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মতো রাষ্ট্রনায়করা সংস্কারের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করছেন। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সংস্কারের লক্ষ্যে কঠিন অবস্থানের জানান দিচ্ছেন।
বলতে গেলে, গোটা জাতি সংস্কারের প্রশ্নে উদ্বেল ও উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসবে অংশগ্রহণ করছেন বিদ্বজ্জন, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদরা। অন্তর্বর্তী সরকার এসব সংস্কার সাধনের জন্য এ পর্যন্ত অনেক কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন হচ্ছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন ইত্যাদি। এ ছাড়া আগে থেকে কার্যকর স্থায়ী কমিশনগুলো মেরামতের কাজ চলছে। এগুলো হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন ও জনপ্রশাসন ইত্যাদি। সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ঘাটতি আছে। কিন্তু তাদের আন্তরিকতায় কেউ সন্দেহ পোষণ করে না। যেভাবে কমিশন গঠন করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সফলতা আসবে। কতটা আসবে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশেষ করে অস্থির হতাশায় নিমগ্ন, দুর্নীতিতে আকীর্ণ এজাতির উদ্ধার সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে অনেক কথা বলেন। কিন্তু ক্ষমতায়িত হওয়ার পর আর ‘রা’ করেন না। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ত্রি-দলীয় ঐক্যজোটের ঘোষণার কথা বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষিত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটায়নি। ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী প্রতিশ্রুত সংস্কারের ক্ষেত্রে কী ঘটবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। এভাবে জাতীয় সমঝোতা (National Consensus) এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে সংস্কার বাস্তবায়ন সহজতর হতে পারে।
দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা কিন্তু খুবই সামান্য। তারা দুবেলা খেতে পারলেই খুশি। তারা চায় রাতবিরাতে নিরাপদে চলতে, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে। তারা স্বাভাবিক জীবনের দৃশ্যতা চায়। তারা তাদের সম্পদের সুরক্ষা চায়। তারা যার যা প্রাপ্য, সেটুকু পেলেই আনন্দিত। তারা চায় সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে সমাজে বসবাস করতে। তাদের আশা, আগামীতে তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
অতিক্রান্ত প্রায় ১৫০ দিনের অভিজ্ঞতায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না বাংলাদেশের জনগণ। তারা এ সময় জীবনের জন্য প্রথম ও প্রধান বিষয়ে রীতিমতো বিপদগ্রস্ত। জিনিসপত্রের দাম আওয়ামী আমলে যা ছিল, তার চেয়ে বেড়েছে অনেক। যথা পূর্বাং তথায় যদি পরং হয় তাহলে, সন্তুষ্টির জায়গা কোথায়? সেই সিন্ডিকেট যদি বহাল থাকে তাহলে পরে পরিবর্তন কী হলো? জনগণ যদি বলে, ‘আগেই ভালো ছিলাম’ তাহলে তার চেয়ে অপমানজনক বিষয় আর কী হতে পারে? জনজীবনের জন্য দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। এত দিনেও সন্তুষ্টি লাভের কোনো কারণ ঘটেনি। পুলিশকে সম্পূর্ণভাবে সুশৃঙ্খল করা যায়নি। বিগত ১৫ বছরে হিমালয়সম যে জঞ্জাল জমেছে, তা এত অল্প সময়ে পরিষ্কার সম্ভব নয়। তাই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চায় জনগণ। তারা চায় সংস্কারে রূপরেখা ঘোষিত হোক। সংস্কার প্রস্তাবনা যা ঘোষিত হয়েছে, রেহমান সোবহানের কথায় তার পরিপূর্ণতা বিধানে চার-পাঁচ বছর সময় দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো অত সময় দিতে চায় না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত স্বল্প সময়ে মৌলিক সংস্কারের প্রাথমিক ভিত্তি নির্মাণ। আমরা বিশ্বাস করি, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এই জাতির একজন পিতৃপুরুষ হিসেবে কল্যাণ কামনায় নিমগ্ন। সুতরাং জনগণ চায়, তার হাত দিয়েই যথার্থ সংস্কার সম্পন্ন হোক। তবে জনগণের এই আশার মধ্যে আশঙ্কাও আছে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের পার্থক্য এরই মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং আমাদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আর তাতেই গোটা জাতির মঙ্গল। সুন্দর হোক, কুসুমিত হোক ও সুশোভিত হোক বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতের জন্য যা করেছেন, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে ভারত শুধু আশ্রয় দিয়ে বসে থাকবে না, তাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা চেষ্টা করে যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের দাবি তোলে, তখন সাধারণ মানুষ
৬ ঘণ্টা আগেবিশ্বের নানা অঞ্চলে প্রভাবশালী ও তুলনামূলকভাবে বৃহৎ রাষ্ট্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপে জার্মানি ও ফ্রান্স এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলের উল্লেখ করা যেতে পারে।
৯ ঘণ্টা আগেপূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল। আমার দেশ-এর পুনঃপ্রকাশনা সেই রক্ত লালের সংগ্রামেরই একটা অংশ। আমাদের মতো লোকেরা আমার দেশ-এর মতো পত্রিকার প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই। আল্লাহপাক মজলুমের পক্ষে।
১ দিন আগেচেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) আজ আমাকে বলেছেন, কি খান সাহেব, হাসিনা আসছে বলে কি ভয় পাচ্ছেন? এটা শুনে আমরা কিছুটা অবাকই হলাম। মনে হলো তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ভয় পাচ্ছেন!
১ দিন আগে