ফরিদা আখতার
ক্যালেন্ডারে আগস্টের ৫ তারিখের পর বাংলাদেশকে আমরা নতুনভাবে দেখছি। জুলাই ও আগস্টের প্রথম পাঁচ দিনে যে উত্তাল আন্দোলন আমরা দেখেছি, তার ফল অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। তারপর বাংলাদেশ বদলে গেছে। এই বাংলাদেশকে আমরা নতুনভাবে জানার চেষ্টা করছি।
এই নতুন বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফল, অনেক রক্তপাতের অর্জন। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে কচি বয়সের ছেলেদের বুক, পেট, চোখ ও মাথা। কেউ তক্ষুনি মরে গেছে, কেউ হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে লাশ হয়েছে। অনেকেই এখনো আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। মেয়েরাও আহত হয়েছে, দু-একজন মারাও গেছে। তাদের আমরা এখন শহীদ বলে শ্রদ্ধা জানাই, আর আহতদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। এই শহীদ ও আহতদের ত্যাগের কথা আমরা ভুলতে পারি না। প্রতিটি ক্ষণে নতুন বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তাদের অবদানের কথা স্বীকার করে তাদের সম্মান জানাতে হবে।
নতুন বাংলাদেশে পুরোনো অনেক জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হচ্ছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, চুরি প্রভৃতি তো রয়েছেই, বৈষম্যের যে বীজ দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষ করে গত ১৫ বছরে বপন করা হয়েছে, তা থেকে বিশাল বিষবৃক্ষ গড়ে উঠেছে। এই বৃক্ষের শেকড় যেমন গভীরে নেমেছে, তেমনি ওপরের ডালপালাও ভালোই হাওয়া খাচ্ছে। দুর্নীতি কিছুটা কমেছে, কিন্তু নানারূপে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। বৈষম্যের একটি ধরন নারী-পুরুষের মাঝে বিভেদ বা নারীর মর্যাদার অভাব। এই বৈষম্যের সৃষ্টি আরও অনেক আগের, পুরুষতন্ত্রের ইতিহাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এটা বিশ্বব্যাপী, এর বিরুদ্ধে নারীবাদীরা দীর্ঘকাল সংগ্রামও করছেন।
বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি বৈষম্যের কথা এখন আলোচনায় আনছি না। আমি কিছু বিষয় তুলে আনতে চাই, যা বর্তমান বাংলাদেশের এই পরিবর্তিত সময়ের জন্য প্রযোজ্য। এখন কি আমরা কোনো বৈষম্য দেখছি?
বৈষম্য সব সময় দৃশ্যমান হয় না। বলে-কয়ে বা সচেতনভাবেও বৈষম্য করা হয়, এমন ভাবাও ঠিক নয়। কিন্তু তাও বৈষম্য হয়ে যায় এবং যাদের প্রতি বৈষম্য হয়, তারাই বুঝতে পারে। অন্যরা সেটা গ্রাহ্য নাও করতে পারে। আগস্টের ৫ তারিখের পর সব বৈষম্যের বিলোপ ঘটে গেছে, এ কথা কেউ বলবেন না, সম্ভবও নয়। তবে বৈষম্যের বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে, উপলব্ধি বেড়েছে। যার প্রতি বৈষম্য হয়েছে, সে এখন তার প্রতিকার চাচ্ছে। শুধু নারী-পুরুষ বৈষম্য নয়, পুরুষদের মধ্যেও সব ধরনের বৈষম্য নিয়ে কথা উঠছে। চাকরিক্ষেত্রে পদায়ন, বদলি, ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা না পাওয়াসহ নানা ধরনের বৈষম্যের কথা শোনা যায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সমাধানও করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে।
নারীর ক্ষেত্রে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে। এই জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের কথাই ধরা যাক। জুলাই মাসে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, তখন রাজপথে সোচ্চার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্রীরা। ছাত্রলীগের নারী সদস্যদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রীরা। তারাই হলগুলো ছাত্রলীগমুক্ত করতে পেরেছিলেন। তারপর তারা স্লোগান দিয়ে ও গান গেয়ে রাজপথ মাতিয়ে রেখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট-ওয়েস্টসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ যোগ দিয়েছে একে একে। জেলা শহরগুলোয়ও মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। তখন মেয়েরা কিন্তু আলাদাভাবে আন্দোলন করেননি। তারা ছাত্রদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছেন, যদিও এর নাম হয়েছে ‘ছাত্র সমন্বয়ক’। ছাত্র বা ছাত্রী—এই বিভাজন তখন করা হয়নি এবং এটাই ছিল সঠিক ও আন্দোলনের শক্তি। সবাই মিলে এক হয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী—সবাই মিলে একাকার হয়ে একটি শব্দ তৈরি হয়েছিল ‘ছাত্র’। তেমনি জনতার মধ্যে ছিল দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, পোশাকশ্রমিকসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও ছোট ব্যবসায়ীরা, তারা হয়েছেন ‘জনতা’। তারা তাদের জীবিকার কাজ না করে ‘ছাত্র’দের আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। এখানেও নারী-পুরুষ ভেদ ছিল না। তারাও আহত হয়েছেন অনেকে, হাত-পা হারিয়েছেন, কেউ শহীদ হয়েছেন। তা ছাড়া ছিলেন অভিভাবক হিসেবে মা-বাবারা। ছেলে বা মেয়ে মিছিলে গেছে বলে তারা ঘরে বসে থাকেননি। অনেক মা নিজেই ছুটে গেছেন আর কোনো কোনো মা নিজে না যেতে পারলেও উৎসাহ দিয়েছেন সন্তানকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। একটি ছেলে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের ওড়নাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তার লাশে সেই ওড়না পাওয়া গেছে। এসব কথা নানাভাবে আমরা জানতে পারছি। অনেকে নিজের সন্তানের লাশ হাসপাতাল থেকে কষ্ট করে ঝুঁকি নিয়ে এসে কবর দিয়েছেন। এগুলো শুনলে গা শিউরে ওঠে। আন্দোলনকারী অনেকেই বিবাহিত ছিলেন। তাদের তরুণ বয়সের স্ত্রীরাও বসে থাকেননি। তারাও শরিক হয়েছিলেন। এই বাবা-মা ও স্ত্রীরাও যে আন্দোলনের যোদ্ধা, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু সেটা কি হচ্ছে? উত্তর সোজা, হচ্ছে না। তারা শহীদ পরিবার বা আহতদের পরিবার। তাদের নিজের অবদানের কথা হারিয়ে যাচ্ছে।
আমি বিশেষভাবে বলব, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ও নেতৃত্বদানকারী ছাত্রীদের কথা, কারণ তাদের আর সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে না। ৫ আগস্টের পর বন্যার ত্রাণ বিতরণের কাজে এবং পুলিশের অনুপস্থিতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজেও তাদের দেখা গেছে। তারা নানাভাবে কাজের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান ছিলেন। কিন্তু এখন যখন ছাত্র-প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন আসে, তখন তাদের দেখা মেলে না, এটা বেশ চোখে পড়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে ও জেলাপর্যায়ে ছাত্রনেতৃত্বে তাদের স্থান নেই। একেবারে নেই বলা ঠিক হবে না, দু-একজন অবশ্যই আছেন। কিন্তু সেটা আনুপাতিক হারে একেবারেই গণ্য করার মতো নয়।
কোটাবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে নারী কোটাও বাদ গেছে। ছাত্রীরা বলেছেন, ‘নারী কোটা হাস্যকর, আমরা যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছি।’ নারীরা টোকেন হতে চাননি। তারা মেধার ভিত্তিতে সমান প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ নিতে চেয়েছেন। কোটার মধ্যে যে নারীদের প্রতি বিশেষ সুবিধা বা Affirmative Action, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন মেয়েরা। এটা আমরাও সমর্থন করেছি। কিন্তু সমান প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি মনে হচ্ছে এখনো তৈরি হয়নি। তাই এখন নারীকে এগিয়ে নেওয়ার বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার মধ্যে নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এখনো বিদ্যমান। নারীরা ‘এটা পারবে না, ওটা পারবে না’ প্রভৃতি চিন্তা তাদের মাথায় ভর করে থাকে। আরও ভয়াবহ হচ্ছে, নারীরা কী অবদান রেখেছেন তা নজরে আসে না, আন্দাজ হয় না। এটা ঐতিহাসিকভাবেই ঘটে চলেছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন—সবকিছুতেই নারী ছিলেন। কিন্তু পরে ইতিহাসে তাদের ঠাঁই সহজে হয়নি, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। দেখিয়ে দিতে হয়েছে প্রমাণসহ—নারীরা কী করেছেন।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী থাকলে ভিন্ন পরিস্থিতি হতো। না, এটা হয়নি, আমরা দেখেছি। রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী যখন স্বৈরশাসক হন, তখন সেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। নারীরা সেখানে আরও বেশি মর্যাদাহীন হয়ে পড়েন। নারী নেতৃত্বে থাকা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি বিগত ১৫ বছরে। কাজেই এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই যে সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান নারী হলেই নারীর প্রতি বৈষম্য থাকবে না। এটা একটা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোগত সমস্যা, যা দূর করতে হলে নারী-পুরুষ একত্র হয়েই কাজ করতে হবে।
এখন যে প্রশ্নটা সবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা হচ্ছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নারীদের কেন সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে না? কেন তারা অন্যসব আন্দোলনের মতো পেছনে পড়ে গেলেন? কেন তাদের অবদানকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে না? এসব প্রশ্ন জনমনে এখন ক্রমেই সামনে আসতে শুরু করেছে, কারণ এরই মধ্যে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা রাষ্ট্রের অনেক কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। কিন্তু সে হিসেবে ছাত্রীরা রাষ্ট্রের কাছে নেই। তাহলে কি নারী হওয়ার কারণে তারা কোনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর গঠিত রাষ্ট্রে এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই—এমন বিশ্বাস করতে চাই।
এ অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই হবে, কারণ নতুন বাংলাদেশে বৈষম্যের কোনো ঠাঁই নেই।
লেখক : গবেষক, লেখক ও উপদেষ্টা
ক্যালেন্ডারে আগস্টের ৫ তারিখের পর বাংলাদেশকে আমরা নতুনভাবে দেখছি। জুলাই ও আগস্টের প্রথম পাঁচ দিনে যে উত্তাল আন্দোলন আমরা দেখেছি, তার ফল অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। তারপর বাংলাদেশ বদলে গেছে। এই বাংলাদেশকে আমরা নতুনভাবে জানার চেষ্টা করছি।
এই নতুন বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফল, অনেক রক্তপাতের অর্জন। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে কচি বয়সের ছেলেদের বুক, পেট, চোখ ও মাথা। কেউ তক্ষুনি মরে গেছে, কেউ হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে লাশ হয়েছে। অনেকেই এখনো আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। মেয়েরাও আহত হয়েছে, দু-একজন মারাও গেছে। তাদের আমরা এখন শহীদ বলে শ্রদ্ধা জানাই, আর আহতদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। এই শহীদ ও আহতদের ত্যাগের কথা আমরা ভুলতে পারি না। প্রতিটি ক্ষণে নতুন বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তাদের অবদানের কথা স্বীকার করে তাদের সম্মান জানাতে হবে।
নতুন বাংলাদেশে পুরোনো অনেক জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হচ্ছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, চুরি প্রভৃতি তো রয়েছেই, বৈষম্যের যে বীজ দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষ করে গত ১৫ বছরে বপন করা হয়েছে, তা থেকে বিশাল বিষবৃক্ষ গড়ে উঠেছে। এই বৃক্ষের শেকড় যেমন গভীরে নেমেছে, তেমনি ওপরের ডালপালাও ভালোই হাওয়া খাচ্ছে। দুর্নীতি কিছুটা কমেছে, কিন্তু নানারূপে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। বৈষম্যের একটি ধরন নারী-পুরুষের মাঝে বিভেদ বা নারীর মর্যাদার অভাব। এই বৈষম্যের সৃষ্টি আরও অনেক আগের, পুরুষতন্ত্রের ইতিহাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এটা বিশ্বব্যাপী, এর বিরুদ্ধে নারীবাদীরা দীর্ঘকাল সংগ্রামও করছেন।
বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি বৈষম্যের কথা এখন আলোচনায় আনছি না। আমি কিছু বিষয় তুলে আনতে চাই, যা বর্তমান বাংলাদেশের এই পরিবর্তিত সময়ের জন্য প্রযোজ্য। এখন কি আমরা কোনো বৈষম্য দেখছি?
বৈষম্য সব সময় দৃশ্যমান হয় না। বলে-কয়ে বা সচেতনভাবেও বৈষম্য করা হয়, এমন ভাবাও ঠিক নয়। কিন্তু তাও বৈষম্য হয়ে যায় এবং যাদের প্রতি বৈষম্য হয়, তারাই বুঝতে পারে। অন্যরা সেটা গ্রাহ্য নাও করতে পারে। আগস্টের ৫ তারিখের পর সব বৈষম্যের বিলোপ ঘটে গেছে, এ কথা কেউ বলবেন না, সম্ভবও নয়। তবে বৈষম্যের বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে, উপলব্ধি বেড়েছে। যার প্রতি বৈষম্য হয়েছে, সে এখন তার প্রতিকার চাচ্ছে। শুধু নারী-পুরুষ বৈষম্য নয়, পুরুষদের মধ্যেও সব ধরনের বৈষম্য নিয়ে কথা উঠছে। চাকরিক্ষেত্রে পদায়ন, বদলি, ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা না পাওয়াসহ নানা ধরনের বৈষম্যের কথা শোনা যায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সমাধানও করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে।
নারীর ক্ষেত্রে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে। এই জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের কথাই ধরা যাক। জুলাই মাসে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, তখন রাজপথে সোচ্চার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্রীরা। ছাত্রলীগের নারী সদস্যদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রীরা। তারাই হলগুলো ছাত্রলীগমুক্ত করতে পেরেছিলেন। তারপর তারা স্লোগান দিয়ে ও গান গেয়ে রাজপথ মাতিয়ে রেখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট-ওয়েস্টসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ যোগ দিয়েছে একে একে। জেলা শহরগুলোয়ও মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। তখন মেয়েরা কিন্তু আলাদাভাবে আন্দোলন করেননি। তারা ছাত্রদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছেন, যদিও এর নাম হয়েছে ‘ছাত্র সমন্বয়ক’। ছাত্র বা ছাত্রী—এই বিভাজন তখন করা হয়নি এবং এটাই ছিল সঠিক ও আন্দোলনের শক্তি। সবাই মিলে এক হয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী—সবাই মিলে একাকার হয়ে একটি শব্দ তৈরি হয়েছিল ‘ছাত্র’। তেমনি জনতার মধ্যে ছিল দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, পোশাকশ্রমিকসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও ছোট ব্যবসায়ীরা, তারা হয়েছেন ‘জনতা’। তারা তাদের জীবিকার কাজ না করে ‘ছাত্র’দের আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। এখানেও নারী-পুরুষ ভেদ ছিল না। তারাও আহত হয়েছেন অনেকে, হাত-পা হারিয়েছেন, কেউ শহীদ হয়েছেন। তা ছাড়া ছিলেন অভিভাবক হিসেবে মা-বাবারা। ছেলে বা মেয়ে মিছিলে গেছে বলে তারা ঘরে বসে থাকেননি। অনেক মা নিজেই ছুটে গেছেন আর কোনো কোনো মা নিজে না যেতে পারলেও উৎসাহ দিয়েছেন সন্তানকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। একটি ছেলে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের ওড়নাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তার লাশে সেই ওড়না পাওয়া গেছে। এসব কথা নানাভাবে আমরা জানতে পারছি। অনেকে নিজের সন্তানের লাশ হাসপাতাল থেকে কষ্ট করে ঝুঁকি নিয়ে এসে কবর দিয়েছেন। এগুলো শুনলে গা শিউরে ওঠে। আন্দোলনকারী অনেকেই বিবাহিত ছিলেন। তাদের তরুণ বয়সের স্ত্রীরাও বসে থাকেননি। তারাও শরিক হয়েছিলেন। এই বাবা-মা ও স্ত্রীরাও যে আন্দোলনের যোদ্ধা, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু সেটা কি হচ্ছে? উত্তর সোজা, হচ্ছে না। তারা শহীদ পরিবার বা আহতদের পরিবার। তাদের নিজের অবদানের কথা হারিয়ে যাচ্ছে।
আমি বিশেষভাবে বলব, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ও নেতৃত্বদানকারী ছাত্রীদের কথা, কারণ তাদের আর সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে না। ৫ আগস্টের পর বন্যার ত্রাণ বিতরণের কাজে এবং পুলিশের অনুপস্থিতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজেও তাদের দেখা গেছে। তারা নানাভাবে কাজের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান ছিলেন। কিন্তু এখন যখন ছাত্র-প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন আসে, তখন তাদের দেখা মেলে না, এটা বেশ চোখে পড়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে ও জেলাপর্যায়ে ছাত্রনেতৃত্বে তাদের স্থান নেই। একেবারে নেই বলা ঠিক হবে না, দু-একজন অবশ্যই আছেন। কিন্তু সেটা আনুপাতিক হারে একেবারেই গণ্য করার মতো নয়।
কোটাবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে নারী কোটাও বাদ গেছে। ছাত্রীরা বলেছেন, ‘নারী কোটা হাস্যকর, আমরা যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছি।’ নারীরা টোকেন হতে চাননি। তারা মেধার ভিত্তিতে সমান প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ নিতে চেয়েছেন। কোটার মধ্যে যে নারীদের প্রতি বিশেষ সুবিধা বা Affirmative Action, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন মেয়েরা। এটা আমরাও সমর্থন করেছি। কিন্তু সমান প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি মনে হচ্ছে এখনো তৈরি হয়নি। তাই এখন নারীকে এগিয়ে নেওয়ার বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার মধ্যে নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এখনো বিদ্যমান। নারীরা ‘এটা পারবে না, ওটা পারবে না’ প্রভৃতি চিন্তা তাদের মাথায় ভর করে থাকে। আরও ভয়াবহ হচ্ছে, নারীরা কী অবদান রেখেছেন তা নজরে আসে না, আন্দাজ হয় না। এটা ঐতিহাসিকভাবেই ঘটে চলেছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন—সবকিছুতেই নারী ছিলেন। কিন্তু পরে ইতিহাসে তাদের ঠাঁই সহজে হয়নি, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। দেখিয়ে দিতে হয়েছে প্রমাণসহ—নারীরা কী করেছেন।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী থাকলে ভিন্ন পরিস্থিতি হতো। না, এটা হয়নি, আমরা দেখেছি। রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী যখন স্বৈরশাসক হন, তখন সেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। নারীরা সেখানে আরও বেশি মর্যাদাহীন হয়ে পড়েন। নারী নেতৃত্বে থাকা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি বিগত ১৫ বছরে। কাজেই এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই যে সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান নারী হলেই নারীর প্রতি বৈষম্য থাকবে না। এটা একটা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোগত সমস্যা, যা দূর করতে হলে নারী-পুরুষ একত্র হয়েই কাজ করতে হবে।
এখন যে প্রশ্নটা সবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা হচ্ছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নারীদের কেন সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে না? কেন তারা অন্যসব আন্দোলনের মতো পেছনে পড়ে গেলেন? কেন তাদের অবদানকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে না? এসব প্রশ্ন জনমনে এখন ক্রমেই সামনে আসতে শুরু করেছে, কারণ এরই মধ্যে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা রাষ্ট্রের অনেক কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। কিন্তু সে হিসেবে ছাত্রীরা রাষ্ট্রের কাছে নেই। তাহলে কি নারী হওয়ার কারণে তারা কোনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর গঠিত রাষ্ট্রে এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই—এমন বিশ্বাস করতে চাই।
এ অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই হবে, কারণ নতুন বাংলাদেশে বৈষম্যের কোনো ঠাঁই নেই।
লেখক : গবেষক, লেখক ও উপদেষ্টা
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতের জন্য যা করেছেন, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদকে ভারত শুধু আশ্রয় দিয়ে বসে থাকবে না, তাকে সামনে রেখে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নানা চেষ্টা করে যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের দাবি তোলে, তখন সাধারণ মানুষ
৫ ঘণ্টা আগেবিশ্বের নানা অঞ্চলে প্রভাবশালী ও তুলনামূলকভাবে বৃহৎ রাষ্ট্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপে জার্মানি ও ফ্রান্স এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলের উল্লেখ করা যেতে পারে।
৮ ঘণ্টা আগেপূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল। আমার দেশ-এর পুনঃপ্রকাশনা সেই রক্ত লালের সংগ্রামেরই একটা অংশ। আমাদের মতো লোকেরা আমার দেশ-এর মতো পত্রিকার প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই। আল্লাহপাক মজলুমের পক্ষে।
১ দিন আগেচেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাদের বললেন, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) আজ আমাকে বলেছেন, কি খান সাহেব, হাসিনা আসছে বলে কি ভয় পাচ্ছেন? এটা শুনে আমরা কিছুটা অবাকই হলাম। মনে হলো তাহলে কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ভয় পাচ্ছেন!
১ দিন আগে