কামাল আহমেদ
বিশ্বের নিকৃষ্টতম স্বৈরশাসকদের অন্যতম শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবের আগে ও পরের সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা নিয়ে খুব বেশ একটা আলোচনা গত কয়েক মাসে হয়েছে বলে মনে হয় না। অন্তত পত্রিকার পাতায় বা ছোটপর্দার আলোচনায় তা নজরে পড়ে না। অথচ করুণ ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো গণঅভ্যুত্থান গণরোষের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সংবাদমাধ্যম।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভবনে যেমন বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন লাগিয়েছে, তেমনি পুড়িয়ে দিয়েছে বেসরকারি একাধিক টিভি চ্যানেল। আক্রান্ত হয়েছেন সাংবাদিকরা, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি পত্রিকার অফিস, কোথাও কোথাও প্রেস ক্লাব ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিক্ষুব্ধ লোকজনের অভিযোগ, এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি হয় স্বৈরশাসকের সহযোগী, নয়তো তাদের আপসকামিতা ও নিষ্ক্রিয়তা স্বৈরশাসন প্রলম্বিত করায় সাহায্য করেছে।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের সুর বদলে গেছে। একেবারে ১৮০ ডিগ্রি। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার দিনে যে পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘এখন পর্যন্ত সরকার অনেক ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে’, সেই কাগজেই পরদিন দেশবাসীকে শান্ত থাকার জন্য খালেদা জিয়ার আহ্বান প্রথম পাতায় ছাপা হলো। এর আগের প্রায় এক দশকে বিএনপি নেত্রীর কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য তাদের প্রথম পাতায় স্থান পায়নি। চরিত্রহননমূলক কুৎসা হলে অবশ্য তা ফলাও করে ছাপা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা সাংবাদিকরা কি নিজেদের অতীতকে মূল্যায়ন করেছেন? রাতারাতি সুর বদল, সম্পাদকীয় নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন, কোথাও কোথাও সম্পাদকীয় নেতৃত্বে রদবদল– এগুলো কি সেই সুবিধাবাদী আপসকামিতার ধারাবাহিকতা? নাকি, আক্রান্ত হওয়ার ভয় থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য বদলের তড়িৎ প্রতিক্রিয়া? সুবিধাবাদী আপসকামিতা কিংবা তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার বিপদ হচ্ছে, স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে সাংবাদিকতায় গুণগত কোনো পরিবর্তন না হওয়া। শুধু শাসকের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানো, যাতে স্বাধীন চিন্তা ও মননের বদলে তোষামোদি ও চাটুকারিতার সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়।
অবশ্য এ কথা মানতেই হয় যে গণমাধ্যমের জগৎটা আমাদের সমাজের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র কোনো দ্বীপ নয় এবং সমাজের অন্যান্য অংশে যেসব আচার-সংস্কৃতি চালু আছে, তার থেকে আলাদা কিছু হওয়া এককভাবে প্রায় অসম্ভব। পতিত আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠাতে রাষ্ট্রকাঠামোর সর্বস্তরে এবং প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের যে পদ্ধতিগত ব্যবস্থা চালু করেছিল, তাতে দুধরনের সহযোগী দেখা গেছে।
এসব সহযোগীর মধ্যে একান্তভাবে দলীয় নীতি-আদর্শের সৈনিকরা যেমন ছিল, তেমনি আরেক দল ছিল সুবিধাবাদী এবং সুযোগের সদ্ব্যবহারকারী। অনেক ক্ষেত্রে সুযোগসন্ধানীরাই স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ও ক্ষমতা সংহত করায় সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জুগিয়েছে এবং আগ বাড়িয়ে তার সহযোগী হয়েছে। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি, তা সে গণমাধ্যমের মালিকরাই হোক কিংবা সাংবাদিক ও কর্মীই হোক।
দেশে গণতন্ত্রে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যখনই রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তখনই জনমনে গণমাধ্যমের প্রতি প্রত্যাশা বেড়েছে। সবার মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে যে সামরিক শাসনামলের মিঞা-বিবির বাক্স নামে কুখ্যাতি পাওয়া টেলিভিশন কিংবা সরকারপ্রধানের বন্দনা ছাপানো সংবাদপত্রেও পরিবর্তন ঘটবে। ১৯৯০ সালে তিন জোটের ঘোষণাতেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা ছিল। অবশ্য সেখানে ‘পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ’ রাখার উদ্দেশ্যে ‘সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে’ বলে অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তখন বেসরকারি কোনো রেডিও-টিভি ছিল না এবং সরকারি মালিকানায় দুটি দৈনিক ও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল।
এখানে অবশ্য স্মরণ করা দরকার, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলেই সাংবাদিকতার ওপর নেমে এসেছিল সবচেয়ে বড় খড়গ। দেশে গণতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার সময়েই সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি দৈনিক ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানার দুটি পত্রিকা সরকার অধিগ্রহণ করে চারটি পত্রিকাকে সচল রেখে বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলেই প্রথম সংবাদপত্র অফিসে হামলা চালানো এবং সম্পাদককে গ্রেপ্তারের মতো নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয়ে প্রবেশ করে প্রতিটি কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ করে এবং সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। একই সময় গণকণ্ঠ সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরের ৩৪ বছরে গণমাধ্যমের দৃশ্যপটে পরিবর্তন হয়েছে অনেক– যার মধ্যে প্রযুক্তির রূপান্তরও গুরুত্বপূর্ণ। খবরের কাগজের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। পত্রিকার মতোই ব্যক্তিমালিকানায় চালু হয়েছে কয়েক ডজন টেলিভিশন ও এফএম রেডিও। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নিয়ন্ত্রণ, কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো সরাসরি। পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের একটা বড় কৌশল ছিল রাজনৈতিকভাবে অনুগত থাকার শর্তে চ্যানেল চালু অথবা পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেওয়া। আর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনবঞ্চনা, গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে হুমকি দেওয়া এবং হয়রানিমূলক মামলা। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তি হিসেবে সাংবাদিকদের শারীরিক নিগ্রহ, হামলা ও হত্যার ঘটনাও ছিল নিত্যকার উপসর্গ।
সংবাদমাধ্যম অন্যান্য সরকার ও দলের কাছে নিগ্রহের শিকার হয়নি, এমন নয়। রাজনীতিকরা যখনই কোনো সত্য প্রকাশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছে অথবা কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে, তখনই সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছেন। সমালোচনা সহ্য করার মতো সহনশীল ও গণতান্ত্রিক মানসিকতার অভাব আমাদের সমাজে প্রকট। তবে ইতিহাসের বিচারে সংবাদমাধ্যমের প্রতি আওয়ামী লীগের আচরণ সবচেয়ে খারাপ, দমনমূলক ও নিষ্ঠুর।
সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী রাষ্ট্রপ্রধান তিমুর লেস্টে বা পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা। স্বাগতিক সরকারপ্রধান শান্তিতে আরেক নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস তার সম্মানে যে নৈশভোজের আয়োজন করেন, সেখানে এক বক্তৃতায় তিনি বললেন যে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পূর্ব তিমুর হচ্ছে গণতন্ত্রের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে। তিনি আরও জানান, মুক্ত গণমাধ্যমের বৈশ্বিক সূচকে তার দেশের অবস্থান কিছুটা পড়ে গেলেও এই একই অঞ্চলে সবার ওপরে। তিনি নৈশভোজে উপস্থিত পশ্চিমা কূটনীতিকদের ঈষৎ কটাক্ষ করে বলেন, এই সূচকে পূর্ব তিমুরের অবস্থান যেখানে ২০তম, সেখানে যুক্তরাজ্য আছে তার তিন ধাপ নিচে ২৩-এ, আর যুক্তরাষ্ট্র ৫৫-তে।
যারা এই সূচক তৈরি করে, সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার সেই সংগঠন, রিপোর্টার্স স্যঁ ফ্রতিয়েঁ (আরএসএফ)-এর ওয়েবসাইটে ঢু মেরে দেখলাম ১৯৯ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে গত ২৫ বছরে কোনো সাংবাদিককে কখনো তার কাজের জন্য জেলে যেতে হয়নি। আরএসএফের ভাষ্য বলছে, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব করার ঝুঁকি সেখানে সীমিত। আরএসএফ অবশ্য ২০১৪ সালের মিডিয়া ল’র কারণে সাংবাদিকতায় কিছুটা ঝুঁকি রয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেছে।
এক বছর আগে ২০২৩ সালের সূচকে পূর্ব তিমুরের অবস্থান ছিল দশম এবং এক বছরে তার ১০ ধাপ অবনমন হলেও দেশটি পাশ্চাত্যের অনেক দেশকেই বিব্রত করতে পারছে। দেশটির সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, প্রেসিডেন্ট হোর্তা এই অবনমনের কারণ খুঁজে বের করতে প্রেস কাউন্সিল এবং সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারের কোনো কাজের জন্য সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়ে থাকলে তিনি তার জন্য হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, গণমাধ্যমকে মুক্ত রাখতে হবে, এমন কিছু করা যাবে না, যাতে তাদের স্বাধীনতা খর্ব হয়।
ঢাকার ওই নৈশভোজেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস পরিচয় করিয়ে দিলেন পূর্ব তিমুরে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে যিনি কাজ করেছেন, সেই বাংলাদেশি নারী আমিরা হককে। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, পূর্ব তিমুরের পুলিশ বাহিনী গঠনেও ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ পুলিশ। আর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দেশটির স্বাধীনতালাভের প্রক্রিয়ায় দেশটির শান্তিরক্ষায় অবদান রেখেছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী পূর্ব তিমুর যখন বাংলাদেশিদের সহায়তায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে সফল হয়েছে, যেখানে মুক্ত সংবাদমাধ্যম সূচকে তারা পাশ্চাত্যের উন্নত গণতন্ত্রের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পেরেছে, সেখানে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি হতাশার ও লজ্জার। বিশ্ব গণমাধ্যম সূচকের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫-তে অধঃপতিত বাংলাদেশকে এই গ্লানি থেকে মুক্ত করাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বের নিকৃষ্টতম স্বৈরশাসকদের অন্যতম শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবের আগে ও পরের সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা নিয়ে খুব বেশ একটা আলোচনা গত কয়েক মাসে হয়েছে বলে মনে হয় না। অন্তত পত্রিকার পাতায় বা ছোটপর্দার আলোচনায় তা নজরে পড়ে না। অথচ করুণ ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো গণঅভ্যুত্থান গণরোষের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সংবাদমাধ্যম।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভবনে যেমন বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন লাগিয়েছে, তেমনি পুড়িয়ে দিয়েছে বেসরকারি একাধিক টিভি চ্যানেল। আক্রান্ত হয়েছেন সাংবাদিকরা, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি পত্রিকার অফিস, কোথাও কোথাও প্রেস ক্লাব ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিক্ষুব্ধ লোকজনের অভিযোগ, এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি হয় স্বৈরশাসকের সহযোগী, নয়তো তাদের আপসকামিতা ও নিষ্ক্রিয়তা স্বৈরশাসন প্রলম্বিত করায় সাহায্য করেছে।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের সুর বদলে গেছে। একেবারে ১৮০ ডিগ্রি। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার দিনে যে পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘এখন পর্যন্ত সরকার অনেক ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে’, সেই কাগজেই পরদিন দেশবাসীকে শান্ত থাকার জন্য খালেদা জিয়ার আহ্বান প্রথম পাতায় ছাপা হলো। এর আগের প্রায় এক দশকে বিএনপি নেত্রীর কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য তাদের প্রথম পাতায় স্থান পায়নি। চরিত্রহননমূলক কুৎসা হলে অবশ্য তা ফলাও করে ছাপা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা সাংবাদিকরা কি নিজেদের অতীতকে মূল্যায়ন করেছেন? রাতারাতি সুর বদল, সম্পাদকীয় নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন, কোথাও কোথাও সম্পাদকীয় নেতৃত্বে রদবদল– এগুলো কি সেই সুবিধাবাদী আপসকামিতার ধারাবাহিকতা? নাকি, আক্রান্ত হওয়ার ভয় থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য বদলের তড়িৎ প্রতিক্রিয়া? সুবিধাবাদী আপসকামিতা কিংবা তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার বিপদ হচ্ছে, স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে সাংবাদিকতায় গুণগত কোনো পরিবর্তন না হওয়া। শুধু শাসকের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানো, যাতে স্বাধীন চিন্তা ও মননের বদলে তোষামোদি ও চাটুকারিতার সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়।
অবশ্য এ কথা মানতেই হয় যে গণমাধ্যমের জগৎটা আমাদের সমাজের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র কোনো দ্বীপ নয় এবং সমাজের অন্যান্য অংশে যেসব আচার-সংস্কৃতি চালু আছে, তার থেকে আলাদা কিছু হওয়া এককভাবে প্রায় অসম্ভব। পতিত আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠাতে রাষ্ট্রকাঠামোর সর্বস্তরে এবং প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের যে পদ্ধতিগত ব্যবস্থা চালু করেছিল, তাতে দুধরনের সহযোগী দেখা গেছে।
এসব সহযোগীর মধ্যে একান্তভাবে দলীয় নীতি-আদর্শের সৈনিকরা যেমন ছিল, তেমনি আরেক দল ছিল সুবিধাবাদী এবং সুযোগের সদ্ব্যবহারকারী। অনেক ক্ষেত্রে সুযোগসন্ধানীরাই স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ও ক্ষমতা সংহত করায় সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জুগিয়েছে এবং আগ বাড়িয়ে তার সহযোগী হয়েছে। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি, তা সে গণমাধ্যমের মালিকরাই হোক কিংবা সাংবাদিক ও কর্মীই হোক।
দেশে গণতন্ত্রে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যখনই রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তখনই জনমনে গণমাধ্যমের প্রতি প্রত্যাশা বেড়েছে। সবার মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে যে সামরিক শাসনামলের মিঞা-বিবির বাক্স নামে কুখ্যাতি পাওয়া টেলিভিশন কিংবা সরকারপ্রধানের বন্দনা ছাপানো সংবাদপত্রেও পরিবর্তন ঘটবে। ১৯৯০ সালে তিন জোটের ঘোষণাতেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা ছিল। অবশ্য সেখানে ‘পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ’ রাখার উদ্দেশ্যে ‘সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে’ বলে অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তখন বেসরকারি কোনো রেডিও-টিভি ছিল না এবং সরকারি মালিকানায় দুটি দৈনিক ও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল।
এখানে অবশ্য স্মরণ করা দরকার, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলেই সাংবাদিকতার ওপর নেমে এসেছিল সবচেয়ে বড় খড়গ। দেশে গণতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার সময়েই সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি দৈনিক ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানার দুটি পত্রিকা সরকার অধিগ্রহণ করে চারটি পত্রিকাকে সচল রেখে বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলেই প্রথম সংবাদপত্র অফিসে হামলা চালানো এবং সম্পাদককে গ্রেপ্তারের মতো নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয়ে প্রবেশ করে প্রতিটি কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ করে এবং সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। একই সময় গণকণ্ঠ সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরের ৩৪ বছরে গণমাধ্যমের দৃশ্যপটে পরিবর্তন হয়েছে অনেক– যার মধ্যে প্রযুক্তির রূপান্তরও গুরুত্বপূর্ণ। খবরের কাগজের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। পত্রিকার মতোই ব্যক্তিমালিকানায় চালু হয়েছে কয়েক ডজন টেলিভিশন ও এফএম রেডিও। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নিয়ন্ত্রণ, কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো সরাসরি। পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের একটা বড় কৌশল ছিল রাজনৈতিকভাবে অনুগত থাকার শর্তে চ্যানেল চালু অথবা পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেওয়া। আর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনবঞ্চনা, গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে হুমকি দেওয়া এবং হয়রানিমূলক মামলা। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তি হিসেবে সাংবাদিকদের শারীরিক নিগ্রহ, হামলা ও হত্যার ঘটনাও ছিল নিত্যকার উপসর্গ।
সংবাদমাধ্যম অন্যান্য সরকার ও দলের কাছে নিগ্রহের শিকার হয়নি, এমন নয়। রাজনীতিকরা যখনই কোনো সত্য প্রকাশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছে অথবা কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে, তখনই সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছেন। সমালোচনা সহ্য করার মতো সহনশীল ও গণতান্ত্রিক মানসিকতার অভাব আমাদের সমাজে প্রকট। তবে ইতিহাসের বিচারে সংবাদমাধ্যমের প্রতি আওয়ামী লীগের আচরণ সবচেয়ে খারাপ, দমনমূলক ও নিষ্ঠুর।
সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী রাষ্ট্রপ্রধান তিমুর লেস্টে বা পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা। স্বাগতিক সরকারপ্রধান শান্তিতে আরেক নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস তার সম্মানে যে নৈশভোজের আয়োজন করেন, সেখানে এক বক্তৃতায় তিনি বললেন যে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পূর্ব তিমুর হচ্ছে গণতন্ত্রের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে। তিনি আরও জানান, মুক্ত গণমাধ্যমের বৈশ্বিক সূচকে তার দেশের অবস্থান কিছুটা পড়ে গেলেও এই একই অঞ্চলে সবার ওপরে। তিনি নৈশভোজে উপস্থিত পশ্চিমা কূটনীতিকদের ঈষৎ কটাক্ষ করে বলেন, এই সূচকে পূর্ব তিমুরের অবস্থান যেখানে ২০তম, সেখানে যুক্তরাজ্য আছে তার তিন ধাপ নিচে ২৩-এ, আর যুক্তরাষ্ট্র ৫৫-তে।
যারা এই সূচক তৈরি করে, সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার সেই সংগঠন, রিপোর্টার্স স্যঁ ফ্রতিয়েঁ (আরএসএফ)-এর ওয়েবসাইটে ঢু মেরে দেখলাম ১৯৯ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে গত ২৫ বছরে কোনো সাংবাদিককে কখনো তার কাজের জন্য জেলে যেতে হয়নি। আরএসএফের ভাষ্য বলছে, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব করার ঝুঁকি সেখানে সীমিত। আরএসএফ অবশ্য ২০১৪ সালের মিডিয়া ল’র কারণে সাংবাদিকতায় কিছুটা ঝুঁকি রয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেছে।
এক বছর আগে ২০২৩ সালের সূচকে পূর্ব তিমুরের অবস্থান ছিল দশম এবং এক বছরে তার ১০ ধাপ অবনমন হলেও দেশটি পাশ্চাত্যের অনেক দেশকেই বিব্রত করতে পারছে। দেশটির সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, প্রেসিডেন্ট হোর্তা এই অবনমনের কারণ খুঁজে বের করতে প্রেস কাউন্সিল এবং সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারের কোনো কাজের জন্য সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়ে থাকলে তিনি তার জন্য হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, গণমাধ্যমকে মুক্ত রাখতে হবে, এমন কিছু করা যাবে না, যাতে তাদের স্বাধীনতা খর্ব হয়।
ঢাকার ওই নৈশভোজেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস পরিচয় করিয়ে দিলেন পূর্ব তিমুরে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে যিনি কাজ করেছেন, সেই বাংলাদেশি নারী আমিরা হককে। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, পূর্ব তিমুরের পুলিশ বাহিনী গঠনেও ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ পুলিশ। আর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দেশটির স্বাধীনতালাভের প্রক্রিয়ায় দেশটির শান্তিরক্ষায় অবদান রেখেছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী পূর্ব তিমুর যখন বাংলাদেশিদের সহায়তায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে সফল হয়েছে, যেখানে মুক্ত সংবাদমাধ্যম সূচকে তারা পাশ্চাত্যের উন্নত গণতন্ত্রের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পেরেছে, সেখানে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি হতাশার ও লজ্জার। বিশ্ব গণমাধ্যম সূচকের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫-তে অধঃপতিত বাংলাদেশকে এই গ্লানি থেকে মুক্ত করাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতের জন্য যা করেছেন, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে ভারত শুধু আশ্রয় দিয়ে বসে থাকবে না, তাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা চেষ্টা করে যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের দাবি তোলে, তখন সাধারণ মানুষ
৬ ঘণ্টা আগেবিশ্বের নানা অঞ্চলে প্রভাবশালী ও তুলনামূলকভাবে বৃহৎ রাষ্ট্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপে জার্মানি ও ফ্রান্স এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলের উল্লেখ করা যেতে পারে।
৯ ঘণ্টা আগেপূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল। আমার দেশ-এর পুনঃপ্রকাশনা সেই রক্ত লালের সংগ্রামেরই একটা অংশ। আমাদের মতো লোকেরা আমার দেশ-এর মতো পত্রিকার প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই। আল্লাহপাক মজলুমের পক্ষে।
১ দিন আগেচেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) আজ আমাকে বলেছেন, কি খান সাহেব, হাসিনা আসছে বলে কি ভয় পাচ্ছেন? এটা শুনে আমরা কিছুটা অবাকই হলাম। মনে হলো তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ভয় পাচ্ছেন!
১ দিন আগে