Ad

আমাদের অভিনন্দন, আমাদের প্রত্যাশা

ফরহাদ মজহার
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬: ৩৫

অভিনন্দন দৈনিক আমার দেশ

দুই হাজার বাইশ সালের জুন মাসে ইস্তাম্বুলে মাহমুদ ভাই এবং আমাদের প্রিয় বোন ফিরোজা মাহমুদের আতিথেয়তায় ফরিদা ও আমি যখন বেশ কিছু সময় একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম, তখন আমাদের কথোপকথনে হতাশা ছিল না তা নয়, ছিল। কিন্তু কোন অবস্থায় কত ভীষণ নির্যাতনের মুখে তাদের দুজন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, সে কথা ভেবে আমরা হাসিঠাট্টার বাইরে সামনের দিনগুলোয় আশার কথা এবং নিজ নিজ কাজের পরিকল্পনায় সময় কাটিয়েছি। সব হতাশার বিপরীতে আমরা নিশ্চিত ছিলাম অন্ধকার কাটবে। এই দৃঢ় আশা, বলাবাহুল্য, মানুষের গভীর বিশ্বাস, সত্যের পক্ষে অবিচল থাকার নিষ্ঠা এবং অন্ধকারের মধ্যেও আলোকরশ্মি দেখার দূরদর্শিতার সঙ্গে যুক্ত।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে, যা আসলে ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল। এই আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় মারাত্মক সংঘাত। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের পর পাশ্চাত্য নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়াল। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলে যাওয়ার পাশাপাশি আমাদের সমাজ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতাও বদলে যেতে শুরু করল। এরপর বিশ্ববাসীর চোখের সামনে ঘটল গাজার ‘প্রিজন’ বা পৃথিবীর বৃহৎ কারাগার ভেঙে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে হামাসের প্রতিরোধ যুদ্ধ। তারই প্রতিক্রিয়ায় গাজায় সারা দুনিয়ার মানুষের চোখের সামনে ঘটল মার্কিন-ইসরাইলি গণহত্যা। ফিলিস্তিনকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা এবং ফিলিস্তিনিদের হত্যা কিংবা বিতাড়িত করার লড়াই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ক্ষমতার সমীকরণ এরপর দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করে।

ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার নানা টানাপড়েনের মধ্যে বিশ্ব ইতিহাসে এটা ছিল নতুন কিন্তু দুর্বল একটি মুহূর্ত। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তখনো স্বপ্ন দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। তারা গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। যে কারণে ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে কোনো শক্তিশালী আন্দোলন বা ক্ষোভ-বিক্ষোভ আমরা বাংলাদেশে দেখিনি। অন্যদিকে ধর্মপন্থি দলগুলোর মধ্যেও আমরা সরব বা উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা দেখিনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি পক্ষপাতী ছিল। অধিকাংশের ধারণা ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানিয়ে নির্বাচন দিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে।

অন্যদিকে ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বাইনারি দিয়ে বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি বাংলাদেশের চিন্তা ও রাজনীতিতে যেভাবে দাপটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ছিল বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে এই বাইনারি পরাজিত ও ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। এই নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার অভূতপূর্ব শর্ত তৈরি করে। এই নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে ছাত্র-জনতা-সৈনিকের নেতৃত্বে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। ধর্ম বনাম সেক্যুলারিজমের আর্টিফিশিয়াল বিভাজন ভেদ করে ‘জনগণ’ নতুন ঐতিহাসিক রূপ নিয়ে হাজির হলো। ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা মোকাবিলা ও উচ্ছেদ করার জন্য পুরোনো ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বিভাজন ভেদ করে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে জনগণের নতুন পরিগঠন বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের শর্ত তৈরি করল দ্রুত। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কে কোন মতাদর্শ ধারণ করে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠল না। বরং ‘জনগণ’ বলতে বোঝাল নতুন পরিগঠিত শক্তি; যাদের প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য হলো ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া, নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠন করা। কেউই খেয়াল করেনি, সবার অজান্তে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক, মতাদর্শিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে গত কয়েক দশকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। প্রচুর সম্ভাবনাময় নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম হয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর মাহমুদুর রহমান ২৭ সেপ্টেম্বর বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে এলেন। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিস্ট শক্তি দৈনিক আমার দেশ বন্ধ এবং প্রেসের সব যন্ত্রপাতি লুটপাট ও ধ্বংস করে দিয়েছিল। অবশেষে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুর রহমান নতুন করে পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়েছেন। বলাবাহুল্য, বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের লড়াইয়ের ইতিহাসের সঙ্গে দৈনিক আমার দেশ-এর ইতিহাস অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। সেক্যুলার ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণ যে সফলতা দেখিয়েছে, একইভাবে সব ধরনের পরিচয় ও ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে দৈনিক আমার দেশ লড়বে। বলাবাহুল্য, সেক্যুলার ফ্যাসিজমের পতনের পর ধর্মীয় ও পরিচয়বাদী ফ্যাসিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। দৈনিক আমার দেশ সব ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুক। আমাদের অভিনন্দন রইল।

প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর প্রবাসে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন মাহমুদুর রহমান। এটা সবার জন্য স্বস্তির বিষয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সারা দেশে ১২৪টিরও বেশি মামলা হয়। অবিশ্বাস্য!! একটি মামলায় মাহমুদুর রহমানকে সাত বছর কারাদণ্ড দেয় আদালত। মামলায় তাকে কারা নির্যাতনও ভোগ করতে হয়।

তথ্য হিসেবে বলে রাখি, আমার দেশ পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৪ সালে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা কী জিনিস এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য একটি পত্রিকাকে কীভাবে খেসারত দিতে হয়, তার নজির দৈনিক আমার দেশ। ২০১০ সালে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির মামলা করা হয়। আর ২০১৩ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনাই বন্ধ এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে দৈনিক আমার দেশ-এর কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী? দৈনিক আমার দেশ-এর সাহসী ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সম্পর্কে নতুন করে আমাদের বলার কিছু নেই। সেটা তো থাকবেই। বাংলাদেশের জনগণের এখনকার বাস্তব লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দু-একটি কথা পেশ করে রাখছি।

আমাদের প্রত্যাশা

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে জনগণ একটি সফল অভ্যুত্থান করার পরও একে ‘বিজয়ী’ গণঅভ্যুত্থানে রূপ দিতে পারেনি। আমরা একটি শিথিল উপদেষ্টা সরকার গঠন করেছি। ‘গণঅভ্যুত্থান’ এবং ‘বিজয়ী গণঅভ্যুত্থান’-এর ধারণাগত এবং বাস্তব পার্থক্য বিশাল। গণ-আন্দোলন ও গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণশক্তির পরিগঠন ঘটে। ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই শক্তিশালী গণশক্তি হিসেবে হাজির ও মূর্তমান হয়ে উঠেছিল। গণশক্তির মুখে খুনি ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালায়। ভারতে আশ্রয় নিয়ে দিল্লির হিন্দুত্ববাদী শক্তির মদদে ফ্যাসিস্ট শক্তি আবার বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই নতুন বাস্তবতা বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের জনগণের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণশক্তির যে মূর্তমান আবির্ভাব ঘটেছিল রাজনৈতিক ও আইনি সাহিত্যে সেটা গণসার্বভৌমত্ব (Peoples Sovereignty) নামে পরিচিত। গণঅভ্যুত্থান গণসার্বভৌমত্বের মূর্তমান বা প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি। সে কারণে গণঅভ্যুত্থান– অর্থাৎ যে রাজনৈতিক অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের অভিপ্রায়ের পরম রূপ হাজির করে– সেটাই ‘গণতন্ত্র’। আইনি ও রাজনৈতিক সাহিত্যে এই সত্যই স্বীকৃত। অনেকে একে Popular Sovereignty বলেও অভিহিত করে থাকেন। জনগণ স্বয়ং যখন এই অভ্যুত্থানের কর্তা তখন এই কর্তাসত্তার গণতান্ত্রিক মর্ম সুনির্দিষ্টভাবে বোঝানোর জন্য ‘জনগণ’ কথাটা সব সময়ই মনে রাখা জরুরি। এই বিশেষ কর্তার স্বরূপ ও ক্ষমতা নিয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক মহলে কোনো আলোচনা হয় না। যদি হতো তাহলে আমরা সহজেই বুঝতাম যে গণসার্বভৌমত্ব ধারণ করে যে গণশক্তি আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিগঠিত হয়ে তার পূর্ণ রূপ হাজির হয়েছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক ও আইনি মুহূর্তকে আমরা ধরতে পারিনি। অর্থাৎ শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে গণশক্তি আইনি ও রাজনৈতিক অর্থে ‘গাঠনিক শক্তি’ (Constituent Power) হিসেবে হাজির হয়। এই গাঠনিক শক্তি জনগণকে নতুনভাবে নিজেদের ‘গঠন’ করার যুগপৎ রাজনৈতিক ও আইনি ক্ষমতা দেয়। এই গাঠনিক শক্তির বলে জনগণ অনায়াসে ঘোষণা দিতে পারত যে শেখ হাসিনার পুরানা রাষ্ট্র তার ফ্যাসিস্ট সংবিধান, পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্টসহ চিরতরে বাতিল হয়ে গিয়েছে। জনগণ এখন নিজেদের হাতে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, হাজার শহীদের লাশ ও লড়াইয়ে হাজার হাজার পঙ্গু হয়ে পড়া বীরদের পক্ষে আমরা ক্ষমতাগ্রহণ করলাম। বীর জনগণের কাছে আমরা শপথ নিচ্ছি যে, দ্রুতই জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের আলোকে আমরা বাংলাদেশের জন্য নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ণের জন্য গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করলাম। জনগণ কী ধরনের রাষ্ট্র চায় তার জন্য বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, আলোচনার ব্যবস্থা করব এবং সবার সামষ্টিক অভিপ্রায় ধারণে সক্ষম একটি খসড়া প্রণয়ন করে গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করব। গণপরিষদ জনগণের অভিপ্রায় বিচার করে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। জনগণ যেন বুঝতে পারে যে তাদের অভিপ্রায় নতুন খসড়া গঠনতন্ত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে। তার জন্য খসড়া গঠনতন্ত্রে জনগণের সম্মতির জন্য গণপরিষদ একটি রেফারেন্ডামের ব্যবস্থা করবেন এবং গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করবেন। এরপর গণপরিষদ বিলুপ্ত হবে এবং নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন সরকার নির্বাচিত হবে। বলা বাহুল্য, আমরা তা না করে ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখলাম। উপদেষ্টা সরকার ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিযুক্ত প্রেসিডেন্টের কাছে শপথ নিলেন। গণঅভ্যুত্থানের পূর্ণ বিজয়ের আগেই সাংবিধানিক শূন্যতা এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে একটি প্রতিবিপ্লব ঘটে গেল। অর্থাৎ আইন বা সংবিধানের ধুয়া তুলে পুরানা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রই বহাল রাখা হলো। অর্থাৎ একটি ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ ঘটে গেল।

গণসার্বভৌমত্ব বা জনগণই সার্বভৌম– এ ধারণাই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ ধারণাও নেই। রাষ্ট্র এবং সরকারের ফারাকও আমরা বুঝি না। এই অভাবের ফলে আমাদের সমাজে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকেই গণতন্ত্র দাবি করে, যা সম্পূর্ণ ভুল। নির্বাচনবাদ বা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন না করে নির্বাচন দিয়ে লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণিকে আবার ১৫ বছর লুটপাটের ব্যবস্থা করে দেওয়াকে আমরা গণতন্ত্র বুঝি। অর্থাৎ গণতন্ত্র বলতে রাজনৈতিক দলগুলো এটাই বোঝে এবং আমাদেরও সেটা বোঝাতে চায়।

গণতন্ত্র মানে মোটেও নির্বাচন নয়। নির্বাচন হচ্ছে জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচনের একটি পদ্ধতি। কিন্তু সরকার মানে রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র রাষ্ট্রের বিশেষ রূপ বা ধরন। তাহলে গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত করতে হলে আগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম থাকা দরকার। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সরকারের পার্থক্য কী? আগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। তারপর সেই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার নির্বাচিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধীন সরকার। রাষ্ট্র যদি জনগণের অভিপ্রায়ের পরম রূপ হিসেবে আগে কায়েম করা না যায়, আগে গঠন ও প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে সরকার নির্বাচন করে তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা যাবে না। বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার নির্বাচনের দাবি অতএব গণতন্ত্র বিরোধী দাবি। আগে রাষ্ট্র, তারপর সরকার। ঘোড়ার আগে কেউ গাড়ি জুড়ে দেয় না।

কেন আমরা তারপরও আগে সরকার নির্বাচনের দাবি করি? কারণ আমরা রাষ্ট্র আর সরকারের মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছি। কিংবা এ দুইয়ের পার্থক্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক পরিসরে স্পষ্ট নয়। এই পার্থক্য মনে রাখলে আমরা বুঝব যদি আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই গড়তে না পারি, তাহলে নির্বাচন দিয়ে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের জন্য নতুন ফ্যাসিস্ট শাসকই শুধু নির্বাচিত করতে চাইছি। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত সরকার নির্বাচনের দাবি করে দশকের পর দশক ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা ও লুটপাটের রাজনীতি জিইয়ে রাখতে চাইছে। গণতন্ত্রবিরোধী এই ধারাকে মোকাবিলা এখন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে ‘জনগণ’ কারা? যারা ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং তাদের সংবিধানসহ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়ার জন্য লড়েছে। কাদের বিরুদ্ধে লড়েছে? শুধু বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং সব ধরনের জাতিবাদী এবং পরিচয়বাদী মতাদর্শ – অর্থাৎ সেক্যুলার কিংবা ধর্মীয়– সব ধরনের ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে এই গণঅভ্যুত্থান পরিচালিত হয়েছে। যে কারণে এই গণভ্যুত্থানের কর্তা যেমন কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, তেমনি কোনো প্রাচীন বা পরিত্যক্ত সেক্যুলার বা ধর্মীয় মতাদর্শ দ্বারাও পরিচালিত ছিল না। ধর্ম বনাম সেক্যুলারিজমের বাইনারি এর আগেই বাংলাদেশের জনগণ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং গণরাজনৈতিক ধারা চর্চার মধ্য দিয়ে মীমাংসা করেছে। জুলাই গণভ্যুত্থানের শক্তিশালী ভিত্তি এই মীমাংসার ওপর গঠিত। আমাদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক অর্জনের ওপর আগামী দিনে শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলতে হবে।

গণভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের অভিপ্রায় ঐতিহাসিকভাবে হাজির বা প্রদর্শিত হওয়ার পরেও তা পূর্ণ বিজয় অর্জন করতে পারেনি, তাকে সম্পূর্ণ করার দিশা ও কৌশল হাজির করার দায় আমাদের সবার ওপর এসে পড়েছে। সেই দায়ের দায়িক হয়ে দৈনিক আমার দেশ জনগণের পত্রিকা হয়ে উঠবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে, তার পূর্ণ বিকাশ ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে দৈনিক আমার দেশ ভূমিকা রাখবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতির যে নতুন ঐতিহাসিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে।

বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির পতনের পর আমরা দেখছি ধর্মীয় পরিচয়বাদী বা ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির যেমন সেক্যুলারে রূপ রয়েছে, তেমনি তার ধর্মীয় পরিচয়বাদী রূপও রয়েছে। শুধু পাশ্চাত্য বা গ্রিক-খ্রিস্টীয় চিন্তা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নজিরকে একমাত্র আদর্শ মেনে আমরা নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে পারব না। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ধ্যানধারণা ও গোলামি থেকে বের হয়ে এসে আমাদের অবশ্যই নিজ নিজ ধর্ম ও ঐতিহ্যের মধ্যে নতুনভাবে সমাজ নির্মাণ এবং নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার উপাদান ও চিন্তা অন্বেষণ করতে হবে। ইসলাম মানুষের মহিমা কায়েমের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজ গঠন ও কায়েম করার দর্শন ও রাজনীতি হাজির করেছে, তা নানা ঐতিহাসিক ব্যর্থতার কারণে ম্লান ও অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের কাজ কোরআনুল করিমের হেদায়েত এবং ইসলামের ঐতিহ্য (discursive tradition) পর্যালোচনা করে নতুন সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার আদর্শ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কৌশল নতুন ভাবে হাজির করা। আল্লাহ মনুষ্য প্রজাতিকে শুধু কোরআন ও রসুল দেননি, একই সঙ্গে বিবেক, বুদ্ধি, প্রেম, ভালোবাসা এবং সামাজিক হওয়ার বিবিধ বৃত্তি দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। দরকার সেসব বৃত্তির পূর্ণ ব্যবহার এবং মনুষ্য প্রজাতির বিবেক, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার বিকাশ। দরকার বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এবং মজলুমের পক্ষে সঠিকভাবে লড়তে পারা এবং নতুন বিশ্বের জন্ম দেওয়া। বর্তমান ‘আধুনিক রাষ্ট্র– অর্থাৎ গ্রিক-খ্রিস্টীয় চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতে যে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, সেটাই একমাত্র এবং চূড়ান্ত আদর্শ হতে পারে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার এবং নিজেদের নিজেরা নতুনভাবে গঠন করার আদর্শ, নীতি ও কৌশল অন্বেষণের মধ্য দিয়ে শুধু নতুন বাংলাদেশ নয়, নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্ন আমাদের দেখতে হবে।

আমাদের প্রত্যাশা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে নতুন বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে দৈনিক আমার দেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে।

১০ ডিসেম্বর ২০২৪, শ্যামলী

বিষয়:

আমার দেশ
ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত