Ad

ছাত্র গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল অনিবার্য

খায়রুল আনোয়ার
প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩: ১২

দেশ কাঁপানো ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের অভ্যুত্থান একদিকে যেমন বিস্ময়কর, আরেকদিকে ছিল অনিবার্য। অনিবার্য এ কারণে যে, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, এ ধরনের একটি অভ্যুত্থান ঠেকানো সম্ভব ছিল না। এটি ২৪-এর আগেও হতে পারত, না হলে পরে হতো। তবে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ছিল অবশ্যম্ভাবী। এর পটভূমি শেখ হাসিনা নিজ হাতেই তৈরি করেছিলেন। পতিত স্বৈরাচারী সরকারের মতো বিগত আর কোনো সরকার জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচনকে এমনভাবে কলঙ্কিত করেনি। যে ভোট দেওয়াকে বাংলাদেশের মানুষ উৎসবের মতো মনে করত, সেই ভোটারদের নির্বাচনবিমুখ করা হয়েছে। নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়, নির্বাচন কমিশন ছিল সরকারের আজ্ঞাবহ। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে শেখ হাসিনা একসময় আন্দোলন করেছিলেন, ক্ষমতায় গিয়ে সেই বিধিব্যবস্থাকে তিনি নির্বাসনে পাঠান। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর স্বৈরাচারী সরকার দমন-পীড়ন শুরু করে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়ে, কারাগারে ঢুকিয়ে রাজনীতির ময়দান বিরোধী দলশূন্য করার চেষ্টা চলে একের পর এক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে ঢোকানো হয়। গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রেওয়াজে পরিণত হয়। ব্যাপক হারে ও নির্বিচারে দমননীতি প্রয়োগ করা হয়। পুলিশ বাহিনীকে পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করা হয়। জনসমর্থনের পরিবর্তে শেখ হাসিনার একমাত্র সহায়ক শক্তি ছিল পুলিশ, প্রশাসন আর গোয়েন্দা সংস্থা। বিগত বছরগুলোতে পুলিশের নিয়োগ হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।

১০ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার জানিয়েছেন, ‘গত ১৫ বছরে ৯০ হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্যকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ‘চাকরি প্রার্থী, তার বাপ-দাদা কোন দলের লোক, এমনকি পূর্বপুরুষরা কোন দলের লোক- এগুলো পর্যন্ত খবর নেওয়া হয়েছে।’ নিজস্ব ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে বেসরকারি ব্যাংক তুলে দিতে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই)-কে ব্যবহার করা হয়। আর এভাবে সাতটি ব্যাংক বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম কব্জা করে নেন। দেশের শীর্ষ ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকের ৫০ হাজার কোটি টাকা গেছে এস আলম এবং এর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নাবিল গ্রুপের পকেটে। আওয়ামী সরকারের সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ইউসিবি ব্যাংক থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। দেশের বাইরে তার কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা সরিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অক্টোবর মাসের শেষে বিদেশি এক গণমাধ্যমকে এমন তথ্য জানিয়েছেন। তার দেওয়া তথ্য অনুসারে এর মধ্যেই এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার লুটপাট করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মন্তব্য, ‘যে কোনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতি। রাষ্ট্রীয় মদতে এই মাত্রার ব্যাংক ডাকাতি বিশ্বের অন্য কোথাও হয়নি। ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহীদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে এটা করা হয়েছে।’

শেখ হাসিনা দেশকে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে পরিণত করেছিলেন- এ কথা বললে বেশি বলা হবে না। এই কোম্পানির সদস্য বা পরিচালক ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যাংক লুটেরা, কোটারি ব্যবসায়ী, পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। দেশে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়, ফলে দুর্নীতি এক কুৎসিত রূপ ধারণ করে। মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা যেন দুর্নীতি করার লাইসেন্স পেয়ে যান। তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির ফিরিস্তি এখন প্রকাশ পাচ্ছে। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে একটি বক্তব্যেই এর প্রমাণ মিলবে। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বাসার কাজের লোক ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করেছে। হেলিকপ্টার ছাড়া সে চলে না। জানার পর আমি ব্যবস্থা নিয়েছি, কার্ড সিজ করে তাকে বের করে দিয়েছি।’ শেখ হাসিনা দুর্নীতিকে যে কতটা প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, এ ঘটনাই তার প্রমাণ। ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতি করার শাস্তি হচ্ছে তার কার্ড ‘সিজ’ করে অপরাধীকে বের করে দেওয়া। ওই ব্যক্তি এখন নিরাপদে মার্কিন মুল্লুকে বসবাস করছেন।

স্বৈরাচারী সরকার বিচার বিভাগকে ‘ইচ্ছা পূরণের’ আদালতে পরিণত করে। নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ বিচারালয় আইনমন্ত্রী ও আইন সচিবের ‘ইশারা-ইঙ্গিতে’ চলত। ওই সময় দেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। নানা অজুহাতে গণমাধ্যমকে দমন করা হয়েছে। ‘আমার দেশ’ পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। তার নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মামলা দেওয়া হয়। মামলার হাজিরা দিতে কুষ্টিয়ায় গেলে তার ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। ‘যায়যায়দিন’খ্যাত সম্পাদক শফিক রেহমানকে জেলে ঢোকানো হয়। সংবাদপত্র জগতের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকেও জেল খাটিয়েছেন শেখ হাসিনা। একাত্তর টিভির টকশোতে ব্যারিস্টার মইনুলের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে স্বয়ং শেখ হাসিনার উসকানিতে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাকে কারাগারে যেতে হয়। ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান ও ‘ডেইলি স্টার’ সম্পাদক মাহফুজ আনামের নামে সারা দেশে দলীয় লোকজন দিয়ে অসংখ্য মামলা দেওয়া হয়। ‘নিউ এইজ’ সম্পাদক নুরুল কবিরকে গোয়েন্দা দিয়ে অনুসরণ করা হতো। তার পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখা হয়। টিভি টকশোতে তার ওপর ছিল অলিখিত বিধিনিষেধ। বর্তমান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকেও টিভি টকশোতে আমন্ত্রণ না জানাতে বলা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত ও ইসলামি টিভি। দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন দিয়ে সরকারবিরোধী হিসেবে বিবেচিত (স্বৈরাচারী সরকারের দৃষ্টিতে) টিভি চ্যানেলগুলোর খবর ও টকশো সর্বক্ষণ নজরদারি করা হতো। জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচনে পর্যন্ত গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। কোনো খবর সরকারের পছন্দ না হলে সাংবাদিকদের ডিজিএফআইয়ে ডেকে পাঠানো হত। গোয়েন্দাদের দিয়ে তাদের ভয়-ভীতি দেখানো হত। গোয়েন্দারা অনেক সাংবাদিক ও ভিন্নমতের লোককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে।

শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে এবং তার দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দুঃশাসন জারি রাখতে ‘উন্নয়নের মায়াজাল' তৈরির কৌশল বেছে নেন। দীর্ঘ ১৬ বছরে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, সড়ক যোগাযোগসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হলেও এর বিপরীতে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিদেশি ঋণনির্ভর এসব প্রকল্পের ব্যয় দফায় দফায় বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রয়োজন নেই- এমন অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেমন কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা রেল সেতু প্রভৃতি। পরিবেশবাদীদের তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পরও ভারত এবং সে দেশের একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে (আদানি গ্রুপ) সুবিধা দেওয়ার জন্য রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন ‘শ্বেত হস্তি’ ও সুন্দরবনের সর্বনাশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কথিত উন্নয়নের বয়ান প্রচারের আড়ালে দেশের মানুষের মাথায় ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের বোঝা রেখে গেছে আওয়ামী সরকার। স্বৈরাচারী সরকারের ১৫ বছরে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। দেশের অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির এক প্রাক্কলনে এই তথ্য উঠে এসেছে। যার অনুমিত পরিমাণ দেশের প্রায় পাঁচটি বাজেটের সমান।

ওপরে বর্ণিত এসব কিছুই স্বৈরাচারী শাসকের পতনের জন্য যথেষ্ট। শেখ হাসিনার পতনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েই ছিল। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণতন্ত্রকামী মানুষ লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রাম করে এই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। শেখ হাসিনা বারুদের স্তূপের ওপর বসে ছিলেন। শুধু একটি স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেই স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বালিত করে। তাদের নেতৃত্বে ৩৬ দিনে শত শত শহীদের আত্মদান, হাজার হাজার ছাত্র-জনতার আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে। তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে এক স্বৈরশাসকের ক্ষমতার প্রাসাদ। তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক দলগুলোর পেছনে প্রেরণা ছিল ১৯৫২, ৫৪, ৫৬, ৬৬, ৬৯-এর গণআন্দোলন। তবে ২৪-এর জুলাই-আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান একমাত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া আর সব আন্দোলনকে ছাপিয়ে গেছে। এর কারণ মাত্র ৩৬ দিনে এত মানুষের আত্মদান এর আগে কখনো ঘটেনি।

নিবন্ধটি শেষ করব পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী গৌরকিশোর ঘোষের ‘দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা’ বই থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য ইন্দিরা গান্ধীর আমলে কারাগারে যাওয়া গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছেন, ‘যেখানে লোভ, হিংসা আর মিথ্যার শাসন, ফ্যাসিবাদ সেখানেই প্রভু। যেখানে অন্যায় আর অবিচার, দমন আর পীড়ন, ফ্যাসিবাদ সেখানেই প্রভু। লোভ, হিংসা আর মিথ্যা, অন্যায়-অবিচার আর দলন-পীড়ন ফ্যাসিবাদের এরাই একমাত্র আশ্রয়। তাই এগুলির উচ্ছেদেই ঘটবে ফ্যাসিবাদের চিরপরাভব।’ বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গণতন্ত্রকামী মানুষ, রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় এক আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটে। এভাবে ইতিহাস তার দায় মেটায়। সূচনা হয় গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভিযাত্রা।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

বিষয়:

মতামত
ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত