Ad

মাথায় শতাধিক গুলি, তবুও ভাবনায় দেশ

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩: ২৮
মাথায় শতাধিক গুলি নিয়ে ধুঁকছেন ওমর ফারুক, হারিয়েছেন দুই চোখের আলো। ছবি: সংগৃহীত

মাথা কখনো নিচু করছেন, খানিক পর ওপরে তুলছেন। নিভে গেছে ডান চোখের আলো। বাঁ চোখেরও যাচ্ছেতাই অবস্থা। মাথায় শতাধিক গুলি। হাসপাতালে শয্যায় আড়াই মাস ধরে কাতরাচ্ছেন। কিন্তু নেই কোনো আক্ষেপ, মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে—‘তবুও ভালো থাকুক বাংলাদেশ।’

বলছিলেন বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক। ২১ বছরের এই টগবগে যুবক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে ঘোষিত এক দফার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ৪ আগস্ট গাজীপুরে পুলিশের গুলিতে আহত হন। ফারুকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গুলি নেই। বিশেষ করে গুলিতে দুই চোখের আলো হারিয়েছেন এই শিক্ষার্থী। মাথায় এখনো শতাধিক গুলি বহন করছেন।

গত ১৯ ডিসেম্বর ওমর ফারুকের সঙ্গে কথা হয় আমার দেশ-এর। ফারুক জানান, ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় এক দফার কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেই কর্মসূচিতে অংশ নিতে ঢাকায় রওনা দিলে গাজীপুরের আনসার একাডেমির সামনে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হলে একাডেমি পার হয়ে যাচ্ছিল শিক্ষার্থীরা। রাস্তা থেকে আনসার একাডেমির মূল ফটক কিছুটা দূরে। কয়েকজন শিক্ষার্থী ঢিল মারলেও সেখানে পৌঁছায়নি।

তারপরও এলোপাতাড়ি গুলি চালায় পুলিশ। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। গুলি আমার পা থেকে বুক, মুখ, মাথা, চোখ—সব জায়গায় লাগে। মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। শুরুতে স্থানীয়রা একটি হাসপাতালে, পরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিলে দুই দফায় অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু শরীর থেকে খুব কমসংখ্যক গুলি বের করতে সক্ষম হন চিকিৎসকেরা।

এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘৩১ আগস্ট ডাক্তাররা আমার দুই চোখ হারাতে হবে বলে জানান। বর্তমানে বাঁ চোখে আলো পড়লে বুঝতে পারি। ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। সিটি স্ক্যান করে দেখা যায়, কেবল মাথাতেই এখনো শতাাধিক গুলি রয়েছে। ওগুলো বের করলে চিরদিনের জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলব বলে জানান ডাক্তার।’

তবে এত বিভীষিকাময় সময় পার করেও আক্ষেপ নেই ওমর ফারুকের কণ্ঠে। তিনি বললেন, ‘এই ত্যাগের বিনিময়ে হলেও দেশটা ফ্যাসিস্টমুক্ত হয়েছে। ভালো থাকুক আমার দেশ, এটাই আমাদের চাওয়া।’

শুধু ফারুক নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এক হাজার ৩৪ জনের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরই এক চোখ চিরদিনের জন্য আলো হারিয়েছে। আর দুই চোখ হারিয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা অর্ধশত।

আন্দোলনে অংশ নিয়ে এক চোখ হারিয়েছেন সিলেটের মেহেদী হাসান। ২১ বছর বয়সী এই যুবক গত ৪ আগস্ট সিলেট কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন। স্থানীয়রা উদ্ধার করে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিলে সেখানেও হানা দেয় পুলিশ। চিকিৎসায় বাধা দেওয়া হয়, তুলে নিতে শাসানো হয় চিকিৎসকদের।

গত ১৯ ডিসেম্বর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গেলে কথা হয় মেহেদীর সঙ্গে। আমার দেশকে তিনি জানান, ‘কয়েক হাজার মানুষ আন্দোলন করছিলাম। এ সময় পুলিশ ফাঁড়ির পাশে এবং ওপর দিক থেকে একাধারে গুলি করা হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছুটতে থাকে সবাই। এতে বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি সোজা আমার চোখে এসে লাগে।

পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে গেলে পুলিশ তুলে নিতে চায়। তবে ডাক্তাররা চিকিৎসা দেওয়ার পর নেওয়ার অনুরোধ জানায়। পরে তারা চিকিৎসা দিয়ে একটি গাড়িতে নিরাপদ স্থানে পাঠায় আমাকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবরে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে গেলে সেখান থেকে দ্রুত ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। ৬ আগস্ট চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আসি। শরীরে বেশ কটি গুলি বের করলেও এখনো বহু গুলি রয়ে গেছে। ডান চোখ স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়েছে। বাঁ চোখেও একেবারে কাছের ছাড়া দূরের কিছু দেখতে পাই না।’

অন্যদিকে শরীরে গুলি নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালাতে হয় ফয়সাল হাওলাদারকে। ২০ বছর বয়সী এই যুবক গত ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও হামলা চালায় পুলিশ। জানে বাঁচতে আহত অবস্থায় হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। পরে চিকিৎসা পেতে ছোটেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)।

ফয়সাল পটুয়াখালী আব্দুল করীম মৃধা কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা দিনমজুর, তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ফয়সালই। পরিবারের দায়িত্বও কাঁধে, তাই তো পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতে হয় তাকে। এজন্য যাত্রাবাড়ী এলাকায় থাকতেন। গত ১৮ ডিসেম্বর পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন ফয়সাল। এ সময় আমার দেশ-এর সঙ্গে কথা হয় এই টগবগে যুবকের।

ফয়সাল জানান, সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা ভাবলে এখনো আঁতকে উঠি। সে সময় যাত্রাবাড়ীর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। পুলিশ কোনো ধরনের চিন্তা ছাড়াই জনতার ওপর গুলি চালায়। আমিসহ বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হই। শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগে। বিশেষ করে ডান পায়ে একপাশ দিয়ে গুলি লেগে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। কয়েকজন ভাই ও আমিসহ পাঁচজনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে সেখানেও হামলা চালানো হয়। আহত অবস্থায় পুলিশ অনেককে মারধরও করে। জান বাঁচাতে অনেকটা পালিয়ে আসি। তবে আহত হয়েছি দুঃখ নেই, বাংলাদেশটা ভালো থাকুক—এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।’

ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত