Ad

খুলনার শেখবাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ

ফ্যাসিবাদের দোসরদের ভয়ংকর রূপে ফেরার হুমকি

এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮: ০৪
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯: ৫৪

খুলনায় শেখ হাসিনার চাচার ‘শেখবাড়ি’র নতুন পরিচয় ‘পোড়াবাড়ি’। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ চাচাতো ভাই খুলনায় এলে বসবাস করত এখানে। পদ্মার এপারে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ায় অনেকেই একে দ্বিতীয় গণভবন বলত। আগস্ট বিপ্লবের চূড়ান্তলগ্নে ছাত্র-জনতার রুদ্র রোষের শিকার হয়ে ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

শেখবাড়িকে ঘিরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক বলয়ের সব সদস্যই লাপাত্তা। তবে এদের কেউ কেউ ফিরে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক গ্রুপ খুলে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে তারা। ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল নিয়ে নিজেদের মধ্যে চলছে শলাপরামর্শ। ১৬ ডিসেম্বর পোড়াবাড়ির টিনের গেটসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে কালো কালির স্প্রে দিয়ে ‘জয় বাংলা’ লিখে নিজেদের জানান দেয় তারা।

ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষগুলোর সমন্বয়হীনতা আর প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পালিয়ে যাওয়া খুনিচক্র আবারও পুনর্বাসনের সুযোগ পাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই।

শেখবাড়ি থেকে পোড়াবাড়ি : মহানগরীর শেরেবাংলা রোডে শেখ আবু নাসেরের বাড়ি এটি। শেখ মুজিবের ভাই, শেখ হাসিনার চাচা নাসেরের পরিবার দীর্ঘদিন খুলনার এ বাড়িতে বসবাস করে। ৭৫’র রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এর চাকচিক্য হারিয়ে যায়। ১৯৯৬ সাল থেকে আবার সরগরম হতে থাকে এটি। তবে এই বাড়ির পাঁচ ছেলে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া করত।

মূলত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে শক্তির কেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে বাড়িটি। চাকরি-বাকরি, নিয়োগ-বদলি পদোন্নতি, তদবির, টেন্ডার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, হাট-ঘাট-মাঠ, জলমহাল, বালুমহাল, মাছের ঘের, ব্রিজ-ঘাটের টোল আদায় থেকে নির্বাচনে চেয়ারম্যান-মেম্বার পদে কে জিতবেন কে হারবেন সবকিছু নির্ধারণ হতো এখান থেকে।

আর এর সবকিছুই হতো মোটা অংকের নজরানা বা কমিশনের বিনিময়ে। প্রশাসনের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন পদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন একটু সাক্ষাৎ ও সালাম পৌঁছানোর আশায়।

এ বাড়ির সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন। বাগেরহাটের একটি আসন থেকে নির্বাচন করতেন তিনি। দ্বিতীয় ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল ছিলেন খুলনা সদর আসনের এমপি।

স্থানীয় পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ছিলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেল। অপর দুই ভাই শেখ রুবেল ও শেখ বাবু কখনো ঢাকায়, কখনো খুলনায় থাকতেন।

জনশ্রুতি আছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে খুলনা উত্তাল হয়ে উঠলে ২ অথবা ৩ আগস্ট চার ভাই এই বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। সেখান থেকে তারা ভারত অথবা থাইল্যান্ড চলে গেছেন। শেখ হেলালও আগেই দেশ ত্যাগ করেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

৪ ও ৫ আগস্ট শত শত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা দফায় দফায় এই বাড়িতে হামলা চালায়। গোটা বাড়ি ভেঙে তছনছ করে দেয়। এসি, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ, আসবাবপত্র, লাইট, বাড়ির দরজা, জানালা, গ্রিল এমনকি মেইন গেটও খুলে নিয়ে যায়। এরপর ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়।

প্রথম দফা হামলার পর কিছু পুলিশ সদস্য এবং স্থানীয় যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী ওই বাড়িতে গিয়েছিল। পরে ওইদিন এবং পরের দিন আবারও হামলা হলে আর কেউ এগিয়ে যায়নি। পরিত্যক্ত এই বাড়ির মেইন গেট ও পাশের গলিতে পকেট গেট টিন ও বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। জনৈক নাজমুল হক মুকুলের তত্ত্বাবধানে কাজটি হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

ভয়ংকর রূপে ফেরার হুমকি : ১৪ ডিসেম্বর রাতে খুলনা রেলস্টেশনের ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে হঠাৎ ভেসে ওঠে- ‘ছাত্রলীগ আবার ভয়ংকর রূপে ফিরে আসবে; জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু; শেখ হাসিনা আবার আসবে।’

বিষয়টি নজরে আসামাত্র তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা স্টেশন মাস্টারের অফিস ঘেরাও করে মিছিল স্লোগান দেয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে একজনকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছে।

এরপর ১৬ ডিসেম্বর শেখবাড়ির টিনের গেটসহ নগরীর বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে কালো কালির স্প্রে দিয়ে জয়বাংলা লেখা হয়। তিনদিন পর ১৯ ডিসেম্বর কালো কালি লেপে লেখা বিনষ্ট করা হলেও ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, পালিয়ে যাওয়া গণহত্যার দোসররা আবারও ফিরে আসার পরিকল্পনা করছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য তারা হোয়াটাসঅ্যাপে দুটি আইডি খুলেছে। সেখানে বিজয় দিবসের দুপুরে গল্লামারি স্মৃতিসৌধে ছাত্রলীগের দুই কর্মীর পুষ্পমাল্য অর্পণের ছবি, বিভিন্ন দেয়ালে জয়বাংলা স্লোগান লেখার ছবি শেয়ার করা হয়। সেই সঙ্গে বাজারদর, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার বিষয়গুলো তুলে ধরে সবাইকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব ব্যাপক আকারে প্রচারের আহ্বান জানানো হচ্ছে। সেখানে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ রয়েছে তুঙ্গে। শেখবাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ দলের অনেক নেতা জাতীয় ও স্থানীয় নানা ইস্যুতে তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নানা বিতর্কিত পোস্ট দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেখবাড়িসংলগ্ন ফারাজিপাড়া লেনের বাসিন্দা শেখ শাহজাহান কবির মিঠু বলেন, ২০ নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম বলে আমার বিরুদ্ধে একে একে ১৩টি মামলা দেওয়া হয়েছিল। জেল থেকে জেলে কেটেছে জীবনের ১৬টি বছর। হত্যা, অস্ত্র, মাদক, বেতার কেন্দ্রে হামলা-মামলার আসামি ছিলাম। যাদের ইন্ধনে মামলা হতো তাদের কেউ কেউ আবারও এলাকায় ফিরছে। জাতীয়তাবাদী ঘরানার দুজন নেতা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ তার।

৫ আগস্ট থেকে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সবাই পলাতক। তাদের মোবাইল নম্বরও বন্ধ। তবে নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন মহানগর কমিটির শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক শেখ মো. জাহাঙ্গীর আলম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই। ১৫ বছরে দলে সুবিধাভোগী দালাল ছাড়া অন্য কিছু তৈরি হয়নি। ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা কোণঠাঁসা হয়েছিল লুটেরা চক্রের কাছে। যারা এখন ঝুঁকি নিয়ে দেয়ালে স্লোগান লিখছেন তারা দলপাগল মানুষ।

ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষগুলোর সমন্বয়হীনতা, অর্থের বিনিময়ে দোসরদের ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটি খুলনার প্রতিনিধি আহম্মদ হামীম রাহাত। তিনি বলেন, ওদের হাতে লুটপাটের অঢেল অর্থ রয়েছে, যা দিয়ে কেনাবেচার কাজ চলছে। পেছনে ইন্ধন না থাকলে পালিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তরা এত দ্রুত ফিরে আসার দুঃসাহস দেখাতে পারত না।

প্রশাসন যে দায়িত্ব পালন করছে না তা আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা খুলনায় এলে জানিয়েছিলাম। তিনি ৭ দিন সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। তবে যে কোনো অপতৎপরতা রুখে দেওয়ার জন্য খুলনার ছাত্র-জনতা প্রস্তুত আছে বলে জানান তিনি।

বিষয়:

খুলনা
ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত