Ad

বঙ্গবন্ধু চেয়ারের নামে মুনতাসীর মামুনের পকেটে অর্ধ কোটি টাকা

আতিকুর রহমান, চবি
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮: ০৭
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০: ৩৮

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ নামে কোনো পদ ও বাজেটের অনুমোদন নেই। তবে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন চট্টগ্রামের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ পদে দায়িত্ব পালন না করেই নিজের পকেটে নিয়েছেন ৪৯ লাখ টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কীর্তি এবং বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যয়ের ওপর গবেষণার উদ্দেশ্য ২০১৯ সালের ৭ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার (গবেষণা কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই দিনে দায়িত্বভাতা ও অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা গ্রহণ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এরপর প্রথম গ্রেডের অধ্যাপক পদমর্যাদায় ২ বছরের জন্য ২০২১ সালের ১৫ মার্চ নিয়োগপ্রাপ্ত হন অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। পরবর্তীতে উক্ত নিয়োগের মেয়াদ ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ হতে ২ বছর বৃদ্ধি করা হয়। তার বর্ধিত নিয়োগের মেয়াদ আগামী ২০২৫ সালের ১৪ মার্চ শেষ হবে। প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকা বেতন উত্তোলন করলেও গত দেড় বছরে একবারের জন্য তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন নি।

নিয়োগে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি:

বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের নীতিমালায় নিয়োগ লাভের যোগ্যতায় ‘২’ এর ‘ঘ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কীর্তি, রাজনীতি, আদর্শ ও কর্ম এবং ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিষয়ে একাধারে ২০ বছর গবেষণা অথবা লেখালেখি হিসেবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রকাশনা হিসেবে অন্তত ১০টি নিবন্ধ, প্রবন্ধ অথবা বুক চ্যাপ্টার থাকতে হবে৷ বঙ্গবন্ধু চেয়ারে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের নিয়োগ লাভের সময় এ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. হাছান মিয়া আমার দেশকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ারে’র নির্বাহী কমিটির সুপারিশে ও সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে তাকে (ড. মুনতাসীর মামুন) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু চেয়ারে নিয়োগের নীতিমালায় উল্লেখিত বঙ্গবন্ধু জীবন ও কীর্তি নিয়ে একাধারে ২০ বছর গবেষণা ও ১০টি প্রবন্ধ থাকতে হবে, সেগুলো তিনি আমাদেরকে দেখাননি।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের নীতিমালায় নিয়োগের পদ্ধতি ও কার্যকালে ‘৪’ এর ‘গ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতি বছর শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ মেডিকেল অফিসারের সনদপত্র প্রদান সাপেক্ষে একজনকে দফায় দফায় বা এক দফায় সর্বোচ্চ চার বছরের জন্য বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদে নিয়োগ লাভ করা যাবে। এক্ষেত্রেও অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের নিয়োগে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। গত ৪ বছরে একবারেও জন্য হলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ মেডিকেল অফিসারের নিকট থেকে শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে সনদপত্র গ্রহণ করেননি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব আমার দেশকে বলেন, আমার কাছ থেকে তিনি কখনো শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে সনদ নেননি।

দায়িত্ব পালনে অবহেলা:

বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের নীতিমালায় দায়িত্বে ‘৩’ এর ‘গ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি ১ মাসের মধ্যে তার গবেষণা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু চেয়ার নির্বাহী কমিটির নিকট পেশ করবেন। ৬ মাস পর পর তিনি তার কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট এবং নির্ধারিত মেয়াদ অন্তে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করবেন। বঙ্গবন্ধু চেয়ার নির্বাহী কমিটির পূর্বানুমোদন নিয়ে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কীর্তি, রাজনীতি, আদর্শ ও কর্ম এবং ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে বছরে অন্তত ২টি প্রবন্ধ রচনা করবেন এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ৪টি বক্তৃতা উপস্থাপন করবেন।

নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর ড. মুনতাসীর মামুন তার মৌলিক কাজগুলো যথাযথভাবে পালন করেননি বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নীতিমালার বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি ‘৫’ এর ‘গ’ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ১ বছরে সর্বোচ্চ ১০ দিন পূর্ণগড় বেতনে ছুটি এবং সর্বোচ্চ ২০ দিন চিকিৎসা ছুটি ভোগ করতে পারবেন। এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে ড. মুনতাসীর মামুনের সর্বোচ্চ দেড় বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিত না থাকারও খবর পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, এটি অনেক পুরোনো ইস্যু। সবাই জানে, নিয়োগ হওয়ার পর তিনি দায়িত্ব পালন করেননি। এমনকি, ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে একবারও জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি। চূড়ান্ত কথা হলো, ওনার কোন সন্ধান নাই। অথচ মাসে মাসে ওনার একাউন্টে বেতন জমা হচ্ছে।

নীতিমালা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের জন্য কোন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা অথবা সচিব নিয়োগ করার বিধান নেই। তবে ড. মুনতাসীর মামুনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে মৌখিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ড. মুনতাসীর মামুনের কার্যক্রম সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে আমার দেশের নিকট তিনি নিজের দায়িত্বকে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি কখনো ওখানে দায়িত্বে ছিলাম না। আপনার কাছে কী কোন ডকুমেন্ট আছে?। তবে মোহাম্মদ হোসেনের বঙ্গবন্ধু চেয়ারে মৌখিকভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গচ্চা অর্ধ কোটি টাকা:

বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের নীতিমালায় পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, এ পদটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে কোন প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা ট্রাস্ট হতে প্রাপ্ত অনুদান বঙ্গবন্ধু চেয়ার তহবিলে অন্তর্ভুক্ত করে এটার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। কিন্তু এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন তহবিল গঠন করেননি। তবে এ পদের অনুমোদন ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ২০২৩ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নিকট আবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন অনুমোদন বা জবাব পাওয়া যায়নি।

সেই হিসেবে ড. মুনতাসীর মামুন নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর তার বেতনের টাকা বহন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তিনি গত ২০২১ সালের ১৫ মার্চ থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে গ্রস বেতন ১ লক্ষ ৯ হাজার ২০০ টাকা করে গত ৪৪ মাসে ৪৮ লক্ষ ৪ হাজার ৮০০ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া কয়েকবার আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া ও থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রায় অর্ধ কোটি টাকা গচ্ছা গেছে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ দেড় বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের না আসার কারণ দেখিয়ে ড. মুনতাসীর মামুনের বেতন পাঠানো বন্ধ রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাব নিয়ামক মো. আমিরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নভেম্বর থেকে ওনার ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে। অক্টোবর মাস পর্যন্ত তিনি বেতন নিয়েছেন।

জবাব চায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ:

বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন কেন তার মৌলিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি জানতে চেয়ে তাকে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে তিনি এখনো পর্যন্ত চিঠির জবাব দেননি বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপচার্য একাডেমিক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, মুনতাসীর মামুনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তিনি এখনো এর জবাব দেননি।

বেতনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ৪৮ লাখ টাকা শুধু বেতন হিসেবে নিয়েছেন। এ ছাড়া আনুষাঙ্গিক খরচ, আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া, থাকা-খাওয়া বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। এই টাকাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বহন করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) কিংবা সরকারি কোন ফান্ড এই টাকাগুলো দেয়নি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া জানতে চেয়ে তাঁকে ইমেইল করলেও তিনি উত্তর দেননি।

ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত