Ad

হাসপাতালে অভিনব দুর্নীতি

ভালো যন্ত্র নষ্ট বলে নতুন করে চলে ক্রয়-বাণিজ্য

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫: ৩৭
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯: ৫৫

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১৬ সালে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় সেন্ট্রাল ভেকিউয়াম সাকশন মেশিন কেনা হয়। ২০২০ সালের দিকে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলে মেরামত না করেই ফেলে রাখা হয় তিন বছর। সেই যন্ত্রকে নষ্ট ঘোষণা করে আবারও দুই কোটি টাকায় কেনা হয় নতুন যন্ত্র।

আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) থাকা লাইফ সাপোর্টের রোগীদের সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয় এই সেন্ট্রাল ভেকিউয়াম সাকশন মেশিন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন বছর পড়ে থাকা সেন্ট্রাল ভেকিউয়াম সাকশন মেশিন সেই যন্ত্র সচল করেছেন চার টেকনিশিয়ান। যা আট মাস ধরে সেবা দিচ্ছে।

একইভাবে তিন কোটি টাকা মূল্যের ছয়টি অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড ভেন্টিলেটর মেশিন, দুই কোটি টাকা মূল্যের চারটি কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র (লাইফ সাপোর্ট ভেন্টিলেটর), চার কোটি টাকার মূল্যের ছয়টি পোর্টেবল এক্স-রে, দুটি ডায়ালাইসিস যন্ত্র, ২০টি পেশেন্ট মনিটর, ছয়টি ওটি লাইট, ছয়টি অপারেটিং টেবিল, দুটি ল্যাপারেস্কপি মেশিন ও ছয়টি ইসিজি যন্ত্র মেরামত করেছেন টেকনিশিয়ানরা। প্রতিটি যন্ত্রপাতি মেরামতের সার্ভিস রিপোর্ট প্রমাণসহ সংরক্ষিত রয়েছে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে শুধু এই যন্ত্র নয় জীবন রক্ষাকারী এমন বহু চিকিৎসা যন্ত্র কারণ ছাড়া ফেলে রেখে নতুন করে কেনা হয়েছে। যার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা। যার নেপথ্যে ছিলেন হাসপাতালটির উপ-সহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুদ জামান। তার এই অনিয়মের সঙ্গে ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) একটি সিন্ডিকেট জড়িত বলেও জানা গেছে।

হাসপাতালের শীর্ষ কর্তারা বিষয়টি ধরতে পেরে এই প্রকৌশলীকে ছাড়াই যন্ত্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় যন্ত্র কেনাকাটার ইভ্যালুয়েশন করছেন। ঘটনা জানাজানি হলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে সভাপতি করা হয়েছে হাসপাতালটির অ্যানেসথেসিয়া আইসিইউ বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেহান উদ্দিন খানকে। অন্য সদস্য সচিব করা হয়েছে আবাসিক সার্জন (সার্জারি) ডা. মো. মাহবুবুর রহমানকে। নিমিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজারকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তদন্ত কমিটি থেকে সভাপতি সরে গেছেন। নতুন করে পাঁচজনকে এই কমিটিতে রাখা হয়েছে।

এদিকে হাসপাতালটির বায়োমেডিক্যাল টেকনিশিয়ানরা জানান, এভাবে নষ্ট দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা দিয়ে নতুন যন্ত্র কেনা হয়েছে। শুধু এই যন্ত্র নয় নষ্ট বলে ফেলে রাখা অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড ভেন্টিলেটর মেশিন ও পোর্টেবল এক্স-রেসহ ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার যন্ত্র সচল করেছেন তারা। এখন নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তারা। যন্ত্রপাতি সচল করায় হাসপাতাল পরিচালক সরাসরি তাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। ফলে অনেক ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতিও সচল করা সম্ভব হচ্ছে। যা পছন্দ হচ্ছেনা উপ-সহকারী প্রকৌশলীর। ফলে তার রোষানলে পড়েছেন। অনিয়ম করতে না পারায় এসব নানাভাবে হয়রানি, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী।

মেডিক্যাল টেকনিশয়ান (বায়োমেডিক্যাল) সাজেদুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, ‘হাসপাতালে অনেক যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট বলে ফেলে রাখা হয়েছে। আসলে সেগুলো নষ্ট ছিল না। সঠিকভাবে মেরামত করা গেলে সচল করা সম্ভব। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। দুর্নীতি বন্ধ হওয়ায় এখান থেকে আমাদের তাড়ানোর চেষ্টা করছে একটি মহল।’

একই অভিযোগ করেছেন আরও তিন টেকনিশিয়ান। বিষয়টি নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর হাসপাতাল পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন চার টেকনিশিয়ান। সাজেদুল ইসলাম ছাড়াও বাকি তিন টেকনিশিয়ান হলেন- হৃদয় চন্দ্র মল্লিক, এখলাস উদ্দিন ও মো. খলিলুর রহমান।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে আমরা সততার সঙ্গে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের অতি মূল্যবান বায়োমেডিক্যাল যন্ত্রপাতিসমূহ মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, মেশিন অপারেশন প্রশিক্ষণ, ডকুমেন্টস সংরক্ষণ, ইনস্টলেশন এবং কমিশনসহ বায়োমেডিক্যাল বিভাগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে আসছি। এতে করে অত্র হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্নভাবে বায়োমেডিক্যাল যন্ত্রপাতিসমূহের মাধ্যমে রোগীদের সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়, জরুরি অপারেশন সেবা, আইসিইউসহ সব সেবায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমাদের কাজ সম্পর্কে বিভিন্ন বিভাগ এবং হাসপাতাল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে অবগত রয়েছে।

এমতাবস্থায় হাসপাতালে কর্মরত উপ-সহকারী প্রকৌশলীর (মোহাম্মদ তৌহিদুদ জামান) মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি, হুমকির স্বীকার হয়ে আসছি। ফলে কাজে মনোনিবেশ করতে পারছি না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি এবং বদলি আতঙ্কে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার) তৌহিদুদ জামান।

তিনি বলেন, ‘দায়িত্বে আমি থাকলেও ওই যন্ত্র কেনাকাটায় আমার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিমিউয়ের মাধ্যমে কিনেছে। আর এসব যন্ত্র আমরা ঠিক করতে পারি না, নিমিউতে চিঠি দিতে হয়, সেখান থেকে কেনা হয়।’

তৌহিদুদ জামান আরও বলেন, ‘কোন যন্ত্র মেরামত করতে হবে সেটি আমার মাধ্যমে হওয়ার কথা। টেকনিশিয়ানরাও আমার অধীনে থাকবে। কিন্তু হাসপাতাল পরিচালক আমাকে উপেক্ষা করেই সরাসরি তাদের নিয়ে কাজ করছে। তাহলে আমি এখানে কেন? আমাকে কাজে লাগাতে মন চাইলে লাগাবে, না করলে নেই। আমার অন্য কোনো কাজ নেই।’

টেকনিশিয়ানদের হয়রানির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করে থাকলে কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে যে ব্যবস্থা নেবে আমি মেনে নেব। তবে এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো হয়নি। তারা চাইলে সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারবে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো আমার দেশকে বলেন, ‘এ ঘটনাটি জানার পর আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সত্যিই যদি এমন হয়ে থাকে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি।’

বিষয়:

আমার দেশ
ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত