Ad

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: ইতিহাসে তোমরা অমলিন

আলফাজ আনাম
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ৩৭

‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ দুহাত প্রসারিত করে অলঙ্ঘনীয় এক পাহাড়ের মতো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বুক পেতে রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন আবু সাঈদ। তার হাজারো সাথির স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছিল রাজপথ। গুলির সামনে দাঁড়িয়ে এভাবেই মানুষের মুক্তি আনার সংগ্রামে প্রাণ দিলেন আবু সাঈদ।

‘পানি লাগবে কারো, পানি পানি?’ উত্তরার আজমপুর এলাকায় মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ যখন পানির কেস হাতে নিয়ে ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন, তখন ঠিকমতো তাকাতেও পারছিলেন না। এমন সময় পুলিশের গুলি এসে লাগে মুগ্ধের কপালে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান মুগ্ধ।

স্কুলের কিশোর ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস চিঠি লিখল মায়ের কাছে- ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না।’ তারপর সেই বালক গেল মিছিলে, গুলিতে প্রাণ দিল বীরের মতো।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ৩৬ দিনের অভাবনীয় আন্দোলনে এমন অসংখ্য শিশু, কিশোর ও তরুণ প্রাণ দিল, কত শত নারী আত্মদান করলেন, কত মানুষ শহীদ হলেন- সে কথা ইতিহাস হয়ে লেখা থাকবে পাতায় পাতায়।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সেদিন ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ-সংগ্রাম এতটাই দৃঢ় ছিল, হাজার হাজার রাউন্ড গুলি করেও রাজপথ থেকে তাদের পিছু হটানো যায়নি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ভিডিও দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করলে মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’

হাসিনার দোসরদের এই দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছিল শত শত লাশের বিনিময়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের যে স্রোত তৈরি হয়, তাতে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় সোয়া যুগেরও বেশি সময়ের ফ্যাসিবাদী শাসন। গণহত্যার দায় মাথায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।

সেই আন্দোলনে শত শত শহীদের আত্মত্যাগ আমরা ভুলিনি, ভুলব না, ভুলতে পারি না। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে মুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছে এ দেশের মানুষ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের সঠিক তালিকা আজও করা সম্ভব হয়নি। শহীদ ও আহতদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায় থেকে নিদারুণ অবহেলার অভিযোগ আছে। শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দলগুলো সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে বলেছেন, দেড় হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৯ হাজারের বেশি। ছাত্র সমন্বয়করা বলেছেন, শহীদের সংখ্যা দুই হাজার। অন্যদিকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুযায়ী, শহীদ হয়েছেন ৮৬৫ জন। আহত হয়েছেন ১১ হাজার ২ জন। এর মধ্যে মৃত্যু অবস্থায় ৬৮২ জনকে হাসপাতালে আনা হয়। ১৮৩ জন মারা গেছেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম নভেম্বরে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৬০০ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২৪ হাজার। প্রধান উপদেষ্টা নভেম্বর মাসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ৯৩১ জন।

অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির তথ্য অনুযায়ী, অঙ্গহানির যে কোনো একজন এক চোখ হারিয়েছেন ৫০০ জন। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শুধু চোখে গুলি লেগে আংশিক বা পরিপূর্ণ দৃষ্টি হারিয়েছেন ৬৮৫ জন। এর মধ্যে ৯২ জনের দুই চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। যারা চিরদিনের মতো অন্ধ হয়ে গেছেন। হাত অথবা পা হারিয়েছেন ২১ জন। এর মধ্যে কৃত্রিম হাত ও পা লাগানো হয়েছে ১৫ জনের। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়া হয়েছে আটজনকে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির সমন্বয়ক তারেকুল ইসলাম আমার দেশকে জানিয়েছেন, তারা যে তথ্য পেয়েছেন, সেগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মারা গেছেন। এমনকি রক্ষা পায়নি শিশুরাও। আন্দোলনে শিশুরা পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।

ইউনিসেফ ১৭ আগস্ট জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ৬৫ জন শিশু মারা গেছে। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ১২১ জন শিশু, ১১ জন নারী মারা গেছে। এর মধ্যে রিয়া গোপ ও নাঈমা নামের দুটি শিশু বাসার ছাদে খেলার সময় পুলিশের গুলিতে মারা যায়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বহু আলেম ও মাদ্রাসাছাত্র নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শত শত মাদ্রাসার ছাত্র। এমনকি মাদ্রাসাছাত্রদের টার্গেট করে গুলির ঘটনা ঘটেছে। তরুণ আলেম প্রজন্ম নামে একটি সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭৭ জন আলেম মারা গেছেন। সংগঠনটির একজন কর্মকর্তা বিলাল আহমেদ চৌধুরী জানান, তারা আরও কিছু আলেমের নিহত হওয়ার কথা জানতে পেরেছেন। তাদের নাম এখনো সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান আছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বহু লাশ গুমের অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে আশুলিয়ায় একটি ভিডিও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। গুলিবিদ্ধ মরদেহ গুনে গুনে প্যাডেল ভ্যানে তুলছে পুলিশ। ভ্যানে তুলেই একটি পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে লাশগুলো ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। গুলিবিদ্ধ একজন তখনো জীবিত ছিলেন। নিথর দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে; নড়াচড়া করছে। এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ৩০ আগস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। আশুলিয়ায় ৪৬ জনের লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে মামলায় কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে কতগুলো বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আজও পাওয়া যায়নি।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য নুর খান লিটন আমার দেশকে বলেন, ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা প্রণয়ন যত দেরি হবে, পরিষ্কার চিত্র পাওয়া কঠিন হবে। তিনি জানান, জুলাই-আগস্টে রামপুরা, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা এলাকায় গিয়ে তিনি নিজে বহু লোকের মৃত্যুর কথা জেনেছেন। অনেকে হাসপাতালে আনার পথে মারা গেছেন। আবার পুলিশি হয়রানির ভয়ে গ্রামে বা দূরের কোনো কবরস্থানে গিয়ে দাফন করা হয়েছে। নাম জানা অনেককে একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়েছে। এই শহীদদের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যত সহজ ছিল, এখন পাওয়া অনেক কঠিন। তিনি মনে করেন, সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের শহীদ ও আহতদের তালিকা তৈরি করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল। তবে সবাই আশা করছেন, সঠিকভাবে শহীদ ও আহতদের একটি তালিকা তৈরি হবে। শহীদ পরিবারকে মূল্যায়ন করা হবে। আহতরা সঠিক চিকিৎসা পেয়ে আবার স্বাভাবিক জীবন লাভ করবেন।

ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত