Ad

ভারতের হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদ

আবুল আসাদ
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪: ১৫

ভারতের বিজেপি গঠিত হয়েছে আরএসএসের চরম হিন্দুত্ববাদী উদ্দেশ্য সাধনের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। হিন্দুত্ববাদী উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে তাদের নাম্বার ওয়ান মাধ্যম হচ্ছে শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার। তাদের মতে, হিন্দুত্ব ছাড়া কোনো ধর্ম নেই, আর্য ছাড়া কোনো জাতি নেই। অন্যসব ধর্ম ও জাতিই নির্মূলযোগ্য। এটা ভারতের হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদ। এর রূপ বহু। একটা রূপকে আমরা দেখেছি ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ ভারতে বন্দে মাতরম স্লোগান তুলে ওরা মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য মুসলিম হত্যায় মেতে উঠেছিল। বিশেষ করে লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট ও বেঙ্গল প্যাক্টের পর ভারতে হিন্দু-মুসলিম দুই জাতি যখন শান্তি ও সহযোগিতার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন আরএসএস ও তাদের সহযোগীরা মুসলমানদের জোর করে হিন্দু বানানো এবং মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় যেভাবে তৎপর হয়ে উঠেছিল, তা ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়। বর্তমানকে বোঝার জন্য সেই অতীতের দিকে একবার তাকানো দরকার।

লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে (১৯১৬) হিন্দু কংগ্রেস মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন ও পৃথক প্রতিনিধিত্বের অধিকার অবস্থার চাপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। উল্লেখ্য, এ অধিকার মুসলমানরা মর্লি-মিন্টো সংস্কারের (১৯০৯) মাধ্যমে আগেই পেয়েছিল। ১৯১৬ পর্যন্ত কংগ্রেসও অন্যান্য হিন্দু ব্রিটিশ প্রবর্তিত এ অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি দেয়নি। লক্ষ্ণৌ চুক্তিতেও তারা এটা মেনে নিতে চায়নি। কিন্তু তারা বুঝতে পারছিল, মুসলমানরা পৃথক জাতিসত্তা নিয়ে তাদের হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই লক্ষ্ণৌ চুক্তি তারা করল এবং চুক্তির পরপরই তারা কিছু বলল না। কারণ কংগ্রেসের স্বরাজ ও স্বদেশি আন্দোলনে মুসলমানদের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল।

পরে হিন্দুদের স্বরাজ ও স্বদেশি আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে পড়ল, তখনই হিন্দুরা রুখে দাঁড়াল মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন ও পৃথক প্রতিনিধিত্বের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস নেতা মদন মোহন মালব্য আরও হিন্দু নেতাদের নিয়ে পুনর্গঠন করলেন হিন্দু মহাসভা। গড়ে উঠল তার মতো আরও জঙ্গি সংগঠন। ১৯২৫ সালে গঠিত হলো আরএসএস এবং স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতীর নিষ্ক্রিয় ‘আর্য সমাজ’কে সক্রিয় করে তোলা হলো। লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে ‘সংগঠন’ এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দের নেতৃত্বে ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ ঝড়ের বেগে কাজ শুরু করেছিল। মুসলিমবিরোধী তাদের সংঘবদ্ধ উত্থানের একটা বড় কারণ ছিল সমসাময়িক খেলাফত আন্দোলনে মুসলমানদের প্রশংসনীয় ভূমিকা। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে মুসলমানরা বহু ক্ষেত্রেই হিন্দুদের কৃতিত্ব ম্লান করে দিয়েছিল এবং একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে তাদের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছিল। হিন্দুরা এটা মোটেই পছন্দ করেনি। তাছাড়া ১৯১৯ সালের মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কারের কয়েকটা দিকও হিন্দুদের উদ্বেগের কারণ ঘটিয়েছিল। এই আইন এককেন্দ্রিক সরকার ভেঙে দেওয়ার পথে একটা পদক্ষেপ বলে হিন্দুদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল ব্রিটিশদের এই আইনের ফলে প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোয় মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। এর ফলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠরা গোটা ভারতের ওপর একতরফা আধিপত্য করার অধিকার হারাচ্ছে। এ কারণেই গান্ধী অবশেষে এই আইন প্রত্যাখ্যান করেন এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো মুসলমানদের ওপর মারমুখো হয়ে ওঠে। জোর করে তারা মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করাও শুরু করে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত রাজমুকুট-এর ভাষায় সে সময়ের অবস্থা ছিল এ রকম:

“…হাজার হাজার গরিব মুসলমানকে প্রলোভন দ্বারা হিন্দু করা হইতেছে। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটিমাত্র উল্লেখ করিব। বাঙ্গালা ১৩০০ (১৮২৩) সালের ২রা আষাঢ় তারিখের আনন্দবাজার বলে যে, ‘আর্য সমাজীদের চেষ্টায় আগরার শিকরারা গ্রামের ৬০০ মুসলমানকে শুদ্ধ করিয়া লওয়া হইয়াছে। অন্যান্য গ্রামেও ২০০ জন শুদ্ধি কার্যে যোগ দিয়াছে।’… মসজিদ লইয়া হিন্দু-মুসলমানে নানা স্থানে বিবাদ হইয়াছে। তন্মধ্যে আমি একটামাত্র ঘটনার উল্লেখ করিব। তাজমহলের ন্যায় মধ্যস্থলে একটি গম্বুজ এবং চারিকোণে মিনার আছে। পূর্বদিকে দরজা আছে (মন্দিরের চূড়া ছিল না ও দক্ষিণ কিংবা পশ্চিম দিকেও দরজা ছিল না, ছিল কেবল হিন্দুবাড়ির নিকট)।

–এরূপ একটি জুমা মসজিদকে হিন্দুগণ মন্দির বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং পুলিশ ও ডি. ম্যা.-এর সাহায্যে মুসলমানদের নামাজ পড়া বন্ধ করিলেন এবং হিন্দু সংবাদপত্রে তারবার্তা দিলেন যে, ঝালকাঠির দুর্বৃত্ত মুসলমানেরা জোরপূর্বক হিন্দু মন্দির অপবিত্র করিয়াছে। (আনন্দবাজার, ডিসেম্বর, ১৯২৩)। এই বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় কলিকাতা হইতে সরকারি এমারত পরীক্ষক তথায় উপস্থিত হইয়া (পরীক্ষার পর) মাসজেদ বলিয়া প্রকাশ করেন।” (‘রাজমুকুট’ সাঈদ উদ্দীন আহমেদ, পৃ. ২১৯, ২২০ (ফুটনোটসহ)।

হিন্দু সংগঠনগুলোর উসকানিমূলক এ ধরনের আচরণের ফলেই দেশব্যাপী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এক হিসাবে ১৯২০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ১২৭টি দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গার একটা পরিসংখ্যান দিয়েছেন শুভাষ বসু। তিনি লিখেছেন, “১৯২২ সালে মহরম উপলক্ষে দাঙ্গা শুরু ‍হয়, ১৯২৩ সালে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং ৩০০ জন প্রাণ হারায়। ১৯২৪ সালে ছোট-ব্ড় ১৮টি দাঙ্গা হয়। ১৯২৫ সালে এখানে-সেখানে গোলমাল দেখা দেয়। কিন্তু ১৯২৬ সালের দাঙ্গা আগের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। এ বছর ৩৬টি দাঙ্গা সংঘটিত হয়। নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার জন। ১৯২৭ সালে ৩১টি দাঙ্গায় এক হাজার ৬০০ মানুষ মারা যায়। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মে মাসের দাঙ্গায় বম্বেতে ২০০ জন নিহত হয়। ১৯৩১ সালে কানপুর দাঙ্গা সমগ্র ভারতকে কাঁপিয়ে তোলে। এতে মৃতের সংখ্যা হয় ৪০০ থেকে ৫০০ জন। বহুসংখ্যক মসজিদ-মন্দির ধ্বংস করা হয়ে। (The Indian Struggle by Subhas Bose)।

এই দাঙ্গা সম্পর্কে গান্ধী বলেন, হিন্দু-মুসলিম সমস্যা মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।” (উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, ইয়াসিন আহমদ, পৃ. ২০৫) বাইরে যাওয়ার কথাই। গান্ধী মনে মনে এটাই চেয়েছিলেন। বলা যায়, তিনি এ সময় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে হরিজন সেবায় মন দিয়ে দাঙ্গার জন্য মাঠ ফাঁকা করেই দিয়েছিলেন। গান্ধীর কংগ্রেস তো দাঙ্গাকে সহায়তাই করেছে। কংগ্রেস তখন দাঙ্গাবাজদেরই দখলে। ১৯২১ সালেও অর্থাৎ গান্ধী যুগেও একটা সুসংগঠিত মুসলমানবিরোধী কর্মিদল কংগ্রেসের সদস্যসংখ্যার অর্ধেক জায়গা দখল করে বসে এবং কংগ্রেসে তাদের গুরুত্ব হয়ে উঠল সংখ্যানুপাতে ঢের বেশি। (‘ভারত কি করে ভাগ হলো’–বিমলানন্দ শাসমল, পৃ. ৩৩)।

হিন্দু পত্রপত্রিকা ও হিন্দু রাজনীতিকদের কোনো পার্থক্য ছিল না। হিন্দু রাজনীতিকরা সবাই কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ও শুদ্ধি আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। কেউবা মৌন থেকে তাদের সহযোগিতা করছিলেন। আর ভীষণ ব্যস্ত দেখা যায় গান্ধীকে হরিজন সেবা ও পবন-সত্যাগ্রহ নিয়ে। মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ও শুদ্ধি আন্দোলনের প্রধান নায়ক স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে নিরস্ত্র করার কোনোই চেষ্টা গান্ধী করেননি। কখনো সমালোচনা করেছেন– এরও কোনো প্রমাণ নেই। বরং গান্ধী সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলন বিষয়ে হান্টার কমিটির কাছে সাক্ষ্যদানকালে লর্ড হান্টারের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে ‘আমার শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী’ বলে অভিহিত করেন এবং আন্দোলন বিষয়ে তার সঙ্গে পত্রালাপের কথা স্বীকার করেন। ‘সত্যাগ্রহ’ মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী; অনুবাদ : শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সময় সাহিত্য প্রকাশন, কলিকাতা, পৃ. ১৪)।

বিশ শতকে বিশের দশকের ওপর আলোচনা কিঞ্চিৎ বড় করে ফেললেও আমি মনে করি এর প্রয়োজন ছিল। সাতচল্লিশে মুসলিম লীগ অর্থাৎ মুসলমানরা ভারত বিভাগে যে বাধ্য হয়েছিল, সেটা হিন্দুত্ববাদীদের সীমাহীন হিংসা, বিদ্বেষ, সংঘর্ষ, সন্ত্রাস ও দাঙ্গার কারণেই। আর বিশ শতকের বিশের দশক ছিল মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার সবচেয়ে দুর্যোগকাল। এই দশকের ১৯২৮ সালের ২২ ডিসেম্বর কলকাতা মুসলিম লীগ কংগ্রেস ও সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই কার্যত একসঙ্গে চলার ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে স্থায়ী বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়ে যায়। ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান ও স্বাধীনতা প্রশ্নে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নেহরু একটি রিপোর্ট পেশ করেন (যা ‘নেহরু রিপোর্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করে)। জিন্নাহ সম্মেলনে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে রিপোর্টের কতকগুলো সংশোধনী পেশ করেন (যা মুসলমানদের অস্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার রক্ষার জন্য অপরিহার্য ছিল)। সর্বদলীয় সে সম্মেলনে চার দিন ধরে আলোচনা চলল। জিন্নার পেশকৃত সংশোধনী হিন্দু নেতাদের কাছে কোনো পাত্তাই পেল না। জিন্নাহ তার সমাপনী বক্তব্যে উপসংহারে বলেন, ‘ভারতকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত এবং এমন একটি আবহাওয়া সৃষ্টি করতে হবে যেন দেশের সব সম্প্রদায় সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। (History of Freedom Movement in India, Tarachand, Vol. 1, page 39) হিন্দু-মুসলমান দুই জাতিকে একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার জিন্নাহর এই একান্ত আবেদন, হিন্দুত্ববাদী নেতাদের শুধু সমালোচনা নয়, তাদের হাসি-ঠাট্টাও বিদ্রুপের শিকার হলো। মানসিকভাবে চরম আহত জিন্নাহ অত্যন্ত ধীর ও শান্তকণ্ঠে বললেন, আজ আমরা এই কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমরা চাই হিন্দু-মুসলমান স্বাধীনতার পথে একসঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাক।… আমি আপনাদের কাছে একজন মুসলিম নাগরিক হিসেবে নয়, একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বলছি, আপনারা কি চান না যে, মুসলিম ভারত আপনাদের এগিয়ে যাক? সংখ্যালঘুদের কি সংখ্যাগুরুদের দেবার কিছুই নেই? আমরা সবাই এই দেশের সন্তান, অতএব আমাদের একসঙ্গে বসবাস করতে হবে। আমাদের মধ্যে যতই বিভেদ থাক না কেন, ঝগড়া-বিবাদ বাড়িয়ে কোনো ফল হবে না। আমরা যদি এই বিষয়ে একমত হতে না পারি, বন্ধু হিসেবে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই।…)’ (‘মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’, এমএইচ সৈয়দ, পৃ. ৪৩২-৪৩৫; ‘উদ্ধৃত স্বাধীনতার অজানা কথা’, কলকাতা, পৃ. ১০৩)

নেহরুর জীবনীকার মাইকেল এডওয়ার্ডস বলেছেন, জিন্নার এই বক্তৃতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল, ‘আমরা বন্ধু হিসেবে একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই।’ এই কথাটি বলার সময় তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। (‘নেহরু’, মাইকেল এডওয়ার্ডস, পৃ. ৪৩; ‘উদ্ধৃত স্বাধীনতার অজানা কথা’, বিক্রমাদিত্য, ফেজ পাবলিশিং হাউজ, কলকাতা, পৃ. ১০৪)।

জিন্নাহর চোখ থেকে ঝরে পড়া মুসলমানদের এই অশ্রুরই আরেক নাম ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগ। ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতাদের চরম মুসলিমবিদ্বেষ এবং মুসলমানদের অস্তিত্ববিনাশী তাদের কাজ ও মানসিকতাই ভারত বিভাগের কারণ। ভারত-উমহাদেশ ভাগ হলেও ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানরা হিন্দুত্ববাদী নেতাদের হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়েই চলেছে। কলকাতা ‘দেশ’ পত্রিকা কয়েক বছর আগে প্রভাবশালী বিজেপি নেতা গোবিন্দাচার্যকে উদ্ধৃত করে লেখে, বাজপেয়ী হচ্ছে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস পরিচালিত সংঘ সমাজের মুখোশমাত্র। তার অন্তরালে যে মুখটি বর্তমান, তা কোনোদিনই ইসলামকে বরদাশত করেনি এবং করবেও না।

আজকের বিজেপি নেতা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে ভদ্রলোক রাজনীতিক বাজপেয়ীর মতো মুখোশ নেই। গুজরাট দাঙ্গার মাধ্যমে তিনি আজ স্বরূপেই অবতীর্ণ। রাষ্ট্র কীভাবে তার সংখ্যালঘুদের ওপর দাঙ্গা চালায়, গুজরাটের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা দেখিয়ে দিয়েছেন। মনে করা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদ তারই পুরস্কার। ২০১৪ থেকে আজ ২০২৪, ভারতের বিজেপির রাজত্ব চলছে। এই রাজত্ব ভারতে চলমান মুসলিমবিদ্বেষ ও মুসলিমবিরোধী দাঙ্গাকে রাষ্ট্রীয় রূপ দান করেছে। ভারতে আগেও দাঙ্গা হয়েছে। এক হিসাব অনুসারে, শুধু ১৯৫৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি দাঙ্গা হয়েছে ভারতে। লোক মারা গেছে ১০ হাজার। কিন্তু সেসব দাঙ্গার রাষ্ট্রীয় রূপ ছিল না। কংগ্রেস দাঙ্গার বিরোধিতা করেই দাঙ্গা হতে দিয়েছে। কিন্তু ভারতের বিজেপি সরকার এখন খোদ দাঙ্গার পরিচালক। শুধু ভারতে নয়, তারা দাঙ্গা এখন বাংলাদেশেও পাচার করতে সচেষ্ট।

বাংলাদেশে বিজেপির অলিখিত প্রতিনিধি শেখ হাসিনার শাসন বাংলাদেশ থেকে ছাত্র-জনতা কর্তৃক উৎখাত হওয়ার পর ভারত বাংলাদেশে দাঙ্গা ও অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে একটা অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে, যাতে সিকিমের মতো অবস্থা তৈরি করে সিকিমের মতোই বাংলাদেশকে গ্রাস করার সুযোগ হয়। বিশ শতকের বিশের দশক এবং তার পরেও আরএসএস ও তার সহযোগীরা ভারতে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার সয়লাব বইয়ে দিয়েছিল মুসলিম স্বতন্ত্র সত্তাকে ধ্বংস করার জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশ ও তার মুসলিম জাতিসত্তাকে বিনাশ করার জন্য ভারত তার সেই পুরোনো চেষ্টাই আবার নতুন করে চালাতে চাচ্ছে। সেদিনের সঙ্গে তাদের এদিনের পার্থক্য শুধু স্লোগানে। সেদিন ছিল শুদ্ধি অভিযান, আর আজকে সেটা ঘর আপস। ‘বন্দে মাতরম’-এর পরিবর্তে তাদের আজকের রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’। স্লোগান পাল্টিয়েছে, কিন্তু নতুন স্লোগানের আড়ালে ‍পুরোনো খুনি স্বভাব একই রয়ে গেছে। নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, মানুষকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করার মন্ত্রে পরিণত হয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’। ষড়যন্ত্রের তাদের শেষ নেই। বাংলাদেশকে মুসলমানমুক্ত করার জন্য অর্ধ ডজনের মতো গ্রুপকে ভারত ৪০-৫০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিপালন করে আসছে। এদেরই একটি হলো ‘বঙ্গভূমি আন্দোলন’। এ আন্দোলনে দাবি করা হয়, একটা সেনাবাহিনী আছে ‘বঙ্গসেনা’ নামে, যার সেনাপতি ডা. কালিদাস বৈদ্য (কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসা ‘র’-এর একজন এজেন্ট কালিদাস বৈদ্য। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি ডাক্তারি পাস করে ভাষা আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন)। ৩৪ বছর আগে কলকাতার একটা দৈনিকে তার একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে এমন কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়, যাকে উদ্বেগজনক মনে করা যায় এ কারণে যে, বর্তমান বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও ভারতের চলমান মানসিকতার সঙ্গে তার মিল আছে। কলকাতার ‘দৈনিক আজকাল’ পত্রিকায় ১৯৮৯ সালের ২২, ২৩ ও ২৪ এপ্রিল তিন কিস্তিতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ‘দাঙ্গা ও সংঘাত-সংঘর্ষের সুযোগ, ভারতীয় বাহিনী কীভাবে বাংলাদেশে ঢুকবে’ এ প্রসঙ্গে ডা. কালিদাস বৈদ্য বলেন, আমার একটা সরকার আছে, সেনাবাহিনী আছে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ‘বঙ্গসেনা’ নামেই ঢুকবে বাংলাদেশে। ডা. কালিদাস বৈদ্যের এই বক্তব্যের ব্যাপারে ‘দৈনিক আজকাল’-এর সাংবাদিক রঞ্জিত শূর তার অনুসন্ধান থেকে তার রিপোর্টে লেখেন, বঙ্গসেনা বিএলও (Bangladesh Liberation Organization), বিএলটি (Bangladesh Liberation Tiger) সবার সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি সেটা এই রকম: বঙ্গভূমিপন্থিরা চান বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক অত্যাচার চালাক, যাতে তারা দলে দলে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে শুরু করে। শরণার্থীদের বোঝা বইতে হবে ভারত সরকারকে। ফলে বাধ্য হয়েই তাদের হস্তক্ষেপ করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে কিছু অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। তাদের আরও একটা ইচ্ছা, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগুক, ব্যাপক হিন্দু নিধন হোক, যাতে এ দেশের (ভারতের) সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সেন্টিমেন্টকে খুশি করার জন্য ভারত সরকার হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। বঙ্গভূমির ফেরিওয়ালাদের স্পষ্ট বক্তব্য – “ভারত সরকারকে বেছে নিতে হবে দুটোর একটি। তারা দেড় কোটি শরণার্থীর দায়িত্ব নেবে, নাকি ‘স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্র’ ব্ঙ্গভূমি তৈরি করে দেবে, যে বঙ্গভূমি একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সিকিমের মতো ভারতের বঙ্গরাজ্যে রূপান্তরিত হবে।” (দৈনিক আজকাল, কলকাতা, ঐ)

কলকাতার ‘দৈনিক আজকাল’-এর সাংবাদিক রঞ্জিত শূর বাংলাদেশে ভারতীয় সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের যে তথ্য তুলে ধরেছেন, তার সঙ্গে দিল্লির মানসিকতার মিল আছে। ইসকনের একজন নেতা সুস্পষ্ট অভিযোগে মাত্রই গ্রেফতার হয়েছেন। তাতেই দিল্লি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এতেই বোঝা যায়, তাদের পরিকল্পিত দাঙ্গা তারা বাংলাদেশে বাধাতে পারলে তারা কী করতে পারে, কতদূর যেতে পারে। মনে হচ্ছে, একটা বড় ট্রায়াল তাদের হয়ে গেল।

ইসকনের দেশব্যাপী ছড়ানো বিরাট জনশক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা তারা করেছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে কারণ শুধু বাংলাদেশের মুসলমানই নয়, গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের জীবনে নেই সংখ্যালঘু বা অন্য কারও সঙ্গে দাঙ্গা লাগানোর ইতিহাস এবং অন্যায়, অত্যাচারী ও স্বার্থবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করে থাকার দৃষ্টান্ত। এই চরিত্র মুসলমানদের ঈমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দিল্লির মতো সবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেও এই ঈমানই আমাদের নিরাপত্তার বর্ম। এই ঈমানই আমাদের ব্রিটিশ ভারতে অসম এক লড়াইয়ে জিতিয়েছে, ’৪৭-এ আমাদের বিজয়ী করেছে এবং বিজয় এনে দিয়েছে ’৭১ ও ’২৪-এর জুলাই বিপ্লবেও। আল্লাহ আমাদের এ বিজয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত রাখুন।

ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত