আসিফ নজরুল
আমাদের জন্য মুষড়েপড়া দিনের শুরু হয় ২৮ অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে। এদিন নয়াপল্টনে বিএনপির বিশাল সমাবেশ শত শত সাউন্ড গ্রেনেড আর গুলি মেরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফা আক্রমণ হিসেবে শুরু হয় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা আর ঢালাও গ্রেপ্তারের পালা। অল্পদিনের মধ্যে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আওয়ামী লীগ আবারও একটি প্রহসনের নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসছে।
২৮ অক্টোবরের আগে বিএনপির ধারাবাহিক জনসভা আর এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ অনেককে আশান্বিত করেছিল। একইসঙ্গে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ আমেরিকার নানামুখী চাপে মানুষের এই আশা আরও প্রসারিত হয়েছিল। মনে হতো এবার বুঝি সুদিন আসছে। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের অল্প কদিন আগে ভারতের চাপে আমেরিকা তার কঠোর ভূমিকা থেকে সরে আসে। তবু মানুষের মনে ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ এবার অন্তত বড় ধরনের নির্বাচনি জালিয়াতি করার সাহস করবে না। অবশ্য নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আওয়ামী লীগ তার পথেই এগোবে।
দেশকে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে আওয়ামী লীগ নতুন একধরনের জালিয়াতির নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী নিজেই ডামি প্রার্থী দাঁড় করানোর ঘোষণা দিয়ে ‘নির্বাচন’ নামের এক আজব তামাশা শুরু করেন। ওই নির্বাচন মানুষ আমি-ডামি নির্বাচন বলে অভিহিত করে। আর আমি বলতাম, এটি ছিল এক ভোটারের নির্বাচন। এটি আসলেই ছিল শুধু শেখ হাসিনা নামে এক ভোটারের নির্বাচন। ৩০০ আসনের প্রতিটিতে তার সিদ্ধান্তে প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার নাটক সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনকে তিনি ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ আখ্যায়িত করে গোটা জাতির সঙ্গে নতুন এক নিষ্ঠুর তামাশায় মেতে ওঠেন।
মানুষের ক্ষোভ ছিল, রাগ ছিল; কিন্তু সবই ছিল অবরুদ্ধ। মনে আছে, নির্বাচনের পর আলোচনা অনুষ্ঠান দূরের কথা, নির্বাচনকে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার মতো লোকও খুঁজে পেতাম না তখন দেশে। গভীর রাতে ঘুম না এলে একা একা জানালার পাশে বসে থাকতাম। মনে হতো এই অন্ধকার থেকে কোনোদিনই মুক্তি পাব না আমরা। এরপর জুলাই মাসে এক অচিন্ত্যনীয় ও অভূতপূর্ব গণআন্দোলনে খড়কুটোর মতো ভেসে যায় শেখ হাসিনাসহ তার পুরো দল। তবে এজন্য চরম মূল্য দিতে হয় বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আর তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো সমাজের নানা স্তরের মানুষকে। কমপক্ষে এক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় মাত্র দুই সপ্তাহে, অঙ্গহানি বা গুরুতরভাবে আহত হতে হয় প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে। পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে এত অল্প সময়ে এত মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা বিরল। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো শাসকের হাতেও এত বড় গণহত্যার নজির নেই।
তারপরও মানুষ আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। আমরা সেই বিখ্যাত ফুটেজে দেখেছি একজন পুলিশকে বলতে যে, ‘গুলি করলে একটাই মরে, বাকিরা সরে না; এটাই আতঙ্কের।’ আমার কাছে একজন আহত ছাত্র বর্ণনা করেছে কীভাবে তারা গাছ বা ভবনের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে পুলিশকে গুলি করতে প্রলুব্ধ করত, গুলিবর্ষণ শেষ হলে পুলিশকে পাল্টা ধাওয়া দিত। যাত্রাবাড়ীর একটা ফুটেজে দেখেছি গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে সঙ্গীরা। তাদের পাশ দিয়েই ছুটে চলেছে আন্দোলনের আগুনস্রোতে উন্মত্ত জনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি কীভাবে এক রাতে পিটিয়ে হলছাড়া করা হয়েছে নির্যাতক ও হত্যাকারী সংগঠন দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ছাত্রলীগকে।
এই গণঅভ্যুত্থান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, জীবনপণ ও ব্যাপকতম পরিসরের। স্কুলের ছেলে মাকে চিঠি লিখে শেষ বিদায় জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে, ক্যান্টনমেন্টের অভিভাবকরা রাস্তায় নেমেছেন গণহত্যার প্রতিবাদে, হাতকড়া পরা ছেলের পিঠ চাপড়ে সাহস জুগিয়েছেন মা, দুহাত প্রসারিত করে পুলিশের গুলি বুকে নিয়েছেন আবু সাঈদরা। মাদরাসা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী, প্রবাস থেকে দেশে ছুটিতে আসা তরুণ, প্রবাসী, শ্রমিক-কর্মচারী- সবাই নেমেছে রাস্তায়। মহাকাব্যোর মতো এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত গড়ে উঠেছে শেখ হাসিনার একযুগের নির্মম, নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে।
২.
শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার সূচনা ঘটে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের মদতে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারান অর্ধশতাধিক চৌকস সামরিক কর্মকর্তা। হত্যাকাণ্ডের দায় পুরোপুরি বিডিআর সদস্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের। অভিন্ন এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে একইসঙ্গে দুর্বল করা হয় বাংলাদেশ সেনাবহিনী ও বিডিআরকে। এরপর শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অতিবিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়, বিএনপি ও সমমনা দলের নৈতিক অবস্থান নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়, শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় দেশের আলেম-ওলামা আর মাদরাসাছাত্রদের। কিন্তু এসব ঘটনা ঘটানোর পরও সরকারের পক্ষে যে টিকে থাকা দুঃসাধ্য- তার রায় পাওয়া যেতে থাকে ২০১৩ সালের স্থানীয় নির্বাচনগুলোয়। এ সময়ে বিশেষ করে গাজীপুরে মেয়র নির্বাচনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও বিএনপি প্রার্থীর ভূমিধস বিজয়কে ঠেকাতে না পারার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কুৎসিত এক বন্দোবস্ত গড়ে তোলে। এই বন্দোবস্ত ছিল নির্বাচনি কারচুপি, দলীয়করণ, মিথ্যাচার, দমননীতি, আর ভারত তোষণমূলক।
১) কারচুপি : শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, সব পর্যায়ের নির্বাচনে কারচুপি আর জুলুমের মাধ্যমে দখল করতে থাকে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে ফুটবল ক্লাবসহ কোনোকিছু বাদ রাখেনি দলটি। এই কারচুপি করার জন্য তারা রাষ্ট্রীয় অর্থ, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, দলীয় গুণ্ডা- সবকিছুর ব্যবহার করতে থাকে বেপরোয়াভাবে। ফলে নির্বাচন হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার প্রতিনিধি নিয়োগের বাহন হিসেবে।
২) দলীয়করণ : দলীয়করণ চলে প্রশাসনের সব স্তরে। ঘোষণা দিয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগকর্মীদের প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়। এরপর পোস্ট, পদোন্নতি, বদলি পুরস্কার-খেতাব সব ক্ষেত্রে চলে অবাধ দলীয়করণ। এটি আরও সহজসাধ্য করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মতো আইডেন্টিটি ভুয়াভাবে ব্যবহারের নানা ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হয়। দলীয়করণ নিশ্চিত করার জন্য এমনকি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয় পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের নামে; গণহারে বৈষম্যের শিকার করা হয় দাড়ি-টুপির মানুষ ও মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের তরুণদের।
৩) মিথ্যাচার : এসবের পাশাপাশি চলে লাগাতার জঘন্য মিথ্যাচার। কুৎসা, চরিত্র হনন, অপবাদ আর অশ্লীল গালাগালিতে মেতে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিরাট একটি অংশ। এই নোংরামির প্রধান শিকার ছিল জিয়া পরিবার, ড. ইউনূস এবং দেশের তরুণ সমাজ। সারাদেশে শিবির ট্যাগ দিয়ে অসংখ্য তরুণকে আক্রমণ করা হয়; এরপর পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
৪) দমননীতি : মিটিং-মিছিলে হামলা আর গায়েবি মামলায় উল্টো বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাই শুধু নয়, ভিন্নমত দমনে আওয়ামী লীগ সরকার বেছে নেয় নির্যাতনের নিষ্ঠুরতম পদ্ধতিগুলো। অবাধ গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ করে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধ করা হয়, গণরুমকেন্দ্রিক বর্বর নির্যাতন চালিয়ে ছাত্রদের বশংবদ বানানোর চেষ্টা করা হয়।
৫) দুর্নীতি : দলের রাজনীতিবিদ, অনুগত ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জন্য বাংলাদেশকে লুটের রাজ্য বানিয়ে ফেলে আওয়ামী লীগ সরকার। এসবকে নিরাপদ রাখার জন্য দায়মুক্তি আইন ও দমনমূলক বিভিন্ন আইন জারি করা হয়। রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাটের পাশাপাশি ব্যাংক ও শেয়ার মার্কেট থেকে সাধারণ মানুষের অর্থ লুটপাটের মতো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে জড়িয়ে পড়ে তারা। আদানিসহ ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি করে ভারতের সব ধরনের ইচ্ছে পূরণ করা হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা করে এমন এক কায়েমি স্বার্থ গ্রুপ তৈরি করা হয়, যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই দুর্নীতির চূড়ামণি শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষার জন্য কমিটেড হয়ে ওঠে।
৬) ভারত তোষণনীতি : এসবের পাশাপাশি চলে নির্লজ্জ ও প্রকাশ্যে ভারত তোষণনীতি। ভারতের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত, বন্দর, রেল ও সড়কপথ খুলে দেওয়া হয়, প্রজেক্ট ওয়ার্কার পরিচয়ে ভারতীয়দের বিনা অনুমতিতে চাকরি করার সুযোগ দেওয়া হয়, রাষ্ট্রপরিচালনার প্রায় সর্বক্ষেত্রে ভারতের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো হয়, সীমান্ত হত্যার জন্য উল্টো নিজ দেশের মানুষকে দায়ী করা হয়। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ভারতকে এমন কিছু দিয়েছি যা কখনো তারা ভুলতে পারবে না। নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা এভাবে অন্য দেশের হাতে তুলে দেওয়ার এমন নজির অন্যান্য স্বৈরশাসকের মধ্যেও ছিল অতিবিরল এক ঘটনা।
ওপরে বর্ণিত প্রতিটি বিষয় মানুষকে ক্ষুব্ধ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক দলের আন্দোলনেও ব্যাপক জনসমাগম ছিল। কিন্তু নিষ্ঠুরভাবে দলীয় ক্যাডার ও পুলিশের সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এসব দমন করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে যায় যে, দেশের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে বিস্ফোরণোন্মুখ।
৩.
এই বিস্ফোরণোন্মুখ জনতা বাঁধভাঙা হয়ে ওঠে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। আরেকটি ভুয়া নির্বাচনে জিতে আসার পর কোটা ব্যবস্থার মতো একটি মীমাংসিত বিষয় আদালতে ঠেলে দিয়ে সরকারি চাকরির সুযোগ আবার সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করার দুঃসাহসে মেতে ওঠে আওয়ামী লীগ। এ সময়ে একের পর এক উসকানি ও ঔদ্ধত্যমূলক কর্মকাণ্ড করে আওয়ামী লীগ মানুষের ধৈর্যের শেষ বাঁধও ভেঙে ফেলে। কোটা আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রদের পাইকারিভাবে ‘রাজাকার’ সম্বোধন, আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে শক্তি প্রয়োগ, আবু সাঈদকে নির্মমভাবে হত্যা, আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার ও স্নাইপার ব্যবহার, বাড়ি বাড়ি রাতের বেলায় অভিযান- এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে সমাজের সব স্তরের মানুষ জীবনের মায়া উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা সুচিন্তিত, অভিনব ও সাহসী সিদ্ধান্ত দিয়ে এই আন্দোলনকে সংগঠিত ও চূড়ান্তভাবে সফল করে তোলে। কয়েকজন নেতার গ্রেপ্তারে যাতে আন্দোলন থেমে না যায়, এ জন্য তারা বহুসংখ্যক নেতা বা সমন্বয়ক ঠিক করে, আংশিক বিজয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে আরও সাহসী দাবি উত্থাপন করে, পুলিশি নির্যাতনের পরও আন্দোলনে অবিচল থাকে, গ্রাফিতি ও বাংলা ব্লকেডের মতো অভিনব কর্মসূচি প্রদান করে। সবশেষে গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আকস্মিকভাবে এক দিন এগিয়ে এনে অত্যাচারী সরকারকে দিশাহারা করে ফেলে। এই প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক, সময়ানুগ ও প্রাজ্ঞচিত্ত। জুলাই আন্দালনের নেতৃত্ব পর্যায়ের সিদ্ধান্তগুলো তাই সুচিন্তিত ছিল, ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো একেই ‘মেটিকুল্যাসলি ডিজাইনড’ বলেছেন। কিন্তু এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। কেউ এই আন্দোলনে নামার জন্য কাউকে বাধ্য করেনি, টাকা দিয়ে ভাড়াটে বাহিনী নামায়নি বা কোনো ষড়যন্ত্রও করেনি।
জুলাই আন্দোলনকালে আবু সাঈদের হত্যা দেখে আমাদের বাড়ির গৃহকর্মী ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। একজন বয়স্ক আত্মীয় বলেছেন, নাতির খোঁজে রাতে পুলিশ আসে বাসায়, নাতি মরলে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ; দলে দলে মানুষ রাস্তায় নেমেছে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে, মৃত্যুভয়কে জয় করে। মানুষের মনে এই বোধ জন্মেছিল যে, আবু সাঈদ-মুগ্ধ-ওয়াসীম মরতে পারলে, নাহিদ-আসিফরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকলে আমাদের মৃত্যুভয় বলে কিছু থাকতে পারে না। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে সরাতে স্বতঃস্ফূর্ত এই জীবনপণ সংগ্রাম বিশ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মতো এক হিরণ্ময় অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।
এই সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে দেশ গঠন, রাষ্ট্রসংস্কার, প্রকৃত স্বাধীন ও গর্বিত জাতি হিসেবে উত্থানের চ্যালেঞ্জ। আমাদের এতে বিজয়ী হতে হবে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক, বর্তমানে সরকারের আইন, বিচার, সংসদ ও প্রবাসী কল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা
আমাদের জন্য মুষড়েপড়া দিনের শুরু হয় ২৮ অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে। এদিন নয়াপল্টনে বিএনপির বিশাল সমাবেশ শত শত সাউন্ড গ্রেনেড আর গুলি মেরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফা আক্রমণ হিসেবে শুরু হয় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা আর ঢালাও গ্রেপ্তারের পালা। অল্পদিনের মধ্যে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আওয়ামী লীগ আবারও একটি প্রহসনের নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসছে।
২৮ অক্টোবরের আগে বিএনপির ধারাবাহিক জনসভা আর এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ অনেককে আশান্বিত করেছিল। একইসঙ্গে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ আমেরিকার নানামুখী চাপে মানুষের এই আশা আরও প্রসারিত হয়েছিল। মনে হতো এবার বুঝি সুদিন আসছে। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের অল্প কদিন আগে ভারতের চাপে আমেরিকা তার কঠোর ভূমিকা থেকে সরে আসে। তবু মানুষের মনে ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ এবার অন্তত বড় ধরনের নির্বাচনি জালিয়াতি করার সাহস করবে না। অবশ্য নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আওয়ামী লীগ তার পথেই এগোবে।
দেশকে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে আওয়ামী লীগ নতুন একধরনের জালিয়াতির নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী নিজেই ডামি প্রার্থী দাঁড় করানোর ঘোষণা দিয়ে ‘নির্বাচন’ নামের এক আজব তামাশা শুরু করেন। ওই নির্বাচন মানুষ আমি-ডামি নির্বাচন বলে অভিহিত করে। আর আমি বলতাম, এটি ছিল এক ভোটারের নির্বাচন। এটি আসলেই ছিল শুধু শেখ হাসিনা নামে এক ভোটারের নির্বাচন। ৩০০ আসনের প্রতিটিতে তার সিদ্ধান্তে প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার নাটক সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনকে তিনি ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ আখ্যায়িত করে গোটা জাতির সঙ্গে নতুন এক নিষ্ঠুর তামাশায় মেতে ওঠেন।
মানুষের ক্ষোভ ছিল, রাগ ছিল; কিন্তু সবই ছিল অবরুদ্ধ। মনে আছে, নির্বাচনের পর আলোচনা অনুষ্ঠান দূরের কথা, নির্বাচনকে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার মতো লোকও খুঁজে পেতাম না তখন দেশে। গভীর রাতে ঘুম না এলে একা একা জানালার পাশে বসে থাকতাম। মনে হতো এই অন্ধকার থেকে কোনোদিনই মুক্তি পাব না আমরা। এরপর জুলাই মাসে এক অচিন্ত্যনীয় ও অভূতপূর্ব গণআন্দোলনে খড়কুটোর মতো ভেসে যায় শেখ হাসিনাসহ তার পুরো দল। তবে এজন্য চরম মূল্য দিতে হয় বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আর তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো সমাজের নানা স্তরের মানুষকে। কমপক্ষে এক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় মাত্র দুই সপ্তাহে, অঙ্গহানি বা গুরুতরভাবে আহত হতে হয় প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে। পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে এত অল্প সময়ে এত মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা বিরল। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো শাসকের হাতেও এত বড় গণহত্যার নজির নেই।
তারপরও মানুষ আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। আমরা সেই বিখ্যাত ফুটেজে দেখেছি একজন পুলিশকে বলতে যে, ‘গুলি করলে একটাই মরে, বাকিরা সরে না; এটাই আতঙ্কের।’ আমার কাছে একজন আহত ছাত্র বর্ণনা করেছে কীভাবে তারা গাছ বা ভবনের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে পুলিশকে গুলি করতে প্রলুব্ধ করত, গুলিবর্ষণ শেষ হলে পুলিশকে পাল্টা ধাওয়া দিত। যাত্রাবাড়ীর একটা ফুটেজে দেখেছি গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে সঙ্গীরা। তাদের পাশ দিয়েই ছুটে চলেছে আন্দোলনের আগুনস্রোতে উন্মত্ত জনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি কীভাবে এক রাতে পিটিয়ে হলছাড়া করা হয়েছে নির্যাতক ও হত্যাকারী সংগঠন দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ছাত্রলীগকে।
এই গণঅভ্যুত্থান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, জীবনপণ ও ব্যাপকতম পরিসরের। স্কুলের ছেলে মাকে চিঠি লিখে শেষ বিদায় জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে, ক্যান্টনমেন্টের অভিভাবকরা রাস্তায় নেমেছেন গণহত্যার প্রতিবাদে, হাতকড়া পরা ছেলের পিঠ চাপড়ে সাহস জুগিয়েছেন মা, দুহাত প্রসারিত করে পুলিশের গুলি বুকে নিয়েছেন আবু সাঈদরা। মাদরাসা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী, প্রবাস থেকে দেশে ছুটিতে আসা তরুণ, প্রবাসী, শ্রমিক-কর্মচারী- সবাই নেমেছে রাস্তায়। মহাকাব্যোর মতো এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত গড়ে উঠেছে শেখ হাসিনার একযুগের নির্মম, নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে।
২.
শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার সূচনা ঘটে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের মদতে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারান অর্ধশতাধিক চৌকস সামরিক কর্মকর্তা। হত্যাকাণ্ডের দায় পুরোপুরি বিডিআর সদস্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের। অভিন্ন এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে একইসঙ্গে দুর্বল করা হয় বাংলাদেশ সেনাবহিনী ও বিডিআরকে। এরপর শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অতিবিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়, বিএনপি ও সমমনা দলের নৈতিক অবস্থান নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়, শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় দেশের আলেম-ওলামা আর মাদরাসাছাত্রদের। কিন্তু এসব ঘটনা ঘটানোর পরও সরকারের পক্ষে যে টিকে থাকা দুঃসাধ্য- তার রায় পাওয়া যেতে থাকে ২০১৩ সালের স্থানীয় নির্বাচনগুলোয়। এ সময়ে বিশেষ করে গাজীপুরে মেয়র নির্বাচনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও বিএনপি প্রার্থীর ভূমিধস বিজয়কে ঠেকাতে না পারার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কুৎসিত এক বন্দোবস্ত গড়ে তোলে। এই বন্দোবস্ত ছিল নির্বাচনি কারচুপি, দলীয়করণ, মিথ্যাচার, দমননীতি, আর ভারত তোষণমূলক।
১) কারচুপি : শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, সব পর্যায়ের নির্বাচনে কারচুপি আর জুলুমের মাধ্যমে দখল করতে থাকে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে ফুটবল ক্লাবসহ কোনোকিছু বাদ রাখেনি দলটি। এই কারচুপি করার জন্য তারা রাষ্ট্রীয় অর্থ, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, দলীয় গুণ্ডা- সবকিছুর ব্যবহার করতে থাকে বেপরোয়াভাবে। ফলে নির্বাচন হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার প্রতিনিধি নিয়োগের বাহন হিসেবে।
২) দলীয়করণ : দলীয়করণ চলে প্রশাসনের সব স্তরে। ঘোষণা দিয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগকর্মীদের প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়। এরপর পোস্ট, পদোন্নতি, বদলি পুরস্কার-খেতাব সব ক্ষেত্রে চলে অবাধ দলীয়করণ। এটি আরও সহজসাধ্য করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মতো আইডেন্টিটি ভুয়াভাবে ব্যবহারের নানা ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হয়। দলীয়করণ নিশ্চিত করার জন্য এমনকি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয় পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের নামে; গণহারে বৈষম্যের শিকার করা হয় দাড়ি-টুপির মানুষ ও মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের তরুণদের।
৩) মিথ্যাচার : এসবের পাশাপাশি চলে লাগাতার জঘন্য মিথ্যাচার। কুৎসা, চরিত্র হনন, অপবাদ আর অশ্লীল গালাগালিতে মেতে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিরাট একটি অংশ। এই নোংরামির প্রধান শিকার ছিল জিয়া পরিবার, ড. ইউনূস এবং দেশের তরুণ সমাজ। সারাদেশে শিবির ট্যাগ দিয়ে অসংখ্য তরুণকে আক্রমণ করা হয়; এরপর পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
৪) দমননীতি : মিটিং-মিছিলে হামলা আর গায়েবি মামলায় উল্টো বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাই শুধু নয়, ভিন্নমত দমনে আওয়ামী লীগ সরকার বেছে নেয় নির্যাতনের নিষ্ঠুরতম পদ্ধতিগুলো। অবাধ গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ করে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধ করা হয়, গণরুমকেন্দ্রিক বর্বর নির্যাতন চালিয়ে ছাত্রদের বশংবদ বানানোর চেষ্টা করা হয়।
৫) দুর্নীতি : দলের রাজনীতিবিদ, অনুগত ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জন্য বাংলাদেশকে লুটের রাজ্য বানিয়ে ফেলে আওয়ামী লীগ সরকার। এসবকে নিরাপদ রাখার জন্য দায়মুক্তি আইন ও দমনমূলক বিভিন্ন আইন জারি করা হয়। রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাটের পাশাপাশি ব্যাংক ও শেয়ার মার্কেট থেকে সাধারণ মানুষের অর্থ লুটপাটের মতো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে জড়িয়ে পড়ে তারা। আদানিসহ ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি করে ভারতের সব ধরনের ইচ্ছে পূরণ করা হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা করে এমন এক কায়েমি স্বার্থ গ্রুপ তৈরি করা হয়, যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই দুর্নীতির চূড়ামণি শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষার জন্য কমিটেড হয়ে ওঠে।
৬) ভারত তোষণনীতি : এসবের পাশাপাশি চলে নির্লজ্জ ও প্রকাশ্যে ভারত তোষণনীতি। ভারতের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত, বন্দর, রেল ও সড়কপথ খুলে দেওয়া হয়, প্রজেক্ট ওয়ার্কার পরিচয়ে ভারতীয়দের বিনা অনুমতিতে চাকরি করার সুযোগ দেওয়া হয়, রাষ্ট্রপরিচালনার প্রায় সর্বক্ষেত্রে ভারতের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো হয়, সীমান্ত হত্যার জন্য উল্টো নিজ দেশের মানুষকে দায়ী করা হয়। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ভারতকে এমন কিছু দিয়েছি যা কখনো তারা ভুলতে পারবে না। নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা এভাবে অন্য দেশের হাতে তুলে দেওয়ার এমন নজির অন্যান্য স্বৈরশাসকের মধ্যেও ছিল অতিবিরল এক ঘটনা।
ওপরে বর্ণিত প্রতিটি বিষয় মানুষকে ক্ষুব্ধ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক দলের আন্দোলনেও ব্যাপক জনসমাগম ছিল। কিন্তু নিষ্ঠুরভাবে দলীয় ক্যাডার ও পুলিশের সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এসব দমন করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে যায় যে, দেশের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে বিস্ফোরণোন্মুখ।
৩.
এই বিস্ফোরণোন্মুখ জনতা বাঁধভাঙা হয়ে ওঠে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। আরেকটি ভুয়া নির্বাচনে জিতে আসার পর কোটা ব্যবস্থার মতো একটি মীমাংসিত বিষয় আদালতে ঠেলে দিয়ে সরকারি চাকরির সুযোগ আবার সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করার দুঃসাহসে মেতে ওঠে আওয়ামী লীগ। এ সময়ে একের পর এক উসকানি ও ঔদ্ধত্যমূলক কর্মকাণ্ড করে আওয়ামী লীগ মানুষের ধৈর্যের শেষ বাঁধও ভেঙে ফেলে। কোটা আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রদের পাইকারিভাবে ‘রাজাকার’ সম্বোধন, আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে শক্তি প্রয়োগ, আবু সাঈদকে নির্মমভাবে হত্যা, আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার ও স্নাইপার ব্যবহার, বাড়ি বাড়ি রাতের বেলায় অভিযান- এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে সমাজের সব স্তরের মানুষ জীবনের মায়া উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা সুচিন্তিত, অভিনব ও সাহসী সিদ্ধান্ত দিয়ে এই আন্দোলনকে সংগঠিত ও চূড়ান্তভাবে সফল করে তোলে। কয়েকজন নেতার গ্রেপ্তারে যাতে আন্দোলন থেমে না যায়, এ জন্য তারা বহুসংখ্যক নেতা বা সমন্বয়ক ঠিক করে, আংশিক বিজয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে আরও সাহসী দাবি উত্থাপন করে, পুলিশি নির্যাতনের পরও আন্দোলনে অবিচল থাকে, গ্রাফিতি ও বাংলা ব্লকেডের মতো অভিনব কর্মসূচি প্রদান করে। সবশেষে গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আকস্মিকভাবে এক দিন এগিয়ে এনে অত্যাচারী সরকারকে দিশাহারা করে ফেলে। এই প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক, সময়ানুগ ও প্রাজ্ঞচিত্ত। জুলাই আন্দালনের নেতৃত্ব পর্যায়ের সিদ্ধান্তগুলো তাই সুচিন্তিত ছিল, ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো একেই ‘মেটিকুল্যাসলি ডিজাইনড’ বলেছেন। কিন্তু এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। কেউ এই আন্দোলনে নামার জন্য কাউকে বাধ্য করেনি, টাকা দিয়ে ভাড়াটে বাহিনী নামায়নি বা কোনো ষড়যন্ত্রও করেনি।
জুলাই আন্দোলনকালে আবু সাঈদের হত্যা দেখে আমাদের বাড়ির গৃহকর্মী ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। একজন বয়স্ক আত্মীয় বলেছেন, নাতির খোঁজে রাতে পুলিশ আসে বাসায়, নাতি মরলে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ; দলে দলে মানুষ রাস্তায় নেমেছে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে, মৃত্যুভয়কে জয় করে। মানুষের মনে এই বোধ জন্মেছিল যে, আবু সাঈদ-মুগ্ধ-ওয়াসীম মরতে পারলে, নাহিদ-আসিফরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকলে আমাদের মৃত্যুভয় বলে কিছু থাকতে পারে না। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে সরাতে স্বতঃস্ফূর্ত এই জীবনপণ সংগ্রাম বিশ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মতো এক হিরণ্ময় অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।
এই সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে দেশ গঠন, রাষ্ট্রসংস্কার, প্রকৃত স্বাধীন ও গর্বিত জাতি হিসেবে উত্থানের চ্যালেঞ্জ। আমাদের এতে বিজয়ী হতে হবে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক, বর্তমানে সরকারের আইন, বিচার, সংসদ ও প্রবাসী কল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতের জন্য যা করেছেন, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে ভারত শুধু আশ্রয় দিয়ে বসে থাকবে না, তাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা চেষ্টা করে যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের দাবি তোলে, তখন সাধারণ মানুষ
৬ ঘণ্টা আগেবিশ্বের নানা অঞ্চলে প্রভাবশালী ও তুলনামূলকভাবে বৃহৎ রাষ্ট্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপে জার্মানি ও ফ্রান্স এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলের উল্লেখ করা যেতে পারে।
৯ ঘণ্টা আগেপূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল। আমার দেশ-এর পুনঃপ্রকাশনা সেই রক্ত লালের সংগ্রামেরই একটা অংশ। আমাদের মতো লোকেরা আমার দেশ-এর মতো পত্রিকার প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই। আল্লাহপাক মজলুমের পক্ষে।
১ দিন আগেচেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) আজ আমাকে বলেছেন, কি খান সাহেব, হাসিনা আসছে বলে কি ভয় পাচ্ছেন? এটা শুনে আমরা কিছুটা অবাকই হলাম। মনে হলো তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ভয় পাচ্ছেন!
১ দিন আগে