Ad

জুলাই বিপ্লব ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ

ড. মো. মিজানুর রহমান
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩: ৫৪

এক.

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। ফিলিস্তিনের লড়াই জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রেরণা। ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টের গণহত্যা মানব ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতির কালো মানুষদের মতো ‘হয় নতুন স্বাধীনতা, নয় মৃত্যুর শপথে বলীয়ান ছাত্র-জনতার এক দফায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হয়। আর এর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের সামাজিক বিষণ্ণতারও অবসান ঘটেছে। শেখ হাসিনার সৌভাগ্য, তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু জাতির জন্য দুর্ভাগ্য এই কারণে যে, তারা এখন পর্যন্ত তার বিচার দেখতে পারল না। শেখ হাসিনা গত ১৬ বছর যে হাজার হাজার মানুষকে গুম-খুন করেছেন এবং গণহত্যা চালিয়েছেন, তার শাস্তি কোন আইনে হবে, সেটাও আমাদের অজানা। শেখ হাসিনা কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ফলে বহু মা আজ সন্তানহারা, অনেক মাসুম বাচ্চা বাবাহারা, বহু স্ত্রী স্বামীহারা এবং বোনরা ভাইহারা। এসব ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের উদাহরণ। অনেক মনোবিশেষজ্ঞ মনে করেন, তিনি পুরোদস্তুর একজন সাইকোপ্যাথ ও সোশিওপ্যাথ। পতিত শেখ হাসিনার গণহত্যার জন্য দায়ী অতিমাত্রায় নার্সাসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার (এনপিডি)।

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল মূলত সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততি ও নাতি-পুতিদের জন্য সংরক্ষিত ৫৬ শতাংশ কোটা কেন্দ্র করে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা অনেকটাই ব্যক্তিগত জেদের বশবর্তী হয়ে কোটাপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু গত ৫ জুন হাইকোর্টে শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ বিচারকের রায়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে আসে, যা শিক্ষার্থীদের মনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে। যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের সন্তান বা নাতি-পুতি’ বলে আখ্যায়িত করেন, তখনই মূলত আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ আরও তুঙ্গে ওঠে। এর জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’ বলে স্লোগানসহ মিছিল বের করেন। আমি মনে করি, এ ঘটনাই ছিল আন্দোলনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। কারণ, ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার ১৬ বছরের দুঃশাসনে বিরোধী মত দমনে বরাবরই ‘বিএনপি-জামায়াত’, ‘জামায়াত-শিবির’, ‘রাজাকার’ ট্রামকার্ড ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার ছাত্ররা শেখ হাসিনার দেওয়া রাজাকার খেতাব কবুল করেই লড়াইয়ে নামে। এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বানানো দীর্ঘদিনের বয়ান ভেঙে পড়ে। এরপর বরাবরের মতো জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও গুম-হত্যা পরিচালনা করে শেখ হাসিনা আন্দোলন দমাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যতই দমন-পীড়ন চালানো হয়, আন্দোলন ততই বেগবান হতে থাকে।

শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন অতীতের মতো গুম-হত্যার মাধ্যমে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যা আর সাধারণ শিক্ষার্থী হত্যা যে এক নয় এবং শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় আওয়ামী সরকার। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের হত্যায় (১৬ জুলাই ২৪) আপামর জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার দুই হাত প্রসারিত করে গুলির সামনে বুক পেতে দেয়ার দৃশ্য জনতার ভেতর সাহস সঞ্চার করে। হাসিনার গুন্ডাবাহিনী ও দলদাস নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে শত শত হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনা পতনের এক দফায় স্থির হয়।

হাসিনার নির্দেশে দলদাস বাহিনীর ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ সত্ত্বেও ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) ছাত্র-জনতা রাজপথ দখলে নেয়। ফলে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে গণভবন থেকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

দুই. পতিত রক্তপিপাসু শেখ হাসিনার পলায়নের ফলে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ সংস্কারের মূলমন্ত্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের সময়ে চার মাসে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ চোখে পড়লেও জনগণের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। জনগণের প্রত্যাশা ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৬ বছরে যত ধরনের গুম-খুনের পাশাপাশি ব্যাংক-বিমা, আদালত, শিক্ষা, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র জাতির কাছে উন্মোচন করা।

একই সঙ্গে এসব অপকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্তদের অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে শনাক্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা, যাতে আগামী প্রজন্মের কেউ শেখ হাসিনা সরকারের রূপে আবির্ভূত হওয়ার কল্পনাও করতে না পারে। শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম একটি স্পষ্ট বার্তা যেন পায়, দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করলে প্রত্যেককেই তার প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। ফ্যাসিবাদ কায়েমের ভয়ানক শাস্তি দেখে নতুন প্রজন্ম আদর্শিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতি বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারবে।

উদ্বেগজনক দিক হলো, শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন হলেও তার ফ্যাসিবাদ বাস্তবায়নের সব উপকরণ এখনো আগের অবস্থায় অটুট রয়েছে। ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য যারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে কাজ করেছে, এমনকি মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি, তারা স্বপদে বহাল রয়েছে। এটা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, পতনের পর ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ব্যাপক মূল্য চোকাতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অধিকাংশ অপরাধী ও সহযোগী নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এমন নয় যে, শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন, বরং ১৬০০-এর বেশি মানুষ নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল হাসিনার সহযোগীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়ায় এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে অবৈধভাবে ব্যাপক অর্থসম্পদ অর্জন করায় সেসব অর্থবিত্ত এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করতে ব্যবহার করছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রশাসনের অভ্যন্তরে এখনো ফ্যাসিবাদী চক্রের প্রভাব এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। নতুন নিয়োগগুলোয় স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

তিন. ৫ আগস্ট ২৪ (৩৬ জুলাই) ছাত্র-জনতার বিজয় ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের ধ্বংসস্তূপের ওপর স্বৈরাচারমুক্ত নতুন বাংলাদেশের লাল-সবুজের ঝান্ডা উড্ডীন হয়। পতিত শেখ হাসিনা পাইলট ফিশ বিহ্যাভিয়ারে ভারতীয় আধিপত্যবাদের নীতিতে বিশ্বাসী। বিগত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার শাসন বাংলাদেশ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিস্তারের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। তার পতনে ভারত বর্তমানে উন্মাদ প্রায়। তারা এখন সংখ্যালঘু ট্রামকার্ডের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ভারতীয় বাহিনীর হাতে ছিল। বাংলাদেশের সংবেদনশীল পদের নিয়োগগুলো একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে ভারতীয় বাহিনী। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তি’ বলে কিছু ছিল না, যা ছিল তা হলো ভারতের চাপিয়ে দেওয়া শর্তের চুক্তি। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ একটি খেলো রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। শিক্ষার মৌলিক অবকাঠোমোকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যে সামান্যসংখ্যক হোয়াইট কালার জবে বাংলাদেশিরা চাকরি পেত, ভারত সেটা ধ্বংস করেছে। ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের লালিত ধর্মীয় মূল্যবোধকে লন্ডভন্ড করেছে। ভারতীয় বয়ান তৈরিতে কাজ করেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো। দেশে কথিত বহুল প্রচলিত কয়েকটি দৈনিক শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে ‘শেখ হাসিনার বিকল্প নেই’ এবং ‘শেখ হাসিনা না থাকলে দেশ পাকিস্তান-আফগানিস্তান হবে’ এমন বয়ান প্রচার করেছে।

পতিত শেখ হাসিনা সরকার সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ খর্ব করে এবং ‘আমার দেশ’ পত্রিকাকে কণ্ঠরোধ করে। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা, ভারতীয় আগ্রাসনের যৌথ প্রযোজনাতেই ‘আমার দেশ’ পত্রিকা বন্ধ হয়েছিল বলে দেশের মানুষ বিশ্বাস করেন। দৈনিক ‘আমার দেশ’ শুধু সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমই নয়; এটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার প্রতিফলন এবং সমাজ গঠনের অন্যতম এক শক্তিশালী হাতিয়ার। নতুন বাংলাদেশে নতুনরূপে আসা আমার দেশের কাছে প্রত্যাশা- পত্রিকাটির প্রধান দায়িত্ব হবে দেশের সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী হওয়া। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থরক্ষায় যে কোনো ধরনের বহির্দেশীয় আধিপত্যবাদ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমার দেশ সর্বদা সোচ্চার থাকবে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আমার দেশের সঙ্গে থাকবে- এই প্রত্যাশা।

যারা স্বার্থের বিনিময়ে বিগত বছরগুলো ফ্যাসিবাদী বয়ান প্রসারে ভূমিকা রেখেছে, দৈনিক আমার দেশ সেসব বুদ্ধিজীবীর মুখোশ উন্মোচন করবে। গোটা জাতির কাছে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে দায়বদ্ধ করে তুলবে এবং বিগত ফ্যাসিবাদের দোসর দেশীয় ও বিদেশি মিডিয়ার তৈরি বয়ান ভেঙে দেবে। আমার দেশকে ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, পদ্ধতির পরিবর্তনে ফোকাস করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। পাশাপাশি এর দায়িত্ব হবে বিদেশি সংস্কৃতির অযাচিত প্রভাব প্রতিহত করে দেশীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করা। সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং জনমানসে সঠিক চেতনা জাগিয়ে তোলা একটি পত্রিকার মৌলিক দায়িত্ব। আমার দেশ এক্ষেত্রে কখনো আপস করেনি, ভবিষ্যতেও এটি গণমানুষের সমস্যা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং চাহিদার কথা তুলে ধরে জাতি গঠনে এক নির্ভরযোগ্য অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। দৈনিক ‘আমার দেশ’ ভারতের তাঁবেদারি মিডিয়াগুলো ভারতীয় বয়ানের বিপরীতে সার্বভৌমত্ব ও দেশপ্রেমের বয়ান তৈরিকারী ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’- এর ভূমিকায় থাকবে বলে আশাবাদী।

লেখক: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত