ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী
ইল্ম, আকল, নিয়ত
১৯৭১-এ অগণ্য রক্তের বিনিময়ে জনযুদ্ধে সাফল্য লাভ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। যেটাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি, স্বাধীনতার যুদ্ধ বলি। কিন্তু এরপর ৫৩ বছর কেটে গেলেও আমরা এই বাংলাদেশি জনগণ নিজেদের বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, অনাচার থেকে যেমন মুক্ত করতে পারিনি, তেমনি পাইনি প্রকৃত স্বাধীনতা। কি দেশের ভেতরে, কি দেশের বাইরে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, বিগত ১৬টি বছর ধরে স্বৈরতন্ত্র, মাফিয়াতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে রাখা হয়েছিল দেশের ওপর, জনগণের ওপর এবং তা ব্যক্তিক, পারিবারিক জমিদারিতে পরিণত হয়েছিল। দাসানুদাস বানিয়ে রাখা হয়েছিল ২০ কোটি মানুষকে। জনইচ্ছাকে অস্তিত্বহীন করা হয়েছিল। মিথ্যাচার, অনাচার, দম্ভ, অসভ্যতা, লুট-লুচ্চামি, পাচার, দখলদারি, মামলা-হামলা, জেল, গুম, খুন, আয়নাঘর, ভারতের কাছে দেশের যাবতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া—সবই করেছে উৎখাতপ্রাপ্ত দিল্লি-দাসীর অবৈধ সরকার। দেশকে, দেশের সম্পদকে, দেশের মানুষের প্রাপ্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে একদিকে নিজেরা লুটের ভাগাড় বানিয়েছে, অন্যদিকে ভারতের উপনিবেশ, করদরাজ্য ও হিন্টারল্যান্ডের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশকে। হুকুম ভারতের, লুটতরাজ ভারতের, খবরদারি ভারতের, দাদাগিরি ভারতের, ছবক ভারতের। এত দেওয়া হয়েছে যে, ভারত কোনোদিন ভুলবে না। কেননা, স্বঘোষিত সম্পর্ক তো স্বামী-স্ত্রীর। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে গত ১৬ বছরে। সব জায়গায় হয়েছে নিকৃষ্টতম দলীয়করণ, রাজনীতিকরণ। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গোপালীকরণ, আওয়ামীকরণ ও সনাতনীকরণ। কুক্ষিগত করা হয়েছে এক হাতে সকল ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত, বরাদ্দ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার। গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম, সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি, বিদেশনীতি এবং সকল পলিসি, প্রোগ্রাম, প্রজেক্টকে দানবীয়ভাবে দখল ও বলাৎকারকরত পদানত করে রাখা হয়েছে সংকীর্ণতম ব্যক্তিক উন্মাদনা ও খাই-খায়েশ মেটাতে।
এই প্রক্রিয়ায় দেশ গেছে ধ্বংসের কিনারে, লুটতরাজ ও পাচারের মাৎস্যন্যায় ঘটেছে এবং অ্যাক্রস-বর্ডার উল্ফল্যান্ড থেকে একতরফা মাস্তানি ও মুনাফা করেছে মোদির বিজেপি নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী ও আধিপত্যবাদী ইন্ডিয়া বা ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত বা হিন্দুস্তান। সে জন্যই ২০২৪-এর অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমষ্টি জনতা উৎখাত করেছে দুই হাজার জীবনদান এবং বহু হাজার আহত হওয়া; সেই সঙ্গে নজিরবিহীন ক্ষতি ও ত্যাগের বিনিময়ে মাফিয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও দুর্বৃত্তের আস্তাকুঁড় আওয়ামী লীগ জঞ্জালকে।
মাফিয়া রানী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ২৮ লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়ে তাদের প্রভু হিন্দুত্ববাদী, আধিপত্যবাদী ভারতে পালিয়ে গেছে এবং অনেককেই অন্তর্ঘাত করে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী ভারত, আধিপত্যবাদী ভারত এতদিন ইচ্ছেমতো বাংলাদেশকে লুট করেছে, নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং নিজেদের সম্প্রসারণবাদী অবৈধ স্বার্থ হাসিল করেছে। দৃশ্যত মাফিয়া হাসিনা ও আওয়ামী গুণ্ডাপাণ্ডা-খুনিরা মনে করেছিল এবং সদম্ভ ঘোষণা দিয়েছিল যে, দেশ তাদের বাপের সম্পত্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায় সয়লাব করেছিল দেশকে। তাদের একচ্ছত্র জমিদারিতে ২০ কোটি মানুষ ছিল ক্রীতদাস-প্রজা। আর তাদের প্রভু ভারতও ভেবেছিল চিরস্থায়ী মৌরসী পাট্টা বানিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশকে এবং রমণী রমণ রতিদেব হয়ে উঠেছে সে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তার পিতা আওয়ামী লীগসহ উৎখাত হওয়ার পর হাসিনা ভারতের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল এবং চাণক্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী এজেন্টের প্রশিক্ষণ নিয়ে দয়াদ্র ভুল সিদ্ধান্তের সুযোগে ঢুকেছিল দেশে এবং খুন করিয়েছিল তার প্রভুদের ‘র’-এর দ্বারা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্বাধীনচেতা নেতা জিয়াউর রহমানকে। তেমনি এবারও ১৬ বছর হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী ভারতকে ১৯৭২-১৯৭৫-এর ন্যায় রসনা ও রমণ সুখ দিয়ে সে ও তার ফ্যাসিস্ট বাহিনী অবশেষে লাথি খেয়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের কোলে, স্ব-স্বীকৃত স্বামীর আশ্রয়ে।
ইতঃপূর্বে কন্যাকে ভারতে পোস্টেড করে ‘র’-এর প্রশিক্ষণে যুক্ত করেছে মাফিয়া হাসিনা। আর এখন সে নিজেই ঘরের মধ্যে বিভীষণদের সকল প্রতিষ্ঠানে, ক্ষেত্রে, ব্যবস্থায় বসিয়ে রেখে হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী ভারতের দাসী হয়ে পুনরায় সেখানে আশ্রিতা থেকে নজিরবিহীন লুটপাটের টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশবিরোধী যাবতীয় অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এ কাজে তার প্রভু হচ্ছে এ মুহূর্তে কেবলই মুসলিম নিধনকারী ‘গুজরাটের কসাই’খ্যাত মোদির বিজেপি সরকার, হিন্দুস্তানি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং, তাদের সাউথ ব্লক, তাদের গোদি মিডিয়া। আর খুবই স্বাভাবিকভাবে বরাবরের মতো মোদির বিজেপির সঙ্গে যাবতীয় বাংলাদেশবিরোধী সাম্প্রতিক কুকর্মে পূর্ণ ও প্রকাশ্য সমর্থন আর সহায়তা দিচ্ছে কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধী এবং তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা। আর বাকি সবাইও আছে একই সঙ্গে। এদের প্রেরণা রামচন্দ্রের মিথ। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেম চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, নবীন চন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, কেশব চন্দ্র সেন, কেশর বলিরাম হেজওয়ার, মাধব সদাশিব গোলওয়াকার, বিনায়ক দামোদর সাভারকার এবং লাল-বাল-পাল। এ ছাড়া বিশেষত রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এদের বাণীবাহক। এরা সবাই শিবাজির মতো ভয়ংকর মুসলিমবিদ্বেষী। এরা হিন্দুত্ববাদ, মুসলিম শুদ্ধিকরণ, যবন নিকেশের কারিগর। এদের সবার উদ্দেশ্য ঘোষিতভাবেই অখণ্ড ভারত ও রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হিন্দুত্ববাদের ভিত্তিতে। মুসলিম ক্লিনজিং এদের সবার লেখায় উৎকটভাবে এসেছে মোছলমান, যবন, ম্লেচ্ছ হিসেবে। আনন্দমঠীয় সূত্র ধরে এদের ভাবশিষ্যরা আরএসএস ও আমব্রেলা বিজেপি হয়ে লালকৃষ্ণ আদভানি, অমিত শাহ, দামোদর দাস মোদি। এদের মাধ্যমে মুসলিম নিধন, মসজিদ ভাঙা, সকল মুসলিম আর্কিটেকচারের নিচে, সকল ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপনার নিচে রামের জন্ম, হিন্দু মন্দির, শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করা হচ্ছে। আনন্দমঠীয় কায়দায় ‘মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব’। এটাই তাদের অফিশিয়াল ভাষ্য। এভাবেই ভাঙা হয়েছে বাবরি মসজিদ ও জ্ঞানবাপী মসজিদ। আরও অনেক মসজিদ আক্রান্ত হয়েছে।
এমন পটভূমিকায় বাংলাদেশকে দোহন করা ভারতীয় জাতীয় স্বার্থের টপমোস্ট জরুরত ও অগ্রাধিকার। আর এ অপকর্মে উৎখাতপ্রাপ্ত ও পলায়নকারী স্বঘোষিত ‘বিশ্বনেত্রী’ ও ভারতের বিশ্বস্ততম খাস দাসী এবং আরও সঠিকভাবে সবচেয়ে বেশি করে স্বীয় ধান্ধাতাড়িত দোসর হচ্ছে শেখ হাসিনা। আধিপত্যবাদী ভারতের হিন্দুত্ব ও অখণ্ড হিন্দুস্তান প্রতিষ্ঠা এবং ম্লেচ্ছ ও যবন বিতাড়ন-নিধন কর্মসূচির ক্রীড়নক সে হয়েছে শুধুই ক্ষমতালোলুপতার কারণে।
গত ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া যে একের পর এক কিংবা একযোগে গোপালী তাণ্ডব, আনসার লীগের সন্ত্রাস, শ্রমিক বেল্টে উস্কানো অব্যবস্থাপনা ও গোলযোগ, উচ্চ আদালতে জুডিশিয়াল ক্যুর অপচেষ্টা, ছাত্রদের মধ্যে গণ্ডগোল বাধিয়ে দেওয়া এবং সবচেয়ে বেশি করে সংখ্যালঘু কার্ড খেলা, হিন্দুত্ববাদী ও ইসকনের ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, চিন্ময় নাটক, মুসলিম আইনজীবী খুন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবৈধ মিথ্যা প্রপাগান্ডা এবং সে সঙ্গে মোদির সরকার ও হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় মিডিয়ার গোয়েবল্সীয় ফাউল প্লে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল, চট্টগ্রাম দখল, কুমিল্লা দখল, উত্তরবঙ্গ দখল, স্বাধীন বঙ্গভূমি দাবি, দু-তিনটি হিন্দু দেশ বানিয়ে ফেলার হুমকি ও আস্ফালন নিরত চলছে এই হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের হেডকোয়ার্টার্স থেকে।
এসবের মানে একটাই। কথিত মাফিয়া ফ্যাসিস্ট ও তার দুর্বৃত্ত বাহিনীকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। নিদেনপক্ষে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাদের দুর্বলতার সুযোগে বশ ও বাধ্য করা এবং সম্ভাব্য নতুন নির্বাচিত সরকারকে আগে থেকেই ফাঁদে ফেলে বশীকরণ। চাণক্যবাদীদের ধারণা, বাংলাদেশকে থ্রেট দিতে পারলে এবং ডিস্ট্যাবিলাইজ করতে পারলে আবার ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদ তাদের হারানো বাজার, দাসানুদাস জনপদ, তাদের দখলীস্বত্ব, ট্রানজিটের নামে করিডোর, চিকেন নেক-এর নিরাপত্তা এবং লুটের ভাণ্ডার হাতে পেয়ে যাবে আর তাদের সেবাদাসদেরও একটা গতি হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে বাংলাদেশে যে পরিবর্তন হয়েছে জনমানসে, সময় যে বদলে গেছে, পানি যে অনেক বেশি গড়িয়ে গেছে, তা হিসাব করতে বোধকরি হিন্দুত্ববাদীরা চাচ্ছে না—কি এ দেশের ভেতরের পঞ্চম বাহিনী, কি সীমান্তবহির্ভূত রামপন্থী রমণী রমণ রতি প্রভুরা এবং তাদের সে দেশীয় গোদি মিডিয়া। এজন্যই চলছে এত বেশি ফল্স প্রপাগান্ডা, এত বেশি মিস ইনফরমেশন এবং ডিসইনফরমেশনকেন্দ্রিক ঘোলা পানি বানানোর চক্রান্ত ও অপচেষ্টা। সেই প্রকাশ্য-প্রচ্ছন্ন হুমকি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা পুরো সীমান্তজুড়ে এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরেও চলছে। কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাই কমিশনে হামলা, ভাঙচুর, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত অবমাননা যে আন্তর্জাতিক ভিয়েনা কনভেনশনের চরম অস্বীকৃতি, তা বাংলাদেশের উপনিবেশ হারিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা নিতান্তই উদ্ভ্রান্ত হয়ে বিস্মৃত হচ্ছে।
অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ভারত তো এখন এমনই মাইনকার চিপায় পড়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে তারা শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটানে পাদুকা প্রহার খেয়েছে। ‘ইন্ডিয়া আউট’ মালদ্বীপ হয়ে এখন বাংলাদেশের ২০ কোটি মানুষের প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে। তাই আমরা ভারতের ভিসা চাইব না। ইউরোপীয় দেশগুলোর ভিসাকেন্দ্র দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায় আনার দাবি খুবই যথার্থ হবে, কেননা আমরা ভারতে যাব না। ভারতে চিকিৎসা করাব না। ভারতে বাজার করব না। ভারত থেকে আমদানি করব না। ভারতের পণ্যদ্রব্য পরিহার করব। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ করতে হবে। ভারতে বেড়াতে যাব না। ভারতে নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা দেব না। ভারতের লাখ লাখ হিন্দুত্ববাদীদের বহিষ্কার করে তার পরিবর্তে বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকারদের বিভিন্ন কর্মস্থলে কাজ দেব, নিয়োগ দেব, চাকরি দেব। দেশের অর্থ-সম্পদ দেশে রাখব। ভারতকে বুঝতেই হবে, কত ধানে কত চাল। আমাদের ফরেন কারেন্সি নিজ ভূখণ্ডের বাইরে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে যাবে না। আমাদের চিকিৎসা, ভ্রমণ, বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, যন্ত্রপাতি, সুতা ইত্যাদি কাছাকাছি অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে।
দেশের অভ্যন্তরে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, কাঁচামরিচ, ডাল, মশলা ইত্যাদির উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ফুড সাইলো স্থাপন করে সারা বছরের উপযোগী করে সাপ্লাই চেইন ঠিক রেখে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দমন করে। গার্মেন্ট শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ উপযোগী কারখানা ও শিল্প দেশি-বিদেশি কলাবরেশনে স্থাপন করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আত্মনির্ভরতার পথ ছাড়া যাবে না। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের এক ঝুড়িতে সকল ডিম রাখা যাবে না। তাদের সঙ্গে ভয়াবহ অসম বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমদানি-রপ্তানি হবে বিভিন্নমুখী এবং মাল্টিলেটারালিজম হবে সমতা প্রতিষ্ঠার শর্ত। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৯৭১ এবং ২০২৪-এর অর্জনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না তাদের চিহ্নিত শত্রু হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী ভারতকে। তবে বাংলাদেশিদের সজাগ-সচেতন থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সর্বোচ্চ মাত্রায় এবং সে অনুযায়ী যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলতে বাধ্য হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ, অখণ্ডত্ব ও সার্বভৌমত্বকে এবং আমাদের জিও পলিটিক্যাল অ্যাডভানটেজকে বিকিয়ে দিয়ে ভেতরে-বাইরে কেউ যেন কোনো ফাউল প্লে করতে না পারে, তা নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, বাহিনীসমূহ, প্রতিষ্ঠানাদি, কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা, মিডিয়া, বহির্বিশ্বে রেগুলার ইফেকটিভ কমিউনিকেশনসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, দায়, করণীয়, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, আন্তঃসংযোগ ইত্যাদি যাবতীয় কিছুকে অপটিমাম, ব্যালেন্সড এবং ডিজায়ার্ড স্ট্যান্ডার্ডে আনতে হবে এবং সাসটেইন করাতে হবে।
কিছু কথা আমাদের কালেকটিভ মেমোরি হিসেবে স্থায়ীভাবে সমষ্টি সত্তার মধ্যে গেঁথে ফেলতে হবে যে, জুলাই ২০২৪ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঝ দিয়ে ফ্যাসিস্ট মাফিয়া রানী পালিয়েছে। তাকে ও তার ষণ্ডাগুণ্ডা বাহিনীকে আন্ডার এস্টিমেন্ট করা যাবে না। সুযোগ পেলেই তারা ছোবল মারবে বিষধর সাপের মতো। দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতর হিন্দুত্ববাদ, ইসকন, এই পরিষদ-ওই সংঘ নামে ফিফ্থ কলামিস্টরা যেন সামান্যতমও অরগানাইজড নুইসেন্স ও টেরর করতে না পারে। তৃতীয়ত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, দেশরক্ষা বাহিনী যেন দায়দায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে থাকে। সে সঙ্গে রুল অ্যাপ্লিকেশন ও রুল অ্যাডজুডিকেশনের কাজ জনইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে হবে, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণধর্মী হতে হবে। চতুর্থত, একই মহৎ সমষ্টি-কল্যাণ নিয়ে এবং ইনভেস্টিগেটিভ ও অবজেক্টিভ জার্নালিজম নিয়ে পাশাপাশি মাস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও যেন জনপ্রহরার মধ্যে থেকে যথাযথ ইতিবাচক অর্থে তাদের কাজ ও দায় পালন করতে পারে দায়িত্বশীলতার সীমায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব থাকবে জনগণের, নাগরিক সমষ্টির, এনলাইটেন্ড গ্রুপ ও যথার্থ অর্থে নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ও প্রকৃত সিভিল সোসাইটির ওপর। স্পষ্ট কথা হচ্ছে, নিজেদের দেশ, মানচিত্র, ভূগোল, সীমান্ত, সম্পদ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডত্ব, ঐক্যবদ্ধ সচেতন সম্মতি ও সমষ্টি-ইচ্ছা আর সম্ভাবনাকে নিজেরাই পাহারা দিতে হবে, টেকাতে হবে এবং সর্বজনীন কল্যাণে স্বনিয়ন্ত্রণে কার্যকর রাখতে হবে। এ ছাড়া আমাদের সিটিজেন আর্মি গড়ে তুলতে হবে তরুণ-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে।
তাযাক্কুর, বয়ান, হাকিকত
বাংলাদেশের জনগণ, ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক দলসমূহ, সরকার, প্রশাসন, বাহিনীসমূহ, সিভিল সোসাইটি সবাইকে খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মাফিয়া রানী হাসিনার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী রেজিমের অবসান হয়েছে। হাসিনা পালিয়ে গেছে তার প্রভুর কাছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী মেন্টাল মেইক-আপ যেমন রয়ে গেছে, তেমনি একযোগে চলছে অন্তর্ঘাত ও পঞ্চম বাহিনীর একের পর দুষ্কর্ম আর উদ্দেশ্যমূলক উস্কানি।
আর দেশের বাইরে হিন্দুত্ববাদী মোদির বিজেপি সরকার, তাদের সীমান্তরক্ষী ও সামরিক বাহিনীর অশুভ তৎপরতা; সে সঙ্গে চলছে মোদির গোদি মিডিয়ার ভয়ংকর মতলবি ও মিথ্যা-অপপ্রচার তাণ্ডব। এখানে যেটা খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং আমাদের জনগণের কালেকটিভ মেমোরিতে গভীর শেকড় গেঁথে রাখতে হবে সীমান্ত-বহির্ভূত হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী হুমকি, হুঙ্কার, হামলা, অন্তর্ঘাত বাংলাদেশকে বিপদে ফেলে নিজেদের করায়ত্ত করার অপচেষ্টা এবং কেবল মোদির বিজেপি, মমতার তৃণমূল বা রাহুলের কংগ্রেসের সঙ্গেই যুক্ত নয়, শেষও নয়। এর সঙ্গে রয়েছে চাণক্য রাজনীতি, জিও পলিটিক্যাল আধিপত্য বিস্তারের গূঢ় মতলব। হিন্দুস্তানের ‘র’ ও সাউথ ব্লকের টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশ।
এই ইন্ডিয়ান হেজিমনির সঙ্গে একেবারেই যুক্ত অবিচ্ছেদ্যভাবে সর্বকালের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ। সে সঙ্গে বাংলাদেশকে দখল করে অখণ্ড ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার ‘র’-এর বদ পরিকল্পনার সঙ্গে রয়েছে পে-রোলে থাকা লুমপেন এজেন্ট বাংলাদেশের মধ্যকার হিন্দুত্ববাদী কোনো কোনো গোষ্ঠী, ফ্রন্ট, সমাজ, মোর্চা ও পরিষদ। এদের কেউ কেউ প্রকাশ্য সভায়, বক্তব্য-বিবৃতিতে বাংলাদেশকে মোদির বিজেপি সরকারের সহায়তায় অখণ্ড ভারতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করে, খুব স্পষ্ট ঘোষণা দেয় বঙ্গভাষায়। এরা মাত্রাতিরিক্ত মিডিয়া কাভারেজ পায় ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট মাফিয়া আওয়ামী সরকারের দাস হিসেবে অপারেট করা সাংবাদিক নামক সাংঘাতিক ও ভোল পাল্টানো চ্যানেলগুলোর প্রশ্রয়ে। সবচেয়ে বিধ্বংসী অবস্থায় রয়েছে একটি ইংরেজি ও দুটি বাংলা দৈনিক। এই পঞ্চম বাহিনীর অপতৎপতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাধ্য করতে হবে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য, যাতে নতুন করে বা ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ ভারতীয় যোগসাজশে যে কোনো কোয়ার্টার ও কর্নার থেকে না আসতে পারে।
কিন্তু এই যে কেন্দ্রীয় বিবেচনা এবং বর্তমান প্রবন্ধের শিরোনাম, তাতো বিস্মৃত হওয়া যাবে না। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান হেজিমনি বা ভারতীয় আধিপত্যবাদ, হিন্দুত্ববাদ, অখণ্ড ভারত পরিকল্পনা, আসমুদ্র হিমাচল রাম রাজত্ব—এসব কিন্তু রয়েই যাচ্ছে স্থায়ী ফ্যাক্টর হিসেবে সবচেয়ে বিপজ্জনকভাবে এবং এরা বাংলাদেশকে ছাড়বে না; সুযোগের ষড়যন্ত্রের ভেতর নিরবচ্ছিন্নভাবে থেকেই যাবে।
এ কারণেই ইন্ডিয়ার হেজিমনি বা ভারতীয় আধিপত্যবাদ, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ, হিন্দুস্তানি সম্প্রসারণবাদ, অখণ্ড ভারত, রাম রাজত্ব, হিন্দুস্তানি ম্লেচ্ছ-যবন-আগন্তুক থিসিস, তা কেবল মুসলিম ও ইসলামবিরোধিই নয়। এটা একই কারণে ৯২ ভাগ মুসলিমের বাংলাদেশবিরোধী এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিবেচনায় আমাদের জিও-পলিটিক্স বা ভূ-রাজনীতির বাস্তবতায় প্রায় পারমানেন্ট অপারেশনাল অ্যারিনা, থিয়েটার, ফ্রন্ট, অ্যাসপেক্ট হয়ে থাকবে।
একটু পেছনের দিকে যাওয়া গেলে ইতিহাসের দিকে গভীর ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বিষয়াদি বুঝা যাবে। এটা করলেই খুব স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ, ভারতীয় আধিপত্যবাদ, অখণ্ড ভারত, রাম রাজত্ব স্বপ্ন, ম্লেচ্ছ-যবন মুসলিমবিরোধিতা, অসংখ্য রায়টে, কাউ কিলিং রায়টে মুসলিম নিধন-সংহার-বধ-হত্যা; অবিরত হেইট ক্যাম্পেইনের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সংশ্লেষ শতভাগ। এসবের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী, রামপন্থী, অখণ্ড ভারতপন্থী রাজনীতি, দল, সংগঠন, নেতৃত্ব ও জনসমাজের বৃহদাংশের যোগসূত্র ও ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় পাতায়, বাঁকে বাঁকে অবিচ্ছেদ্য রেকর্ড রেখে যাচ্ছে। সাক্ষ্য হয়ে থাকছে আমাদের মুসলিমদের, বাংলাদেশের মানুষের এবং বিশ্বমানবের শিক্ষা লাভের নিমিত্তে।
‘আনন্দমঠ’-এর নেড়ে-যবন বধ এবং হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসলমান ইনসান হো তো জানোয়ার কৌন হো’র ইতিহাস সূত্রের সঙ্গে আজকের বাল ঠাক্রের ‘মুসলমানদের পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে খেজুর বাগানে (অর্থাৎ আরবে-বর্তমান লেখক) পাঠিয়ে দেওয়া হবে’- এসব তো একই পরম্পরায় গ্রথিত। অথচ প্রমাণিত যে, ভারতবর্ষে এবং বাংলায় আর্যরা নিজেরাই বাইরে থেকে আসা দখলদার। তারা যুদ্ধ করে স্থানীয় আদি অধিবাসীদের পরাজিত করে ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতে (বাংলাসহ) শাসক ও মূল প্রভাবক শক্তি হয়ে ওঠে। তারা তাদের বৈদিক ধর্মসহ নিজেদের উচ্চ বর্ণের (হায়ার কাস্ট) বলে ঘোষণা দেয় এবং ধর্মীয় সূত্র তৈরি করে। তাদের মতে, অন্য অনার্যরা স্থানীয় আদিম অধিবাসী এবং সাত শতক থেকে ভারত-বাংলা অঞ্চলে আসা মুসলিমরা আক্রমণকারী ভিনদেশি। ফারসি বা পাহ্লবি ভাষায় ভারতের সিন্ধু নদ বা সিন্ধু অঞ্চলের নাম উচ্চারণে ‘সিন্ধু’ বদলে গিয়ে ‘হিন্দু’ উচ্চারণটি একসময় এখানে কথায়, ভাষায়, অভ্যাসে ও বাস্তবে বিস্তৃতি পায়। এভাবে মূর্তিপূজার, দেব-দেবীর, তেত্রিশ কোটি দেবতার বৈদিক ধর্ম সনাতন থেকে হিন্দু নামে প্রচারিত ও চিহ্নিত হয়। হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদকে আশ্রয় করে হিন্দুত্বের পরিচিতি গ্রহণ করে। হিন্দুদের মাঝে চারটি কাস্ট বা বর্ণ আছে। সর্বোচ্চ পূজারী পণ্ডিত ও সম্মানীয় হচ্ছে ব্রাহ্মণ। এরপর ক্ষত্রীয়। এরপর বৈশ্য। আর সবশেষে সর্বনিম্ন অচ্ছুৎ হচ্ছে শূদ্র। অর্থাৎ নমঃশূদ্র। ভিন্নভাষায় হরিজন। আনটাচেবল্স। অস্পৃশ্য এরা। অথচ এই সেদিন চট্টগ্রামে এই নমঃ অস্পৃশ্য দাসদের একজন নিরপরাধ মুসলিম আইনজীবী এবং সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ চেইজ করে তাকে ভৈরব থেকে পালানোর পথে গ্রেপ্তার করেছে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হচ্ছে পূজারী। গায়ে খাটে না। কিন্তু ভেট পায় সর্বত্র, সকলভাবে। এটাকে ধর্মীয় বিধান বানানো হয়। ক্ষত্রীয়রা যুদ্ধ করে বিধায় অকর্মা ব্রাহ্মণের কাছে মূল্য পায়। এরপর বৈশ্য বা বণিক ব্যবসায়ী; লেনদেন কায়-কারবারীরা। এরাও খানিকটা মূল্য পায়। কেননা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান, সরবরাহ এদের মাধ্যমেই হয়। এরা না থাকলে তো চলে না। আর অবশেষে হলো শ্রমজীবী আসল মেহনতি মানুষদের দল শূদ্র। এরা নমঃ, হরিজন, অস্পৃস্য দাস।
হিন্দুদের কাস্টে বিভাজন বাস্তবে আরও বহু উপস্তরে বিভাজিত হয়েছে। এদের ব্রাহ্মণরা বড়লোক, উচ্চবর্ণের; তা দরিদ্র হলেও এদের মুফতে পাওয়া অনেক। আর সর্বনিম্নের কাস্ট শূদ্র, নমঃ দাসরা, ছোটলোক, অস্পৃশ্য। এদের ‘ছায়া মাড়ালে নাইতে হবে’। ‘পণ্ডিত এস্তেছে। ছোটলোক সব তফাৎ যা’। এটাই ব্রাহ্মণদের দাম্ভিক ঘোষণা। এরা একসঙ্গে বসা, ছোঁয়াছুঁয়িতে আসা, ব্রাহ্মণের বাসনে-থালায়-গ্লাসে খাওয়া ও জল (পানি) পান করতে পারে না। এরা সেটা করলে বা বৈদিক ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে ‘রৌরব’ নামক নরকে চলে যাবে। হিন্দুরা পুনঃপুন জন্ম-মৃত্যুতে বিশ্বাসী। এসব একেবারেই বৈপরীত্য তৈরি করে ইসলামিক মনোথিইজম তথা তৌহিদভিত্তিক ইসলাম ও মুসলিমদের সঙ্গে।
হিন্দুদের যে কাস্ট সিস্টেম, সেটি তারা নীতি-ধর্ম, জাত-পাত, মানব অসাম্যের অনাচারসহ মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিতে তৎপর। মুসলিমদের সঙ্গে স্পর্শ, খাওয়া, তাদের বাসন-ঘটি-বাটি ব্যবহার করা বা নিজেদেরটা ব্যবহার করতে দেওয়া নিষিদ্ধ। কারণ, মুসলিমরা যবন, ম্লেচ্ছ। মুসলিমরা এদের ঘরে, মন্দিরে গেলে তাদের শরীরের স্পর্শে সেসব অপবিত্র হয়ে যায়। তাই স্নান বা চান করতে হয়, গোবর-জল গ্রহণ করে শুদ্ধ হতে হয়। এদেরই মন্তব্য হয়, ‘ও মা, আমি তো ভেবেছিলুম তুমি ভদ্রলোকের ছেলে। এখন দেখি তুমি মোছলমান’—এটাই সত্য। তাই বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের আপাত বেড়া লঙ্ঘন রাজনৈতিক মতলবপ্রসূত। ইদানীং তাদের স্বরূপ ভালোভাবেই উন্মোচিত হয়েছে।
এই উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের অত্যাচারে নমঃশূদ্র, অস্পৃশ্য, ছোট জাতের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়ে ড. বিআর আম্বেদকর একবার গণভাবে সবাই মুসলিম হতে চেয়েছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার হুমকি দিয়েছিলেন। ফলে গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল এবং আরও উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতৃবৃন্দ আম্বেদকরের কাছে গিয়ে মার্জনা চেয়ে এবং তাদের সমতা-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সনাতনী হিন্দুত্ববাদ রক্ষার প্রয়াস পান। লক্ষণীয় যে, হিন্দুদের মধ্যে উচ্চবর্ণের তিন বর্ণের লোকেরা বিশেষত ব্রাহ্মণরা সংখ্যায় অতি লঘিষ্ঠ। সেকালেও যেমন তেমনি বর্তমান কালের ভারতে। এখনকার বাংলাদেশেও তা-ই। কেবল মুসলিমদেরকে মোকাবিলা করার জন্যই উচ্চবর্ণের তথাকথিত আর্য হিন্দুত্ববাদী মোড়লরা সনাতনী ঐক্য ধরে রেখেছে। এখনও পূজা করায়, বেদীতে উঠায়, মন্ত্র কার্যে, ধর্মগ্রন্থ পাঠে, মর্যাদায় গরিষ্ঠ হিন্দু নিচু জাতের লোকেরা অপাঙক্তেয়। হরিজন মানুষরা কাস্ট সিস্টেমের সবচেয়ে বড় শিকার। হিন্দুদের মধ্যে বিয়েতে, সামাজিকতায় কাস্ট বা বর্ণ খুব বড় ফারাককারী নিষিদ্ধতার শর্ত। তাদের সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ভিত্তিহীন এত বেশি বেইনসাফি নিয়ে।
এখন এই হিন্দুত্ববাদীরা ভারত ও বাংলাদেশ এবং পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারতের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে মহাহিন্দু জাতি, অখণ্ড ভারত, হিন্দুত্ববাদী আসমুদ্র হিমাচল রাম রাজত্ব কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। এটাকে তারা ধর্মীয় বোধ, সামাজিক বিবেচনা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নাগরিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক চিন্তা কাঠামোয় ন্যারেটিভ বা বয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। অতএব, হিন্দুত্ব ও রাম রাজত্বসহ অখণ্ড ভারত তাদের আরাধ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতের মধ্যে এবং বাংলাদেশসহ চারপাশের বিভিন্ন অঞ্চল ও জনপদ তাদের জন্য বাধা। তাই তারা চাণক্য কূটকৌশলে, ছলে-বলে দালাল ও পঞ্চম বাহিনী সৃষ্টি করে। সন্ত্রাস ও যুদ্ধ করে এবং অবিরত হিন্দুত্বে ফেরত যাবার আজগুবি আবদারের মাধ্যমে আদি সনাতনী হবার জন্য ভারতের অভ্যন্তরে সর্বত্র এবং বাংলাদেশেও ইসকনী প্রকল্পকে বিস্তৃত করেছে। এভাবেই অখণ্ড ভারত দেশমাতৃকা দেবীর জন্য জয় হিন্দ, জয় শ্রীরাম, হরি হরি, হরি বোল সর্বত্র ছড়ানো হচ্ছে। হিন্দু মহাসভা, গো-রক্ষা সমিতি, আরএসএস, শিবসেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, বিজেপি সবকিছু ভারতে সার্বক্ষণিক ভূমিকায় রত। বাংলাদেশে এত সংঘ, সমিতি, পরিষদ, মোর্চা আর তারপরও ইসকন—সবই সনাতন হিন্দুত্ববাদ-সংশ্লিষ্ট। এদের মূল টার্গেট মুসলিমরা। আর জয় অখণ্ড ভারত, জয় হিন্দ, জয় রাম রাজ। এখানে হয় মুসলিমরা সনাতনে ঢুকতে হবে, নতুবা বাল ঠাক্রের ভাষায় ‘পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে খেজুর বাগানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে’। এই যে প্রায় দুই শত বছর ধরে আজ অবধি এত রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মুসলিম গণহত্যা, সম্পদ, বাড়িঘর লু্টপাট, হিন্দুত্ববাদী ভারতে হচ্ছে; এই যে প্রায় দুই শত বছরে বহু হাজার বার হিন্দুত্ববাদীরা মরণ কামড় দিয়েছে, হত্যালীলায় মেতেছে ব্রিটিশ আমলে, স্বাধীন ভারতে এবং আজকের দিনের হিন্দুস্তানে। এর কারণ কী? এত যে হাজার হাজার মুসলিমকে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত, নিঃস্ব-ক্ষতিগ্রস্ত আর হত্যার শিকার করা হয়েছে, তার বিপরীতে ৯২ ভাগ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশে ৭ ভাগ হিন্দুর উপর কোথায় হয়েছে হত্যাকাণ্ড? রাজনৈতিক কারণে যা কিছু সামান্য নিপীড়ন, ভাঙচুর হয়েছে, তা তো তারা নিজেরা মাফিয়াদের দলদাস হয়েছে বলে। এছাড়া, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দ্বারাই তাদের রাজনীতির ট্রাম্পকার্ড হিসেবে, তাদের ভোট ব্যাংক হিসেবে হিন্দুদের অবস্থানের কারণেই তা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হাসিনার সময় বিগত ১৬ বছর নিপীড়নের শিকার হয়েও তারা কেন চুপ ছিল? সর্বশেষ চট্টগ্রামে মুসলিম আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে সনাতনী ইসকনের সংশ্লিষ্ট হয়ে হিন্দুত্ববাদের অনুসারীরা। যে লোকটি একের পর এক কোপ দিয়েছে, সে তো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একজন হিন্দু পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বর্ণ হিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য, নমঃ, দাস। তাহলে ব্রাহ্মণ্যবাদ আর অস্পৃশ্যরা এক মোহনায় মিলেছে কেবলই অখণ্ড ভারতের রাম রাজত্বের স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
এর আগে ফরিদপুরের মধুখালীতে হুফ্ফাজ আল কুরআন দুই ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারও আগে সিলেটে এক ইমামকে হত্যা করার পরও কিন্তু হিন্দুরা কি এদেশে নিরাপদে থাকেনি? বাংলাদেশের পতাকার উপর গেরুয়া রঙের হিন্দুত্ববাদী ইসকনী পতাকা লাগিয়ে জাতীয় পতাকাকে অপমান করার পরও কি শুধু মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া কী দেখেছে হিন্দুরা? চিন্ময়কে আন্তর্জাতিক ইসকন দুর্নীতি, শিশু বলাৎকার, অবৈধ নারী সম্পর্কসহ চারিত্রিক স্খলনের কারণে বহিষ্কারের পরও কীভাবে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর সনাতনীরা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে এত তাণ্ডব চালায়। কীভাবে বিভিন্ন সংঘ, পরিষদ, মোর্চা এত বেশি বিশৃঙ্খলা করে? কীভাবে তারা স্বাধীন বঙ্গভূমিসহ দেশের আরও দুই-তিনটি অঞ্চলে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে, হুমকি দেয়? এত বেশি দেশ ও রাষ্ট্রদ্রোহী আচরণের পরও তারা অক্ষত থাকে কেবলই ৯২ ভাগ মুসলিমের ‘লা ইকরাহা ফিদ দীন’ (কুরআন-২:২৫৬)-এর শর্তে সহিষ্ণুতার কারণে। বিগত ১৬ বছর তারা চাকরি, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, পদ দখল, ব্যবসা-বাণিজ্য, তাদের হারের তুলনায় অকল্পনীয় অধিক পরিমাণে লাভ করেছে। তা তারা পেয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের শাসনে নেতৃত্ব ভারতীয় সেবাদাসী হবার কারণেই। এখন তাদের উন্মাদনা হিন্দুত্ববাদী রাজত্ব চলে গেছে বলে।
কিন্তু এত সত্যের পরও কীভাবে ভারতে তো বটেই, এমনকি বাংলাদেশ থেকে, এখানকার নাগরিক হয়ে দেশটিকে টুকরো টুকরো করার এবং অখণ্ড ভারতে মিলিয়ে দেবার কল্পিত ও অভীষ্ঠ রাম রাজত্বে অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়ার মানসে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দেয় তারা নব্য আমদানি কূটকৌশল হিসেবে। এমনকি পূজার প্রসাদ খাইয়ে চট্টগ্রামে প্রাথমিক স্কুলের মুসলিম বাচ্চাদের দিয়ে বারংবার ঘণ্টা ধরে দেওয়ানো হয় একই ধ্বনিসমূহ। কীভাবে হরে কৃষ্ণ হরে রাম, জয় শ্রীরাম, হরি হরি হরি বোল উচ্চারণ করানো হয় সমবেতভাবে এবং তা-ও আবার মুসলিম শিশুদের দিয়ে?
সূত্র আসলে কৌটিল্য চালে, চাণক্য ষড়যন্ত্রে এবং তা হিন্দুত্ববাদী ভারতের ইশারায় ঘটছে। ভারতের রাজনীতি, স্বার্থ, কূটনীতি, ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজন পূরণে এখানে এক্সটেন্ডেড উইং হিসেবে কাজ করা তো সম্পূর্ণ দেশদ্রোহিতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা। অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে এ দেশের নাগরিক হয়ে এবং মুসলিম নিধন করে? এই সত্য তো নির্লজ্জ এক তথাকথিত নারীর লেখায়ও অতি-উৎকটভাবে তুলে ধরা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। অখণ্ড ভারত তো হিন্দুত্ববাদী রাম রাজত্বের স্বপ্নে বিভোর। এটাই তো আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ভারত; হিন্দুস্তানের আসল চেহারা। আমরা বাংলাদেশের ৯২ ভাগ তাওহিদী জনতা তা চাইব কেন? ভারতকে তো নিজের সীমার মধ্যে থাকতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি ও দাদাগিরি করতে গিয়ে ভারত আশে-পাশের সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে লাগতে গেলে তো উপযুক্ত জবাব পাবে। শুধু বাংলাদেশকেই আওয়ামী লীগ ও দাসী নেতৃত্ব পেয়ে বেকায়দায় ফেলেছিল তারা। তাও গেছে তাশের ঘরের মতো ধ্বংস হয়ে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এজন্য ভারত ও তার দাস দলের এত মর্মপীড়া আর শিরঃপীড়া। তাই উন্মাদ হয়ে অমিত শাহ বলে, এখন খালি ধরবে আর উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখবে।
তবে আমরা বলে রাখছি, এখন থেকে ভারতের সঙ্গে চোখ চোখ রেখে কথা বলতে হবে, কাজ করতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের বিদেশনীতি ও ভারত সম্পর্কিত নীতি হবে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডত্ব, ভূ-রাজনৈতিক কৌশল এবং স্বাধীন সমমর্যাদার দৃঢ়তম অবস্থান নিয়ে। প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কের কথা ভুলে যান। এটা আর হবে না। এ এক নতুন সময়ের বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ। এখানে মাথা তুলে দাঁড়ানো ২০ কোটি মানুষ হিন্দুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবিলায় সবাই গ্ল্যাডিয়েটর, সবাই নির্ভীক লড়াকু সৈনিক। জান যাবে, তবুও মান যেতে দেব না। অসম চুক্তি, গোপন চুক্তি, অসম সম্পর্ক, অবৈধ সুযোগ, অসম বাণিজ্য, একতরফা পিঠাভাগ ও খাই খাই দাদাগিরি, অবৈধ অবস্থান এবং পাচার, সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিটের নামে মাল্টি মোডাল করিডোর, পানিসন্ত্রাস, তথ্যসন্ত্রাস, হিন্দুত্ববাদী হুমকি, পঞ্চম বাহিনীর সন্ত্রাস—সবকিছুর অবসান করতে হবে। আপাতত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের সমগ্র মানুষের সমষ্টিসত্তার অতি স্পষ্ট ব্যক্ত ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। নীতি, কৌশল, কার্যক্রম, পাল্টা ব্যবস্থার মাধ্যমে ফিরে আসবে আমাদের স্বাধীনতা। পরে এসব করবে, এগিয়ে নেবে নির্বাচিত সরকার। হাস্বুনাল্লাহ ওয়া নিয়ামাল ওয়াকীল। নিয়ামাল মওলা ওয়া নিয়ামান নাসির।
লেখক: প্রফেসর (অব.), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইল্ম, আকল, নিয়ত
১৯৭১-এ অগণ্য রক্তের বিনিময়ে জনযুদ্ধে সাফল্য লাভ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। যেটাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি, স্বাধীনতার যুদ্ধ বলি। কিন্তু এরপর ৫৩ বছর কেটে গেলেও আমরা এই বাংলাদেশি জনগণ নিজেদের বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, অনাচার থেকে যেমন মুক্ত করতে পারিনি, তেমনি পাইনি প্রকৃত স্বাধীনতা। কি দেশের ভেতরে, কি দেশের বাইরে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, বিগত ১৬টি বছর ধরে স্বৈরতন্ত্র, মাফিয়াতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে রাখা হয়েছিল দেশের ওপর, জনগণের ওপর এবং তা ব্যক্তিক, পারিবারিক জমিদারিতে পরিণত হয়েছিল। দাসানুদাস বানিয়ে রাখা হয়েছিল ২০ কোটি মানুষকে। জনইচ্ছাকে অস্তিত্বহীন করা হয়েছিল। মিথ্যাচার, অনাচার, দম্ভ, অসভ্যতা, লুট-লুচ্চামি, পাচার, দখলদারি, মামলা-হামলা, জেল, গুম, খুন, আয়নাঘর, ভারতের কাছে দেশের যাবতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া—সবই করেছে উৎখাতপ্রাপ্ত দিল্লি-দাসীর অবৈধ সরকার। দেশকে, দেশের সম্পদকে, দেশের মানুষের প্রাপ্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে একদিকে নিজেরা লুটের ভাগাড় বানিয়েছে, অন্যদিকে ভারতের উপনিবেশ, করদরাজ্য ও হিন্টারল্যান্ডের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশকে। হুকুম ভারতের, লুটতরাজ ভারতের, খবরদারি ভারতের, দাদাগিরি ভারতের, ছবক ভারতের। এত দেওয়া হয়েছে যে, ভারত কোনোদিন ভুলবে না। কেননা, স্বঘোষিত সম্পর্ক তো স্বামী-স্ত্রীর। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে গত ১৬ বছরে। সব জায়গায় হয়েছে নিকৃষ্টতম দলীয়করণ, রাজনীতিকরণ। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গোপালীকরণ, আওয়ামীকরণ ও সনাতনীকরণ। কুক্ষিগত করা হয়েছে এক হাতে সকল ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত, বরাদ্দ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার। গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম, সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি, বিদেশনীতি এবং সকল পলিসি, প্রোগ্রাম, প্রজেক্টকে দানবীয়ভাবে দখল ও বলাৎকারকরত পদানত করে রাখা হয়েছে সংকীর্ণতম ব্যক্তিক উন্মাদনা ও খাই-খায়েশ মেটাতে।
এই প্রক্রিয়ায় দেশ গেছে ধ্বংসের কিনারে, লুটতরাজ ও পাচারের মাৎস্যন্যায় ঘটেছে এবং অ্যাক্রস-বর্ডার উল্ফল্যান্ড থেকে একতরফা মাস্তানি ও মুনাফা করেছে মোদির বিজেপি নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী ও আধিপত্যবাদী ইন্ডিয়া বা ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত বা হিন্দুস্তান। সে জন্যই ২০২৪-এর অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমষ্টি জনতা উৎখাত করেছে দুই হাজার জীবনদান এবং বহু হাজার আহত হওয়া; সেই সঙ্গে নজিরবিহীন ক্ষতি ও ত্যাগের বিনিময়ে মাফিয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও দুর্বৃত্তের আস্তাকুঁড় আওয়ামী লীগ জঞ্জালকে।
মাফিয়া রানী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ২৮ লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়ে তাদের প্রভু হিন্দুত্ববাদী, আধিপত্যবাদী ভারতে পালিয়ে গেছে এবং অনেককেই অন্তর্ঘাত করে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী ভারত, আধিপত্যবাদী ভারত এতদিন ইচ্ছেমতো বাংলাদেশকে লুট করেছে, নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং নিজেদের সম্প্রসারণবাদী অবৈধ স্বার্থ হাসিল করেছে। দৃশ্যত মাফিয়া হাসিনা ও আওয়ামী গুণ্ডাপাণ্ডা-খুনিরা মনে করেছিল এবং সদম্ভ ঘোষণা দিয়েছিল যে, দেশ তাদের বাপের সম্পত্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায় সয়লাব করেছিল দেশকে। তাদের একচ্ছত্র জমিদারিতে ২০ কোটি মানুষ ছিল ক্রীতদাস-প্রজা। আর তাদের প্রভু ভারতও ভেবেছিল চিরস্থায়ী মৌরসী পাট্টা বানিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশকে এবং রমণী রমণ রতিদেব হয়ে উঠেছে সে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তার পিতা আওয়ামী লীগসহ উৎখাত হওয়ার পর হাসিনা ভারতের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল এবং চাণক্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী এজেন্টের প্রশিক্ষণ নিয়ে দয়াদ্র ভুল সিদ্ধান্তের সুযোগে ঢুকেছিল দেশে এবং খুন করিয়েছিল তার প্রভুদের ‘র’-এর দ্বারা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্বাধীনচেতা নেতা জিয়াউর রহমানকে। তেমনি এবারও ১৬ বছর হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী ভারতকে ১৯৭২-১৯৭৫-এর ন্যায় রসনা ও রমণ সুখ দিয়ে সে ও তার ফ্যাসিস্ট বাহিনী অবশেষে লাথি খেয়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের কোলে, স্ব-স্বীকৃত স্বামীর আশ্রয়ে।
ইতঃপূর্বে কন্যাকে ভারতে পোস্টেড করে ‘র’-এর প্রশিক্ষণে যুক্ত করেছে মাফিয়া হাসিনা। আর এখন সে নিজেই ঘরের মধ্যে বিভীষণদের সকল প্রতিষ্ঠানে, ক্ষেত্রে, ব্যবস্থায় বসিয়ে রেখে হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী ভারতের দাসী হয়ে পুনরায় সেখানে আশ্রিতা থেকে নজিরবিহীন লুটপাটের টাকা ব্যয় করে বাংলাদেশবিরোধী যাবতীয় অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এ কাজে তার প্রভু হচ্ছে এ মুহূর্তে কেবলই মুসলিম নিধনকারী ‘গুজরাটের কসাই’খ্যাত মোদির বিজেপি সরকার, হিন্দুস্তানি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং, তাদের সাউথ ব্লক, তাদের গোদি মিডিয়া। আর খুবই স্বাভাবিকভাবে বরাবরের মতো মোদির বিজেপির সঙ্গে যাবতীয় বাংলাদেশবিরোধী সাম্প্রতিক কুকর্মে পূর্ণ ও প্রকাশ্য সমর্থন আর সহায়তা দিচ্ছে কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধী এবং তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা। আর বাকি সবাইও আছে একই সঙ্গে। এদের প্রেরণা রামচন্দ্রের মিথ। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেম চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, নবীন চন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, কেশব চন্দ্র সেন, কেশর বলিরাম হেজওয়ার, মাধব সদাশিব গোলওয়াকার, বিনায়ক দামোদর সাভারকার এবং লাল-বাল-পাল। এ ছাড়া বিশেষত রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এদের বাণীবাহক। এরা সবাই শিবাজির মতো ভয়ংকর মুসলিমবিদ্বেষী। এরা হিন্দুত্ববাদ, মুসলিম শুদ্ধিকরণ, যবন নিকেশের কারিগর। এদের সবার উদ্দেশ্য ঘোষিতভাবেই অখণ্ড ভারত ও রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হিন্দুত্ববাদের ভিত্তিতে। মুসলিম ক্লিনজিং এদের সবার লেখায় উৎকটভাবে এসেছে মোছলমান, যবন, ম্লেচ্ছ হিসেবে। আনন্দমঠীয় সূত্র ধরে এদের ভাবশিষ্যরা আরএসএস ও আমব্রেলা বিজেপি হয়ে লালকৃষ্ণ আদভানি, অমিত শাহ, দামোদর দাস মোদি। এদের মাধ্যমে মুসলিম নিধন, মসজিদ ভাঙা, সকল মুসলিম আর্কিটেকচারের নিচে, সকল ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপনার নিচে রামের জন্ম, হিন্দু মন্দির, শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করা হচ্ছে। আনন্দমঠীয় কায়দায় ‘মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব’। এটাই তাদের অফিশিয়াল ভাষ্য। এভাবেই ভাঙা হয়েছে বাবরি মসজিদ ও জ্ঞানবাপী মসজিদ। আরও অনেক মসজিদ আক্রান্ত হয়েছে।
এমন পটভূমিকায় বাংলাদেশকে দোহন করা ভারতীয় জাতীয় স্বার্থের টপমোস্ট জরুরত ও অগ্রাধিকার। আর এ অপকর্মে উৎখাতপ্রাপ্ত ও পলায়নকারী স্বঘোষিত ‘বিশ্বনেত্রী’ ও ভারতের বিশ্বস্ততম খাস দাসী এবং আরও সঠিকভাবে সবচেয়ে বেশি করে স্বীয় ধান্ধাতাড়িত দোসর হচ্ছে শেখ হাসিনা। আধিপত্যবাদী ভারতের হিন্দুত্ব ও অখণ্ড হিন্দুস্তান প্রতিষ্ঠা এবং ম্লেচ্ছ ও যবন বিতাড়ন-নিধন কর্মসূচির ক্রীড়নক সে হয়েছে শুধুই ক্ষমতালোলুপতার কারণে।
গত ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া যে একের পর এক কিংবা একযোগে গোপালী তাণ্ডব, আনসার লীগের সন্ত্রাস, শ্রমিক বেল্টে উস্কানো অব্যবস্থাপনা ও গোলযোগ, উচ্চ আদালতে জুডিশিয়াল ক্যুর অপচেষ্টা, ছাত্রদের মধ্যে গণ্ডগোল বাধিয়ে দেওয়া এবং সবচেয়ে বেশি করে সংখ্যালঘু কার্ড খেলা, হিন্দুত্ববাদী ও ইসকনের ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, চিন্ময় নাটক, মুসলিম আইনজীবী খুন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবৈধ মিথ্যা প্রপাগান্ডা এবং সে সঙ্গে মোদির সরকার ও হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় মিডিয়ার গোয়েবল্সীয় ফাউল প্লে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল, চট্টগ্রাম দখল, কুমিল্লা দখল, উত্তরবঙ্গ দখল, স্বাধীন বঙ্গভূমি দাবি, দু-তিনটি হিন্দু দেশ বানিয়ে ফেলার হুমকি ও আস্ফালন নিরত চলছে এই হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের হেডকোয়ার্টার্স থেকে।
এসবের মানে একটাই। কথিত মাফিয়া ফ্যাসিস্ট ও তার দুর্বৃত্ত বাহিনীকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। নিদেনপক্ষে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাদের দুর্বলতার সুযোগে বশ ও বাধ্য করা এবং সম্ভাব্য নতুন নির্বাচিত সরকারকে আগে থেকেই ফাঁদে ফেলে বশীকরণ। চাণক্যবাদীদের ধারণা, বাংলাদেশকে থ্রেট দিতে পারলে এবং ডিস্ট্যাবিলাইজ করতে পারলে আবার ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদ তাদের হারানো বাজার, দাসানুদাস জনপদ, তাদের দখলীস্বত্ব, ট্রানজিটের নামে করিডোর, চিকেন নেক-এর নিরাপত্তা এবং লুটের ভাণ্ডার হাতে পেয়ে যাবে আর তাদের সেবাদাসদেরও একটা গতি হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে বাংলাদেশে যে পরিবর্তন হয়েছে জনমানসে, সময় যে বদলে গেছে, পানি যে অনেক বেশি গড়িয়ে গেছে, তা হিসাব করতে বোধকরি হিন্দুত্ববাদীরা চাচ্ছে না—কি এ দেশের ভেতরের পঞ্চম বাহিনী, কি সীমান্তবহির্ভূত রামপন্থী রমণী রমণ রতি প্রভুরা এবং তাদের সে দেশীয় গোদি মিডিয়া। এজন্যই চলছে এত বেশি ফল্স প্রপাগান্ডা, এত বেশি মিস ইনফরমেশন এবং ডিসইনফরমেশনকেন্দ্রিক ঘোলা পানি বানানোর চক্রান্ত ও অপচেষ্টা। সেই প্রকাশ্য-প্রচ্ছন্ন হুমকি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা পুরো সীমান্তজুড়ে এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরেও চলছে। কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাই কমিশনে হামলা, ভাঙচুর, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত অবমাননা যে আন্তর্জাতিক ভিয়েনা কনভেনশনের চরম অস্বীকৃতি, তা বাংলাদেশের উপনিবেশ হারিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা নিতান্তই উদ্ভ্রান্ত হয়ে বিস্মৃত হচ্ছে।
অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ভারত তো এখন এমনই মাইনকার চিপায় পড়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে তারা শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটানে পাদুকা প্রহার খেয়েছে। ‘ইন্ডিয়া আউট’ মালদ্বীপ হয়ে এখন বাংলাদেশের ২০ কোটি মানুষের প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে। তাই আমরা ভারতের ভিসা চাইব না। ইউরোপীয় দেশগুলোর ভিসাকেন্দ্র দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায় আনার দাবি খুবই যথার্থ হবে, কেননা আমরা ভারতে যাব না। ভারতে চিকিৎসা করাব না। ভারতে বাজার করব না। ভারত থেকে আমদানি করব না। ভারতের পণ্যদ্রব্য পরিহার করব। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ করতে হবে। ভারতে বেড়াতে যাব না। ভারতে নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা দেব না। ভারতের লাখ লাখ হিন্দুত্ববাদীদের বহিষ্কার করে তার পরিবর্তে বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকারদের বিভিন্ন কর্মস্থলে কাজ দেব, নিয়োগ দেব, চাকরি দেব। দেশের অর্থ-সম্পদ দেশে রাখব। ভারতকে বুঝতেই হবে, কত ধানে কত চাল। আমাদের ফরেন কারেন্সি নিজ ভূখণ্ডের বাইরে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে যাবে না। আমাদের চিকিৎসা, ভ্রমণ, বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, যন্ত্রপাতি, সুতা ইত্যাদি কাছাকাছি অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে।
দেশের অভ্যন্তরে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, কাঁচামরিচ, ডাল, মশলা ইত্যাদির উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ফুড সাইলো স্থাপন করে সারা বছরের উপযোগী করে সাপ্লাই চেইন ঠিক রেখে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দমন করে। গার্মেন্ট শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ উপযোগী কারখানা ও শিল্প দেশি-বিদেশি কলাবরেশনে স্থাপন করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আত্মনির্ভরতার পথ ছাড়া যাবে না। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের এক ঝুড়িতে সকল ডিম রাখা যাবে না। তাদের সঙ্গে ভয়াবহ অসম বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমদানি-রপ্তানি হবে বিভিন্নমুখী এবং মাল্টিলেটারালিজম হবে সমতা প্রতিষ্ঠার শর্ত। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৯৭১ এবং ২০২৪-এর অর্জনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না তাদের চিহ্নিত শত্রু হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী ভারতকে। তবে বাংলাদেশিদের সজাগ-সচেতন থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সর্বোচ্চ মাত্রায় এবং সে অনুযায়ী যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলতে বাধ্য হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ, অখণ্ডত্ব ও সার্বভৌমত্বকে এবং আমাদের জিও পলিটিক্যাল অ্যাডভানটেজকে বিকিয়ে দিয়ে ভেতরে-বাইরে কেউ যেন কোনো ফাউল প্লে করতে না পারে, তা নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, বাহিনীসমূহ, প্রতিষ্ঠানাদি, কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা, মিডিয়া, বহির্বিশ্বে রেগুলার ইফেকটিভ কমিউনিকেশনসহ প্রত্যেক ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, দায়, করণীয়, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, আন্তঃসংযোগ ইত্যাদি যাবতীয় কিছুকে অপটিমাম, ব্যালেন্সড এবং ডিজায়ার্ড স্ট্যান্ডার্ডে আনতে হবে এবং সাসটেইন করাতে হবে।
কিছু কথা আমাদের কালেকটিভ মেমোরি হিসেবে স্থায়ীভাবে সমষ্টি সত্তার মধ্যে গেঁথে ফেলতে হবে যে, জুলাই ২০২৪ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঝ দিয়ে ফ্যাসিস্ট মাফিয়া রানী পালিয়েছে। তাকে ও তার ষণ্ডাগুণ্ডা বাহিনীকে আন্ডার এস্টিমেন্ট করা যাবে না। সুযোগ পেলেই তারা ছোবল মারবে বিষধর সাপের মতো। দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতর হিন্দুত্ববাদ, ইসকন, এই পরিষদ-ওই সংঘ নামে ফিফ্থ কলামিস্টরা যেন সামান্যতমও অরগানাইজড নুইসেন্স ও টেরর করতে না পারে। তৃতীয়ত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, দেশরক্ষা বাহিনী যেন দায়দায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে থাকে। সে সঙ্গে রুল অ্যাপ্লিকেশন ও রুল অ্যাডজুডিকেশনের কাজ জনইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে হবে, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণধর্মী হতে হবে। চতুর্থত, একই মহৎ সমষ্টি-কল্যাণ নিয়ে এবং ইনভেস্টিগেটিভ ও অবজেক্টিভ জার্নালিজম নিয়ে পাশাপাশি মাস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও যেন জনপ্রহরার মধ্যে থেকে যথাযথ ইতিবাচক অর্থে তাদের কাজ ও দায় পালন করতে পারে দায়িত্বশীলতার সীমায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব থাকবে জনগণের, নাগরিক সমষ্টির, এনলাইটেন্ড গ্রুপ ও যথার্থ অর্থে নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ও প্রকৃত সিভিল সোসাইটির ওপর। স্পষ্ট কথা হচ্ছে, নিজেদের দেশ, মানচিত্র, ভূগোল, সীমান্ত, সম্পদ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডত্ব, ঐক্যবদ্ধ সচেতন সম্মতি ও সমষ্টি-ইচ্ছা আর সম্ভাবনাকে নিজেরাই পাহারা দিতে হবে, টেকাতে হবে এবং সর্বজনীন কল্যাণে স্বনিয়ন্ত্রণে কার্যকর রাখতে হবে। এ ছাড়া আমাদের সিটিজেন আর্মি গড়ে তুলতে হবে তরুণ-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে।
তাযাক্কুর, বয়ান, হাকিকত
বাংলাদেশের জনগণ, ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক দলসমূহ, সরকার, প্রশাসন, বাহিনীসমূহ, সিভিল সোসাইটি সবাইকে খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মাফিয়া রানী হাসিনার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী রেজিমের অবসান হয়েছে। হাসিনা পালিয়ে গেছে তার প্রভুর কাছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী মেন্টাল মেইক-আপ যেমন রয়ে গেছে, তেমনি একযোগে চলছে অন্তর্ঘাত ও পঞ্চম বাহিনীর একের পর দুষ্কর্ম আর উদ্দেশ্যমূলক উস্কানি।
আর দেশের বাইরে হিন্দুত্ববাদী মোদির বিজেপি সরকার, তাদের সীমান্তরক্ষী ও সামরিক বাহিনীর অশুভ তৎপরতা; সে সঙ্গে চলছে মোদির গোদি মিডিয়ার ভয়ংকর মতলবি ও মিথ্যা-অপপ্রচার তাণ্ডব। এখানে যেটা খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং আমাদের জনগণের কালেকটিভ মেমোরিতে গভীর শেকড় গেঁথে রাখতে হবে সীমান্ত-বহির্ভূত হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী হুমকি, হুঙ্কার, হামলা, অন্তর্ঘাত বাংলাদেশকে বিপদে ফেলে নিজেদের করায়ত্ত করার অপচেষ্টা এবং কেবল মোদির বিজেপি, মমতার তৃণমূল বা রাহুলের কংগ্রেসের সঙ্গেই যুক্ত নয়, শেষও নয়। এর সঙ্গে রয়েছে চাণক্য রাজনীতি, জিও পলিটিক্যাল আধিপত্য বিস্তারের গূঢ় মতলব। হিন্দুস্তানের ‘র’ ও সাউথ ব্লকের টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশ।
এই ইন্ডিয়ান হেজিমনির সঙ্গে একেবারেই যুক্ত অবিচ্ছেদ্যভাবে সর্বকালের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ। সে সঙ্গে বাংলাদেশকে দখল করে অখণ্ড ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার ‘র’-এর বদ পরিকল্পনার সঙ্গে রয়েছে পে-রোলে থাকা লুমপেন এজেন্ট বাংলাদেশের মধ্যকার হিন্দুত্ববাদী কোনো কোনো গোষ্ঠী, ফ্রন্ট, সমাজ, মোর্চা ও পরিষদ। এদের কেউ কেউ প্রকাশ্য সভায়, বক্তব্য-বিবৃতিতে বাংলাদেশকে মোদির বিজেপি সরকারের সহায়তায় অখণ্ড ভারতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করে, খুব স্পষ্ট ঘোষণা দেয় বঙ্গভাষায়। এরা মাত্রাতিরিক্ত মিডিয়া কাভারেজ পায় ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট মাফিয়া আওয়ামী সরকারের দাস হিসেবে অপারেট করা সাংবাদিক নামক সাংঘাতিক ও ভোল পাল্টানো চ্যানেলগুলোর প্রশ্রয়ে। সবচেয়ে বিধ্বংসী অবস্থায় রয়েছে একটি ইংরেজি ও দুটি বাংলা দৈনিক। এই পঞ্চম বাহিনীর অপতৎপতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাধ্য করতে হবে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য, যাতে নতুন করে বা ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ ভারতীয় যোগসাজশে যে কোনো কোয়ার্টার ও কর্নার থেকে না আসতে পারে।
কিন্তু এই যে কেন্দ্রীয় বিবেচনা এবং বর্তমান প্রবন্ধের শিরোনাম, তাতো বিস্মৃত হওয়া যাবে না। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান হেজিমনি বা ভারতীয় আধিপত্যবাদ, হিন্দুত্ববাদ, অখণ্ড ভারত পরিকল্পনা, আসমুদ্র হিমাচল রাম রাজত্ব—এসব কিন্তু রয়েই যাচ্ছে স্থায়ী ফ্যাক্টর হিসেবে সবচেয়ে বিপজ্জনকভাবে এবং এরা বাংলাদেশকে ছাড়বে না; সুযোগের ষড়যন্ত্রের ভেতর নিরবচ্ছিন্নভাবে থেকেই যাবে।
এ কারণেই ইন্ডিয়ার হেজিমনি বা ভারতীয় আধিপত্যবাদ, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ, হিন্দুস্তানি সম্প্রসারণবাদ, অখণ্ড ভারত, রাম রাজত্ব, হিন্দুস্তানি ম্লেচ্ছ-যবন-আগন্তুক থিসিস, তা কেবল মুসলিম ও ইসলামবিরোধিই নয়। এটা একই কারণে ৯২ ভাগ মুসলিমের বাংলাদেশবিরোধী এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিবেচনায় আমাদের জিও-পলিটিক্স বা ভূ-রাজনীতির বাস্তবতায় প্রায় পারমানেন্ট অপারেশনাল অ্যারিনা, থিয়েটার, ফ্রন্ট, অ্যাসপেক্ট হয়ে থাকবে।
একটু পেছনের দিকে যাওয়া গেলে ইতিহাসের দিকে গভীর ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বিষয়াদি বুঝা যাবে। এটা করলেই খুব স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ, ভারতীয় আধিপত্যবাদ, অখণ্ড ভারত, রাম রাজত্ব স্বপ্ন, ম্লেচ্ছ-যবন মুসলিমবিরোধিতা, অসংখ্য রায়টে, কাউ কিলিং রায়টে মুসলিম নিধন-সংহার-বধ-হত্যা; অবিরত হেইট ক্যাম্পেইনের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সংশ্লেষ শতভাগ। এসবের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী, রামপন্থী, অখণ্ড ভারতপন্থী রাজনীতি, দল, সংগঠন, নেতৃত্ব ও জনসমাজের বৃহদাংশের যোগসূত্র ও ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় পাতায়, বাঁকে বাঁকে অবিচ্ছেদ্য রেকর্ড রেখে যাচ্ছে। সাক্ষ্য হয়ে থাকছে আমাদের মুসলিমদের, বাংলাদেশের মানুষের এবং বিশ্বমানবের শিক্ষা লাভের নিমিত্তে।
‘আনন্দমঠ’-এর নেড়ে-যবন বধ এবং হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসলমান ইনসান হো তো জানোয়ার কৌন হো’র ইতিহাস সূত্রের সঙ্গে আজকের বাল ঠাক্রের ‘মুসলমানদের পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে খেজুর বাগানে (অর্থাৎ আরবে-বর্তমান লেখক) পাঠিয়ে দেওয়া হবে’- এসব তো একই পরম্পরায় গ্রথিত। অথচ প্রমাণিত যে, ভারতবর্ষে এবং বাংলায় আর্যরা নিজেরাই বাইরে থেকে আসা দখলদার। তারা যুদ্ধ করে স্থানীয় আদি অধিবাসীদের পরাজিত করে ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতে (বাংলাসহ) শাসক ও মূল প্রভাবক শক্তি হয়ে ওঠে। তারা তাদের বৈদিক ধর্মসহ নিজেদের উচ্চ বর্ণের (হায়ার কাস্ট) বলে ঘোষণা দেয় এবং ধর্মীয় সূত্র তৈরি করে। তাদের মতে, অন্য অনার্যরা স্থানীয় আদিম অধিবাসী এবং সাত শতক থেকে ভারত-বাংলা অঞ্চলে আসা মুসলিমরা আক্রমণকারী ভিনদেশি। ফারসি বা পাহ্লবি ভাষায় ভারতের সিন্ধু নদ বা সিন্ধু অঞ্চলের নাম উচ্চারণে ‘সিন্ধু’ বদলে গিয়ে ‘হিন্দু’ উচ্চারণটি একসময় এখানে কথায়, ভাষায়, অভ্যাসে ও বাস্তবে বিস্তৃতি পায়। এভাবে মূর্তিপূজার, দেব-দেবীর, তেত্রিশ কোটি দেবতার বৈদিক ধর্ম সনাতন থেকে হিন্দু নামে প্রচারিত ও চিহ্নিত হয়। হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদকে আশ্রয় করে হিন্দুত্বের পরিচিতি গ্রহণ করে। হিন্দুদের মাঝে চারটি কাস্ট বা বর্ণ আছে। সর্বোচ্চ পূজারী পণ্ডিত ও সম্মানীয় হচ্ছে ব্রাহ্মণ। এরপর ক্ষত্রীয়। এরপর বৈশ্য। আর সবশেষে সর্বনিম্ন অচ্ছুৎ হচ্ছে শূদ্র। অর্থাৎ নমঃশূদ্র। ভিন্নভাষায় হরিজন। আনটাচেবল্স। অস্পৃশ্য এরা। অথচ এই সেদিন চট্টগ্রামে এই নমঃ অস্পৃশ্য দাসদের একজন নিরপরাধ মুসলিম আইনজীবী এবং সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ চেইজ করে তাকে ভৈরব থেকে পালানোর পথে গ্রেপ্তার করেছে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হচ্ছে পূজারী। গায়ে খাটে না। কিন্তু ভেট পায় সর্বত্র, সকলভাবে। এটাকে ধর্মীয় বিধান বানানো হয়। ক্ষত্রীয়রা যুদ্ধ করে বিধায় অকর্মা ব্রাহ্মণের কাছে মূল্য পায়। এরপর বৈশ্য বা বণিক ব্যবসায়ী; লেনদেন কায়-কারবারীরা। এরাও খানিকটা মূল্য পায়। কেননা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান, সরবরাহ এদের মাধ্যমেই হয়। এরা না থাকলে তো চলে না। আর অবশেষে হলো শ্রমজীবী আসল মেহনতি মানুষদের দল শূদ্র। এরা নমঃ, হরিজন, অস্পৃস্য দাস।
হিন্দুদের কাস্টে বিভাজন বাস্তবে আরও বহু উপস্তরে বিভাজিত হয়েছে। এদের ব্রাহ্মণরা বড়লোক, উচ্চবর্ণের; তা দরিদ্র হলেও এদের মুফতে পাওয়া অনেক। আর সর্বনিম্নের কাস্ট শূদ্র, নমঃ দাসরা, ছোটলোক, অস্পৃশ্য। এদের ‘ছায়া মাড়ালে নাইতে হবে’। ‘পণ্ডিত এস্তেছে। ছোটলোক সব তফাৎ যা’। এটাই ব্রাহ্মণদের দাম্ভিক ঘোষণা। এরা একসঙ্গে বসা, ছোঁয়াছুঁয়িতে আসা, ব্রাহ্মণের বাসনে-থালায়-গ্লাসে খাওয়া ও জল (পানি) পান করতে পারে না। এরা সেটা করলে বা বৈদিক ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে ‘রৌরব’ নামক নরকে চলে যাবে। হিন্দুরা পুনঃপুন জন্ম-মৃত্যুতে বিশ্বাসী। এসব একেবারেই বৈপরীত্য তৈরি করে ইসলামিক মনোথিইজম তথা তৌহিদভিত্তিক ইসলাম ও মুসলিমদের সঙ্গে।
হিন্দুদের যে কাস্ট সিস্টেম, সেটি তারা নীতি-ধর্ম, জাত-পাত, মানব অসাম্যের অনাচারসহ মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিতে তৎপর। মুসলিমদের সঙ্গে স্পর্শ, খাওয়া, তাদের বাসন-ঘটি-বাটি ব্যবহার করা বা নিজেদেরটা ব্যবহার করতে দেওয়া নিষিদ্ধ। কারণ, মুসলিমরা যবন, ম্লেচ্ছ। মুসলিমরা এদের ঘরে, মন্দিরে গেলে তাদের শরীরের স্পর্শে সেসব অপবিত্র হয়ে যায়। তাই স্নান বা চান করতে হয়, গোবর-জল গ্রহণ করে শুদ্ধ হতে হয়। এদেরই মন্তব্য হয়, ‘ও মা, আমি তো ভেবেছিলুম তুমি ভদ্রলোকের ছেলে। এখন দেখি তুমি মোছলমান’—এটাই সত্য। তাই বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের আপাত বেড়া লঙ্ঘন রাজনৈতিক মতলবপ্রসূত। ইদানীং তাদের স্বরূপ ভালোভাবেই উন্মোচিত হয়েছে।
এই উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের অত্যাচারে নমঃশূদ্র, অস্পৃশ্য, ছোট জাতের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়ে ড. বিআর আম্বেদকর একবার গণভাবে সবাই মুসলিম হতে চেয়েছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার হুমকি দিয়েছিলেন। ফলে গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল এবং আরও উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতৃবৃন্দ আম্বেদকরের কাছে গিয়ে মার্জনা চেয়ে এবং তাদের সমতা-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সনাতনী হিন্দুত্ববাদ রক্ষার প্রয়াস পান। লক্ষণীয় যে, হিন্দুদের মধ্যে উচ্চবর্ণের তিন বর্ণের লোকেরা বিশেষত ব্রাহ্মণরা সংখ্যায় অতি লঘিষ্ঠ। সেকালেও যেমন তেমনি বর্তমান কালের ভারতে। এখনকার বাংলাদেশেও তা-ই। কেবল মুসলিমদেরকে মোকাবিলা করার জন্যই উচ্চবর্ণের তথাকথিত আর্য হিন্দুত্ববাদী মোড়লরা সনাতনী ঐক্য ধরে রেখেছে। এখনও পূজা করায়, বেদীতে উঠায়, মন্ত্র কার্যে, ধর্মগ্রন্থ পাঠে, মর্যাদায় গরিষ্ঠ হিন্দু নিচু জাতের লোকেরা অপাঙক্তেয়। হরিজন মানুষরা কাস্ট সিস্টেমের সবচেয়ে বড় শিকার। হিন্দুদের মধ্যে বিয়েতে, সামাজিকতায় কাস্ট বা বর্ণ খুব বড় ফারাককারী নিষিদ্ধতার শর্ত। তাদের সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ভিত্তিহীন এত বেশি বেইনসাফি নিয়ে।
এখন এই হিন্দুত্ববাদীরা ভারত ও বাংলাদেশ এবং পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারতের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে মহাহিন্দু জাতি, অখণ্ড ভারত, হিন্দুত্ববাদী আসমুদ্র হিমাচল রাম রাজত্ব কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। এটাকে তারা ধর্মীয় বোধ, সামাজিক বিবেচনা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নাগরিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক চিন্তা কাঠামোয় ন্যারেটিভ বা বয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। অতএব, হিন্দুত্ব ও রাম রাজত্বসহ অখণ্ড ভারত তাদের আরাধ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতের মধ্যে এবং বাংলাদেশসহ চারপাশের বিভিন্ন অঞ্চল ও জনপদ তাদের জন্য বাধা। তাই তারা চাণক্য কূটকৌশলে, ছলে-বলে দালাল ও পঞ্চম বাহিনী সৃষ্টি করে। সন্ত্রাস ও যুদ্ধ করে এবং অবিরত হিন্দুত্বে ফেরত যাবার আজগুবি আবদারের মাধ্যমে আদি সনাতনী হবার জন্য ভারতের অভ্যন্তরে সর্বত্র এবং বাংলাদেশেও ইসকনী প্রকল্পকে বিস্তৃত করেছে। এভাবেই অখণ্ড ভারত দেশমাতৃকা দেবীর জন্য জয় হিন্দ, জয় শ্রীরাম, হরি হরি, হরি বোল সর্বত্র ছড়ানো হচ্ছে। হিন্দু মহাসভা, গো-রক্ষা সমিতি, আরএসএস, শিবসেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, বিজেপি সবকিছু ভারতে সার্বক্ষণিক ভূমিকায় রত। বাংলাদেশে এত সংঘ, সমিতি, পরিষদ, মোর্চা আর তারপরও ইসকন—সবই সনাতন হিন্দুত্ববাদ-সংশ্লিষ্ট। এদের মূল টার্গেট মুসলিমরা। আর জয় অখণ্ড ভারত, জয় হিন্দ, জয় রাম রাজ। এখানে হয় মুসলিমরা সনাতনে ঢুকতে হবে, নতুবা বাল ঠাক্রের ভাষায় ‘পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে খেজুর বাগানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে’। এই যে প্রায় দুই শত বছর ধরে আজ অবধি এত রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মুসলিম গণহত্যা, সম্পদ, বাড়িঘর লু্টপাট, হিন্দুত্ববাদী ভারতে হচ্ছে; এই যে প্রায় দুই শত বছরে বহু হাজার বার হিন্দুত্ববাদীরা মরণ কামড় দিয়েছে, হত্যালীলায় মেতেছে ব্রিটিশ আমলে, স্বাধীন ভারতে এবং আজকের দিনের হিন্দুস্তানে। এর কারণ কী? এত যে হাজার হাজার মুসলিমকে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত, নিঃস্ব-ক্ষতিগ্রস্ত আর হত্যার শিকার করা হয়েছে, তার বিপরীতে ৯২ ভাগ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশে ৭ ভাগ হিন্দুর উপর কোথায় হয়েছে হত্যাকাণ্ড? রাজনৈতিক কারণে যা কিছু সামান্য নিপীড়ন, ভাঙচুর হয়েছে, তা তো তারা নিজেরা মাফিয়াদের দলদাস হয়েছে বলে। এছাড়া, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দ্বারাই তাদের রাজনীতির ট্রাম্পকার্ড হিসেবে, তাদের ভোট ব্যাংক হিসেবে হিন্দুদের অবস্থানের কারণেই তা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হাসিনার সময় বিগত ১৬ বছর নিপীড়নের শিকার হয়েও তারা কেন চুপ ছিল? সর্বশেষ চট্টগ্রামে মুসলিম আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে সনাতনী ইসকনের সংশ্লিষ্ট হয়ে হিন্দুত্ববাদের অনুসারীরা। যে লোকটি একের পর এক কোপ দিয়েছে, সে তো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একজন হিন্দু পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বর্ণ হিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য, নমঃ, দাস। তাহলে ব্রাহ্মণ্যবাদ আর অস্পৃশ্যরা এক মোহনায় মিলেছে কেবলই অখণ্ড ভারতের রাম রাজত্বের স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
এর আগে ফরিদপুরের মধুখালীতে হুফ্ফাজ আল কুরআন দুই ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারও আগে সিলেটে এক ইমামকে হত্যা করার পরও কিন্তু হিন্দুরা কি এদেশে নিরাপদে থাকেনি? বাংলাদেশের পতাকার উপর গেরুয়া রঙের হিন্দুত্ববাদী ইসকনী পতাকা লাগিয়ে জাতীয় পতাকাকে অপমান করার পরও কি শুধু মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া কী দেখেছে হিন্দুরা? চিন্ময়কে আন্তর্জাতিক ইসকন দুর্নীতি, শিশু বলাৎকার, অবৈধ নারী সম্পর্কসহ চারিত্রিক স্খলনের কারণে বহিষ্কারের পরও কীভাবে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর সনাতনীরা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে এত তাণ্ডব চালায়। কীভাবে বিভিন্ন সংঘ, পরিষদ, মোর্চা এত বেশি বিশৃঙ্খলা করে? কীভাবে তারা স্বাধীন বঙ্গভূমিসহ দেশের আরও দুই-তিনটি অঞ্চলে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে, হুমকি দেয়? এত বেশি দেশ ও রাষ্ট্রদ্রোহী আচরণের পরও তারা অক্ষত থাকে কেবলই ৯২ ভাগ মুসলিমের ‘লা ইকরাহা ফিদ দীন’ (কুরআন-২:২৫৬)-এর শর্তে সহিষ্ণুতার কারণে। বিগত ১৬ বছর তারা চাকরি, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, পদ দখল, ব্যবসা-বাণিজ্য, তাদের হারের তুলনায় অকল্পনীয় অধিক পরিমাণে লাভ করেছে। তা তারা পেয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের শাসনে নেতৃত্ব ভারতীয় সেবাদাসী হবার কারণেই। এখন তাদের উন্মাদনা হিন্দুত্ববাদী রাজত্ব চলে গেছে বলে।
কিন্তু এত সত্যের পরও কীভাবে ভারতে তো বটেই, এমনকি বাংলাদেশ থেকে, এখানকার নাগরিক হয়ে দেশটিকে টুকরো টুকরো করার এবং অখণ্ড ভারতে মিলিয়ে দেবার কল্পিত ও অভীষ্ঠ রাম রাজত্বে অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়ার মানসে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দেয় তারা নব্য আমদানি কূটকৌশল হিসেবে। এমনকি পূজার প্রসাদ খাইয়ে চট্টগ্রামে প্রাথমিক স্কুলের মুসলিম বাচ্চাদের দিয়ে বারংবার ঘণ্টা ধরে দেওয়ানো হয় একই ধ্বনিসমূহ। কীভাবে হরে কৃষ্ণ হরে রাম, জয় শ্রীরাম, হরি হরি হরি বোল উচ্চারণ করানো হয় সমবেতভাবে এবং তা-ও আবার মুসলিম শিশুদের দিয়ে?
সূত্র আসলে কৌটিল্য চালে, চাণক্য ষড়যন্ত্রে এবং তা হিন্দুত্ববাদী ভারতের ইশারায় ঘটছে। ভারতের রাজনীতি, স্বার্থ, কূটনীতি, ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজন পূরণে এখানে এক্সটেন্ডেড উইং হিসেবে কাজ করা তো সম্পূর্ণ দেশদ্রোহিতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা। অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে এ দেশের নাগরিক হয়ে এবং মুসলিম নিধন করে? এই সত্য তো নির্লজ্জ এক তথাকথিত নারীর লেখায়ও অতি-উৎকটভাবে তুলে ধরা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। অখণ্ড ভারত তো হিন্দুত্ববাদী রাম রাজত্বের স্বপ্নে বিভোর। এটাই তো আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ভারত; হিন্দুস্তানের আসল চেহারা। আমরা বাংলাদেশের ৯২ ভাগ তাওহিদী জনতা তা চাইব কেন? ভারতকে তো নিজের সীমার মধ্যে থাকতে হবে। বেশি বাড়াবাড়ি ও দাদাগিরি করতে গিয়ে ভারত আশে-পাশের সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে লাগতে গেলে তো উপযুক্ত জবাব পাবে। শুধু বাংলাদেশকেই আওয়ামী লীগ ও দাসী নেতৃত্ব পেয়ে বেকায়দায় ফেলেছিল তারা। তাও গেছে তাশের ঘরের মতো ধ্বংস হয়ে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এজন্য ভারত ও তার দাস দলের এত মর্মপীড়া আর শিরঃপীড়া। তাই উন্মাদ হয়ে অমিত শাহ বলে, এখন খালি ধরবে আর উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখবে।
তবে আমরা বলে রাখছি, এখন থেকে ভারতের সঙ্গে চোখ চোখ রেখে কথা বলতে হবে, কাজ করতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের বিদেশনীতি ও ভারত সম্পর্কিত নীতি হবে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডত্ব, ভূ-রাজনৈতিক কৌশল এবং স্বাধীন সমমর্যাদার দৃঢ়তম অবস্থান নিয়ে। প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কের কথা ভুলে যান। এটা আর হবে না। এ এক নতুন সময়ের বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ। এখানে মাথা তুলে দাঁড়ানো ২০ কোটি মানুষ হিন্দুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবিলায় সবাই গ্ল্যাডিয়েটর, সবাই নির্ভীক লড়াকু সৈনিক। জান যাবে, তবুও মান যেতে দেব না। অসম চুক্তি, গোপন চুক্তি, অসম সম্পর্ক, অবৈধ সুযোগ, অসম বাণিজ্য, একতরফা পিঠাভাগ ও খাই খাই দাদাগিরি, অবৈধ অবস্থান এবং পাচার, সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিটের নামে মাল্টি মোডাল করিডোর, পানিসন্ত্রাস, তথ্যসন্ত্রাস, হিন্দুত্ববাদী হুমকি, পঞ্চম বাহিনীর সন্ত্রাস—সবকিছুর অবসান করতে হবে। আপাতত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের সমগ্র মানুষের সমষ্টিসত্তার অতি স্পষ্ট ব্যক্ত ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। নীতি, কৌশল, কার্যক্রম, পাল্টা ব্যবস্থার মাধ্যমে ফিরে আসবে আমাদের স্বাধীনতা। পরে এসব করবে, এগিয়ে নেবে নির্বাচিত সরকার। হাস্বুনাল্লাহ ওয়া নিয়ামাল ওয়াকীল। নিয়ামাল মওলা ওয়া নিয়ামান নাসির।
লেখক: প্রফেসর (অব.), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতের জন্য যা করেছেন, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে ভারত শুধু আশ্রয় দিয়ে বসে থাকবে না, তাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা চেষ্টা করে যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের দাবি তোলে, তখন সাধারণ মানুষ
৫ ঘণ্টা আগেবিশ্বের নানা অঞ্চলে প্রভাবশালী ও তুলনামূলকভাবে বৃহৎ রাষ্ট্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপে জার্মানি ও ফ্রান্স এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলের উল্লেখ করা যেতে পারে।
৮ ঘণ্টা আগেপূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল। আমার দেশ-এর পুনঃপ্রকাশনা সেই রক্ত লালের সংগ্রামেরই একটা অংশ। আমাদের মতো লোকেরা আমার দেশ-এর মতো পত্রিকার প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই। আল্লাহপাক মজলুমের পক্ষে।
১ দিন আগেচেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) আজ আমাকে বলেছেন, কি খান সাহেব, হাসিনা আসছে বলে কি ভয় পাচ্ছেন? এটা শুনে আমরা কিছুটা অবাকই হলাম। মনে হলো তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ভয় পাচ্ছেন!
১ দিন আগে