Ad

চেতনার লড়াই

আরিফুল হক
প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ০৭

বাংলাদেশে চেতনার লড়াই চলছে। চেতনা মানে আদর্শ বা দর্শন। একটা চেতনার কথা তো আপনারা অহরহ শুনে থাকেন, সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা ভাষাভিত্তিক দেশ গড়ার চেতনা। অর্থাৎ ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা।

লড়াই বললে তো দুপক্ষ লাগে, আরেক পক্ষ তাহলে কে? আকেক পক্ষ হলো ‘প্যান ইসলামিক চেতনা’ বা মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদী জীবন দর্শন হলো ভাষা, ভূগোল এবং ইসলামবিরোধী জীবন দর্শন, যাকে ওরা ধর্মনিরপেক্ষতা নাম দিয়েছে!

অন্যপক্ষে প্যান ইসলামি চেতনা বা জীবন দর্শন হলো কোরআন এবং সুন্নাহভিত্তিক জীবন দর্শন। যার আদর্শ হলো ভাষা, বর্ণ, ভৌগোলিক সীমারেখাকে উপেক্ষা করে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কল্যাণে এক হয়ে কাজ করার জীবন দর্শন। যেমনটা নবীজি (সা.)-এর সময়ে আমরা দেখেছি। আরবের আবুবকর, ওমর, আলী (রা.), আফ্রিকার বেলাল, রোমের শোয়ায়েব ও ইরানের সালমান ফারসি (রা.) এক হয়ে ইসলামের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।

ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখব, প্যান ইসলামি চেতনা নিয়েই মুসলমানরা ২০০ বছর ধরে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটিশ ও তাদের পোষ্য রাজা, জমিদারদের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বীজ বপন করে গেছেন।

প্যান ইসলামি চেতনা নিয়েই করাচির মহম্মদ আলি জিন্নাহ, ইউপির লিয়াকত আলি খান, ঢাকার খাজা নাজিমুদ্দিন, সীমান্ত প্রদেশের আবদুল কাইয়ুম খান এক কাতারে দাঁড়িয়ে বর্ণ হিন্দুদের সঙ্গে সংগ্রাম করে ১৯৪৭ সালে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে ভারতবর্ষের সব থেকে অবহেলিত, শোষিত, নির্যাতিত ও অশিক্ষিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দেশ পূর্ববাংলা আজ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে পরিচিত হতে পেরেছে। ইসলামি ঐক্যের চেতনা ছাড়া বাংলাদেশ সৃষ্টি অকল্পনীয় ছিল। এ সত্যটা অনেকে ভুলে যান।

ভাষাভিত্তিক দেশ এক অলীক কল্পনাপ্রসূত চিন্তাধারা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের কোনো ঐতিহ্যই নেই। মুসলিম বিজয়ের আগে সেন রাজারা এ দেশে এসেছিলেন কর্ণাটক থেকে, তখনো যেমন ভাষাভিত্তিক দেশ ছিল না। মোগল শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন নবাবি আমলের বাংলা, বিহার, ওড়িশার নবাবরাও ভাষাভিত্তিক দেশ গড়ার কথা চিন্তা করেননি।

ভাষাভিত্তিক দেশ গঠনের কথা চিন্তা করলে হিন্দু নেতাদের পক্ষে যেমন অখণ্ড ভারত গড়ার আশা ত্যাগ করে ১৬০০ ভাষার দেশ ভারতবর্ষকে ১৬০০ খণ্ডে ভাগ করতে হতো, তেমনি ৭৪ ভাষার দেশ পাকিস্তানকে ৭৪ খণ্ডে ভাগ করতে হতো, যা ছিল অবাস্তব অপরিণত বুদ্ধিসম্মত চিন্তা। তাই সুবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো নেতাই এ পথে পা বাড়াননি।

ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে এক কথায় বলতে গেলে বলা যায় বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনা, যা ইসলামি চেতনা বা জীবন দর্শনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তার মুসলমানদের জন্য আল্লাহতায়ালা ভয়ংকর আজাবের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আর তাদের মতো হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিদর্শনসমূহ আসার পরও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে। তাদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর আজাব।’ (সুরা ইমরান : ১০৫)

আল কোরআনের বহু জায়গায় এক আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধরার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ মুসলমানের বাস হলেও এই বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালি চেতনা, যাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামের লেবেল লাগিয়ে ফেরি করা হচ্ছে, সেটি একটি ম্যাকিয়াভেলি কল্পনাপ্রসূত চিন্তাধারা! যার মূলে আছে ক্ষমতার লোভ। অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা দখলই বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার মূল উৎস। যার সঙ্গে যুক্ত ভারতের হিন্দুত্ববাদী চাণক্য অপকৌশল। বিভিন্ন ধরনের মিথ্যাকে রঙিন প্রচারের মোড়কে মুড়ে বর্ণ হিন্দুত্ববাদী চেতনা, বাঙালি চেতনার নাম দিয়ে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে, দিল্লির লাড্ডু খাওয়ার মতো বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ তৌহিদবাদী মুসলমান বিভ্রান্ত হয়ে ভুলে গেছে নিজেদের জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জীবনাদর্শ। ১৮ কোটি মুসলমানের দেশের তৌহিদবাদী মুসলমানরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ছোবলে পড়ে ১৮ ধারায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তৈরি হয়েছে বাঙালি বিহারি, মৌলবাদী প্রগতিশীল, মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মৌলবাদী চেতনা, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ। মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন চিন্তায় বিভক্ত হয়ে তারা নিজেরা নিজেদের অপদস্থ করছে, গালাগাল করছে, মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করছে। আর সেই জাতিগত বৈরিতার সুযোগ নিয়েই মুসলমানদের চিরশত্রু ভারত। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মুসলমানকে স্বাধীনতার মুলা দেখিয়ে হিন্দুত্ববাদের অনুগত দাস হিসেবে ব্যবহার করছে।

এই বাঙালি চেতনাধারীরা, যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদারও ঘোষণা করে, তারা প্রায় সবাই ভারতের অনুগত দাস। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু মানুষ বাংলায় কথা বলার কারণে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নাড়ির টান অনুভব করে। এই নাড়ির টানের কারণে তারা ভারতের নাড়িতে বাঁধা থাকাকে উত্তম সৌভাগ্য মনে করে।

বাঙালি চেতনাধারীদের কাছে ইংরেজ এবং তাদের পোষ্য হিন্দু জমিদারদের ২০০ বছর ধরে মুসলিম শোষণ-নির্যাতন গুরুত্বহীন। কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ২০০ বছর ধরে সংগ্রাম, আত্মাহুতি- এসব কোনো গুরুত্ব বহন করে না। মুসলিম হোমল্যান্ড নির্মাণের জন্য ফকির মজনু শাহ, শমশের গাজী, নুরুল দীন, বোলাকী শাহ, শরিয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, তিতুমীর, টিপু পাগলারা জীবন দান থেকে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ১১৯ প্রার্থীর মধ্যে ১১৬ জনকে নির্বাচিত করে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস এদের কাছে গুরুত্বহীন।

এদের কাছে গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, ইন্দিরা থেকে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শ্যামাপ্রসাদ, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, বিধান রায়, জ্যোতিবসু, প্রণব মুখার্জি যত আপন, আল্লামা ইকবাল, কায়েদে আজম জিন্নাহ, ফজলুল হক, কবি নজরুল, নওয়াব সলিমুল্লাহ, মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ মুসলিম মনীষী ততই ঘৃণিত এবং অপাঙ্‌ক্তেয়। বাঙালি চেতনাধারীরা পশ্চিম বাংলার ভাষা, কালচার, পালা-পার্বণকে বাংলাদেশের মুসলমানদের ভাষা, সংস্কৃতি পালা-পার্বণের সঙ্গে এক করে দেখে। এদের ধর্মনিরপেক্ষতায় মুসলমানদের কোনো স্থান নেই।

তাই আজ ১৮ কোটি মুসলমানের দেশে মুসলমানরাই অবহেলিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। ৯৮ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে আল্লাহু আকবার স্লোগান, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলা প্রায় নিষিদ্ধ। মসজিদ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, আল্লাহ এবং তার নবী-রাসুলের নাম নিয়ে কটূক্তি করা হচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী দেবদেবীর স্তবস্তূতিমূলক প্রবন্ধ পাঠ্যপুস্তকে সংযোজিত হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে তাদের মৌলবাদী, রাজাকার, সন্ত্রাসী ইত্যাদি সিল লাগিয়ে জেল-জুলুম, গুম-খুন, এমনকি ফাঁসি দিয়েও মারা হচ্ছে।

পাঠকবৃন্দ, ইতিহাস যারা জানেন, তারা অনুভব করবেন অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার নির্যাতিত মুসলমানদের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের মুসলমানদের কোনো তফাত নেই। অষ্টাদশ শতকের নির্যাতনকারীরা ছিল কলকাতার লাটু বাবু, গোবরডাঙ্গার জমিদার কালিপ্রসন্ন বাবু, গোবরা গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায় ও পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। আজ তাদের চেহারা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র, তাই চেনা যাচ্ছে না; কিন্তু অন্তরাল থেকে সেই বাবুদেরই অদৃশ্য হাত অশুভ ছায়া হয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মবোধ, স্বাধীনতা, ঈমান-আকিদা-সংস্কৃতির টুঁটি চেপে ধরেছে। কৃষ্ণদেব রায়দের প্রচ্ছায়ায় কালো কাফন হয়ে বাংলাদেশের নির্মল আকাশটাকে কালো মেঘে ঢেকে দিয়েছে। কাশ্মীরের দিকে তাকান, ভারতের ২৫ কোটি মুসলমানের নারকীয় লাঞ্ছনার দিকে তাকান। অনুভব করুন কী পাশবিক, কী বীভৎস সেই নারকীয় হাতের তাণ্ডব। কিছু স্বার্থপর নেতা-নেত্রীর প্ররোচনায় বাংলাদেশকে ভারতের পায়ে ঠেলে দেবেন না। ছিঁড়ে ফেলুন ওই কালো কাফন। নির্মল-মুক্ত করুন দেশ।

কোথায় বাংলাদেশের মর্দে মোমিন! কোথায় আমার তরুণ সমাজ! বসে থাকার বেলা নেই মোটেই। সামনে ভয়াবহ দুর্যোগ। জেগে ওঠো হে আল্লার সৈনিক। আবার তোমরা হাজি শরিয়তুল্লাহ হয়ে, নিসার আলি তিতুমীর হয়ে, মুনশি মেহেরুল্লাহ হয়ে, মৌলভি আহমদুল্লাহ হয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে বেরিয়ে এসো। শত শত বাঁশের কেল্লা গড়ে তুলে বিদেশি বেঈমান আর তাদের দেশি চরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যুহ রচনা করো। বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠুক আলীর জুলফিকার, শত্রুর হৃৎকম্প ধরাক তোমার ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির ধ্বনি।

জেগে ওঠো আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মুজাহিদরা। জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের হয়ে উদাত্ত আহ্বানে বলো-

“তওহিদ আর বহুত্ববাদে বেঁধেছে আজিকে মহাসমর

‘লা-শরিক’ ‘এক’ হবে জয়ী- কহিছে ‘আল্লাহু আকবার’।”

ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত