Ad

ডিবি থেকে নিয়ে ৯ তরুণ খুন

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০: ২৪
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০: ৫৪

অপরাধ করে কারও ফাঁসি হলেও স্বজনরা কখনো লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানান না। তবে ব্যতিক্রম ছিল আট বছরের বেশি সময় আগে রাজধানীর কল্যাণপুরে জাহাজবাড়ীতে তথাকথিত ‘জঙ্গিবিরোধী’ অভিযান। সেই অভিযানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল ৯ তরুণ। তারা ডিবিতে আটক ছিলেন। সন্ধ্যা নামার আগেই আলো-আঁধারি পরিবেশে ডিবি থেকে বের করা হয় তাদের। নেওয়া হয় জাহাজবাড়ীতে। পরদিন ভোরে ফজরের আজানের পরপর গুলি করে নির্মমভাবে খুন করা হয়। পরিবারকে দেওয়া হয়নি লাশ। দেওয়া হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে। নিহতদের কেউ ছিলেন গার্মেন্টকর্মী, কেউ শিক্ষার্থী। তবে তাদের মধ্যে সাতজনই ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

সেই লোমহর্ষক ঘটনা অনুসন্ধান করে এক নির্মম চিত্র পাওয়া গেছে। এই তরুণরা কি জঙ্গি ছিলেন না জঙ্গি সাজানো হয়েছে? আরও আগে তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হলো না, খুন করে লাশ কেন পরিবারকে দেওয়া হয়নি, পুলিশের সাজানো বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় আমার দেশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

‘জাহাজবাড়ী’ হিসেবে পরিচিত তাজ মঞ্জিলে পুলিশের ‘অভিযান’ চালানো হয় ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই। এসব তরুণকে হত্যার পর বরাবরের মতোই পুলিশের দাবি ছিল— ‘দরজা নক করলে … গুলি ও গ্রেনেড ছুড়তে থাকে... আত্মরক্ষার্থে ...।’

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে তরুণদের হত্যা করা হয়েছে। এসব তরুণ ছিল ডিবির হেফাজতে। সেখান থেকে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। আর একে ইসলামি জঙ্গিকার্ড হিসেবে ব্যবহার করেন পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার।

ডিবি থেকে তাদের তুলে নিতে দেখেছেন ব্যবসায়ী শেখ মো. সেলিম হোসাইন। তিনিও কুখ্যাত আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন। আয়নাঘরের তথ্য তিনিই প্রথম ফাঁস করেন। জাহাজবাড়ীতে নিয়ে হত্যার আগে ডিবির কাছ থেকে হতভাগ্য তরুণদের তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি।

সেলিমের চাঞ্চল্যকর তথ্য

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পুরান ভবনে ঢুকতেই ডান দিকের ছোট্ট এক গারদঘরে দীর্ঘদিন বন্দি সেলিম। ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর থেকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল তাকে। দিনভর সেই গারদের দরজায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন মানুষের আসা-যাওয়া স্পষ্ট দেখতে পেতেন তিনি। পাশেই পুলিশের জন্য স্থাপন করা টেলিভিশনের শব্দও কানে ভেসে আসত।

এক বিকালের ঘটনা। গারদের দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। সেদিন একই রুমে তার সঙ্গে ছিলেন সাদ্দাম ও মাওলানা আবুল কাশেম। নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

‘আমাদেরকে ডিবির পুরোনো ভবনের যে সেলে রাখা হইত, এর প্রথমেই একটা সেল ছিল ছোট্ট। এই সেলেই আমি গ্রিল ধইরা দাঁড়াইয়া ছিলাম, দরজার সামনে। এটা থেকে বাইরে পুরা দেখা যায়,’ সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা এভাবেই শুরু করেন তিনি।

এরপর একটা বড়সড় পুলিশ ভ্যান গারদের সামনে পেছন দিক করে দাঁড়ায়। একে একে সেই ভ্যানে আনুমানিক ১০-১১ তরুণকে ওঠাতে দেখেন সেলিম।

‘সবার পরনে কালো পাঞ্জাবি। চোখ বাঁধা কালো কাপড়ে, মুখ খোলা। সাদা পোশাকের পুলিশের হাতে কালো কয়েকটা পতাকা। তরুণদের ভ্যানে উঠিয়ে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়ে চলে গেল,’ এভাবেই হিম-করা ঘটনার বর্ণনা শুরু করেন এই প্রত্যক্ষদর্শী।

শেখ সেলিম আমার দেশ-কে বলেন, ‘কালো কাপড় ছাড়াও একই রকমের কাপড়ের পতাকার মতো ওরা পেঁচাইয়া নিয়া যায়। ওদেরকে গাড়িতে নেওয়ার সময় সব পুলিশ ছিল সিভিলে। গাড়িটার পেছনটা আমাদের দরজা বরাবর ছিল। ওদেরকে সেই দরজা দিয়া ওঠায়। সিভিলে ওদের সঙ্গে দু-তিনজন নিয়েছে। ওদের হাত ক্যাবল টাই দিয়া বাঁধা ছিল। প্লাস্টিকের ক্লিপের মতো আর কী! ওরা যখন একজন-একজন করে ওঠে, তখন মেইন দরজা দিয়া আমরা অনেকে দাঁড়াইয়া দেখি। পতাকা পেঁচানো ছিল। আর ওদের মাথার মধ্যে কালো কাপড় ছিল। চোখেও কালো কাপড়ে বাঁধা। পায়ে বেড়ি ছিল না।’

সেই তরুণ কারা

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে অতীতে ডিজিএফআইয়ের ‘আয়নাঘর’ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করা শেখ সেলিম সেদিন ডিবি অফিস থেকে ১০-১১ তরুণকে কালো পাঞ্জাবি পরিয়ে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী।

আমার দেশ-এর কাছে তিনি সেই তরুণদের সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। কুখ্যাত আয়নাঘরের তিনি হুইসেলব্লোয়ার।

তার বক্তব্য যাচাই করেছে আমার দেশ। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত রাজধানীর কল্যাণপুরের ‘জাহাজবাড়ী’-তে তথাকথিত জঙ্গি হামলার চাঞ্চল্যকর নাটকের অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে।

অন্যদিকে হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে প্রচার করা মারজান নামের যে তরুণকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার দাবি করেছিল পুলিশ, প্রকৃতপক্ষে তাকেও ডিবির একটি ছোট রুমে অনেক আগেই ধরে এনে চেয়ারের নিচে মাথা রেখে বেঁধে রাখতে দেখেছেন শেখ সেলিম।

এই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে উঠে এসেছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা রাজধানীর কল্যাণপুরে ‘জাহাজবাড়ী’-তে তথাকথিত জঙ্গিদের সঙ্গে ভয়াবহ গ্রেনেড-বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা একদমই পুলিশের সাজানো নাটক ছিল। সেই তরুণদের আগে থেকেই ডিবি অফিসে বন্দি রাখা এবং পরে তাদের কালো পাঞ্জাবি-ট্রাউজার, মাথায় কালো পট্টি পরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর কথা বর্ণনা করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী শেখ সেলিম।

সেলিম আরও বেশ কয়েকজন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করেছেন। তারা এই তরুণদের ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন।

বর্তমানে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন শেখ সেলিম।

আর এই ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী, যাকে ‘জাহাজবাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়’ গুলি করে ধরার দাবি করেছিল পুলিশ, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে র‌্যাশ নামের সেই তরুণকেও জুলাই বিপ্লবের সময় গত ৫ আগস্ট কাশিমপুর কারাগারে গুলি করে হত্যা করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

আর সাদ্দাম ও নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে।

যেভাবে ডিবি থেকে ‘জাহাজবাড়ি’-তে নেওয়া হয় তরুণদের

শেখ সেলিম বলেন, ‘যখন ঘটনা ঘটে (জাহাজবাড়ী) আমাকে মিন্টু রোডে রাখা হয় আয়নাঘর থেকে এনে। ডিবিতে আমাকে প্রথমেই সেলের মধ্যে রাখা হয়েছে। এটার কোনো জানালা নেই। শুধু সামনে একটা দরজা আছে গ্রিলের। টয়লেট আছে ভেতরে। এখানে প্রায়ই আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম। সেদিন বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, একটা পুলিশ ভ্যান ত্রিপলে ঢাকা। সেই তরুণদের কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা, কালো পাঞ্জাবি পরা। চোখ বাঁধা, কিন্তু মুখ খোলা। মোটামুটি ১০-১১ জনকে উঠাল। আমার আগে যারা ওইখানে পুরোনো ছিল, তাদের একজনের নাম সাদ্দাম। সে গেটে দাঁড়াইয়া বলছে, এরা আমার সাথি। সে বলল, ওদের আজকে আর ফেরত আনবে না।’

‘পরে ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তাদের (সেই তরুণদের) ওঠালো (ভ্যানে)। উঠিয়ে ত্রিপলের কাপড়টা ছেড়ে দিল। তাদের নিয়ে গেল। পরের দিন... ওখানে তো টিভি থাকে... নিউজে ঠিকই দেখলাম, তাদের ক্রসফায়ার দিয়ে দিয়েছে।’

‘অনেক দিন পর মুক্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর নিউজে দেখলাম, সাদ্দাম আর মারজানকে ক্রসফায়ার দিয়েছিল বেড়িবাঁধে। সে ছিল আমার ওখানে, মানে মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে (মানে সাদ্দামও প্রত্যক্ষদর্শী)। তো তারা বলাবলি করছিল, এদেরকে আর রাখবে না। মেরে ফেলবে। আজকেই ক্রসফায়ার দিয়ে দেবে।’

‘ডিবি থেকে আমাকে মামলা দিয়ে যখন কেরানীগঞ্জ কারাগারে পাঠায়... তখন ওই যে ১০-১১টি ছেলেকে উঠিয়ে নিতে দেখেছিলাম, ওদের মধ্যে একটা ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার একটা পা ল্যাংড়া ছিল। ডান পা, না বাঁ পা, আমার স্মরণে আসছে না। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটত। সে বলল, প্রথম কল্যাণপুরে ধরে নিয়ে রেখে আমাদের সবাইকে গুলি করে। আমার পায়েও গুলি— আমাকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য রাখে। আমার বয়স কম। এজন্য আমাকে মারেনি। তখন আমি তাকে বললাম, তোমাকে তো আমরা সেদিন দেখেছিলাম।’

‘সে বলল, জ্বি ভাই। আমাদের বিভিন্ন সময় এখানে ধরে এনেছে। কাউকে দুই বছর আগে, কাউকে এক বছর আগে।’

ডিবিতে বন্দিত্ব এবং সেই তরুণদের তুলে নিয়ে হত্যার পক্ষে আরও তথ্য দেন শেখ সেলিম।

তিনি বলেন, ‘আরও একটা ছেলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তার নাম খালেদ সাইফুল্লাহ। তার বাড়ি ছিল মাদারীপুর। তার বাবা সম্ভবত ছিলেন শিক্ষক। সেও ঘটনা সম্পর্কে জানে।’

‘এটা আর কে কে দেখেছে?’

‘আমি দেখেছি। সাদ্দামও ওদের সঙ্গে ছিল। সাদ্দামকেও নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নেয়নি। আরেকজন লোক দেখেছে, তার নাম হলো... (মনে করতে পারলেন না)। তার বাড়ি যশোরে। সেখানকার এক হোমিও ডাক্তার— খাটো, সুন্দর। কাশিমপুর ৪-এ পরে তাকে পাঠানো হয়। পরে কোর্টে দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে।’

স্মৃতি হাতড়ে শেখ সেলিম আরও বলেন, ‘সময়টা ৪টা থেকে ৫টা বা সাড়ে ৫টার মধ্যে। সূর্য অস্ত যাবে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার আগের দিন মনিরুল ইসলাম সিভিল ড্রেসে দলবল নিয়ে এসেছিল।’

‘তরুণদের নিয়ে যাওয়ার দিন পুলিশ কারা ছিল ওইদিন? চিনেছেন?’

‘না চিনিনি।’

মারজানকে আগেই ধরেছিল পুলিশ।

হলি আর্টিজান মামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত মারজানকেও ডিবির নির্জন এক সেলে দেখেছিলেন সেলিম। কথাও বলেছিলেন তার সঙ্গে।

সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে সেলিম বলেন, ‘ডিবি অফিসের ভেতরেই একটা কনটেইনারের মধ্যে নিয়ে পেটায়। আমাকে মারেনি। আমার সঙ্গে একটা ছেলেকে নিয়েছে সেখানে। ওকে পিটিয়েছে। ইফতারের সময় বা রাতে খাওয়ার সময় আমাদের ওই রুমে খাবার দিল। খাবার দিয়ে পেছন থেকে লক করে দিল কনটেইনার। আমরা ভেতরে বসা। মারজানের চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে চেয়ারের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ আটকে দিল। চেয়ারের নিচে ওকে ঢুকিয়ে রেখেছিল। মাথা নিচের দিক দিয়ে সে চেয়ারের নিচে বসে থাকত। পরে খাবারের সময় খাবার দিল... তখন এক হাত খুলে আরেক হাত চেয়ারের সঙ্গে লাগিয়ে দিল। ওর গামছা খুলে দিল চোখ থেকে। পরে... ওরা যখন তালা মেরে বের হয়ে যায়... আমরা তখন খাওয়া-দাওয়া করি। আমাদের দুজনের হাতে হ্যান্ডকাফ আর মারজানের চেয়ারের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ। পরে খাওয়া-দাওয়া করলাম। পরে সে (মারজান) আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলল; বলল, আমার নাম মারজান। আমাকে অনেক আগেই ধরে নিয়ে রেখেছে এখানে। ওর বাবাকেও নাকি ধরেছিল, বাট আমার পুরাপুরি মনে নেই। পরে মুক্ত হয়ে আমি মালয়েশিয়া আসার পর দেখলাম, মারজান আর সাদ্দামকে ক্রসফায়ার দিয়েছে।’

‘মারজানকে কোন মাসে, কোন সালে দেখেছিলেন?’

‘জুন-জুলাই হতে পারে। ২০১৬ সালে।’

‘হলি আর্টিজানের সময় মারজান কি ডিবিতে ছিল?’

জোর দিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’।

‘মারজানকে দেখার তারিখ মনে আছে?’

‘না ভাই।’

সেলিম বলেন, ‘সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার এক রেস্টুরেন্টের এক শেফের স্ত্রী ও তার সন্তানও ডিবিতে ছিলেন। সেই শিশু দামি খাবার ছাড়া কিছু খেতে চাইত না। বরখাস্ত হওয়া এক মেজরের (নাম উহ্য রাখা হলো) স্ত্রী ও সন্তানও ডিবিতে ছিলেন। সেই মেজরকে ধরতে তার স্ত্রীকে দিয়ে ফোন করানো হতো।’

‘ওইখানে আরও দুটা লোক ছিল। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ও তার বাড়ির ম্যানেজার। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ছিল। দুজন হিন্দু লোককেও ধরে এনেছিল জঙ্গিদের ফাইন্যান্স করার অভিযোগে। কয়েকজন প্রবাসীকেও ধরেছিল। এর মধ্যে একজনকে হ্যামার দিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দেয়। আরেক ছেলেকে দেখেছিলাম। তাকে তিন বা চার বছর আগে ধরে আনে। টেবিলেই সে ঘুমাত। আরেকটা ছেলে ছিল। তার ভাই নাকি সেনাবাহিনীর অফিসার। সেই ছেলে অস্ত্র মামলার আসামি। হলি আর্টিজানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে অংশ নেওয়া অফিসারদের একজন ছিলেন তার ভাই। ডিবি অফিসাররা সেই ছেলেকে সমীহ করত। সে নাকি অস্ত্রসহ ধরা খেয়েছিল। ওই ছেলেটাকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন।’

‘আমি সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, দরকার হলে আমি আদালতে সাক্ষ্য দিতেও প্রস্তুত,’ বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘যেহেতু আয়নাঘরে থেকে ডিবিতে এনেছিল, তখন আমার কাছে ঘড়ি-মোবাইল কিছুই ছিল না। সুতরাং (আমার বর্ণনায়) টাইমিংয়ে কিছু সমস্যা থাকতে পারে।’

‘মারজানকে দেখেছেন, শিওর?’

‘আরে ভাই ৩০০ ভাগ শিওর।’

জাহাজবাড়ীতে ৯ তরুণকে ধরে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যার পর জঙ্গি নাটকের পক্ষে পুলিশের একের পর এক অসত্য তথ্যও উঠে এসেছে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে।

সেই অভিযানে নিহত সাতক্ষীরার তরুণ মতিউর রহমানের বাবা নাসির উদ্দিন পরবর্তীকালে পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে গিয়েছিলেন। তবে সাতক্ষীরার আদালত তার আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল। ছেলের লাশও দেওয়া হয়নি মতিউরের বাবাকে।

একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল নিহত অন্যদের স্বজনদেরও। পুলিশের হুমকির মুখে কেউই প্রিয় সন্তানের লাশ গ্রহণ করতে পারেননি।

পুলিশের দাবি, তারা গোলাগুলিতে নিহত হয়। আসলেই সেই রাতে কি দুপক্ষে থেমে থেমে ভয়াবহ গোলাগুলি হয়েছিল? তরুণরা কি বন্ধ দরজার ভেতর থেকে গ্রেনেড ছুড়েছিল? মুখোমুখি গোলাগুলি হলে তরুণদের সবাই কীভাবে পিঠে ছয়-সাতটা গুলি লেগে নিহত হয়েছিল? রাতভর গোলাগুলি চালাতে তরুণদের হাতে কয়টা আগ্নেয়াস্ত্র ছিল? এমন অনেক প্রশ্নের জট খুলেছে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে। পুলিশের সেই রাতের তথাকথিত জঙ্গি গল্প, তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সঙ্গে চার্জশিট এবং জব্দ তালিকায় বড় ধরনের অমিল ধরা পড়েছে।

অভিযুক্ত আসামিদের পারস্পরিক সাংগঠনিক পরিচিতি মেলানোর গল্প, পুলিশের অভিযানের বিবরণ, ব্যালিস্টিক ও ফরেনসিক রিপোর্ট পর্যালোচনা, প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সাক্ষ্য, স্বজনদের বক্তব্য ও আইনজীবীদের মতামত বিশ্লেষণ করে পুলিশের দাবির সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক দেখা গেছে।

হঠাৎ শুরু হওয়া সেই ব্লক রেইডের নেতৃত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন ছিলেন মিরপুর জোনের তখনকার উপ-পুলিশ কমিশনার জসীম উদ্দীন মোল্লা।

চিনেছেন তাকে?

তার নেতৃত্বেই জুলাই বিপ্লবের সময় মিরপুরে ১৩৭ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। পলাতক শেখ হাসিনাসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা গণহত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি তিনি। এছাড়া জুলাই বিপ্লবকালে ছাত্র-জনতার ওপর পরিচালিত নির্মমতার ঘটনায় অন্তত ৩৫টি মামলায় আসামি জসীম।

ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, জসীম ও অন্য পুলিশ সদস্যরা মিলে অত্যন্ত সরু সিঁড়ির ঘিঞ্জি ভবনটিতে ‘গ্রেনেড হামলা ও ভয়াবহ গোলাগুলি’র মতো নাটক মঞ্চস্থ করে ৯ তরুণকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন। দৃশ্যত বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের গল্প সাজিয়ে পশ্চিমাদের সমর্থনে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ইসলামপন্থিদের দমনের মাধ্যমে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা ছিল এসব ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ (রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত) অভিযানের লক্ষ্য। এর মাধ্যমে ভিন্নমত দমন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করাও ছিল হাসিনার লক্ষ্য।

জাহাজবাড়ী হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং নব্য জেএমবির সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার গল্প বানায় পুলিশ। নিহত তরুণদের সম্পর্কে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নিহতদের চেহারা ও বেশভূষা দেখে ‘উচ্চশিক্ষিত’ বলে মনে হয়েছে।’

অথচ নিহতদের মধ্যে সাতজনই ছিলেন অতি সাধারণ পরিবারের সদস্য। হাসিনা সরকারের পুলিশের নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার সাহস সেসব পরিবারের ছিল না।

নিহতদের মধ্যে কেবল দুজন ছিলেন সচ্ছল পরিবারের সন্তান। সেসব পরিবারের সদস্যরা পুলিশের চাপে আত্মগোপনে চলে গেছেন। রাজধানীর ধানমণ্ডি ও গুলশানে স্বজনদের ঠিকানায় গিয়ে তাদের দেখা মেলেনি।

নিহত অপর সাত তরুণের একজনের বিরুদ্ধেও তাদের গ্রামগুলোয় প্রতিবেশী, স্থানীয় প্রশাসন বা কারও কোনো নালিশ বা অভিযোগ মেলেনি।

পুলিশ এই মামলায় যাদের সাক্ষী হিসেবে হাজির করেছে, তারাও সাধারণ পরিবারের। সেসব সাক্ষীর খোঁজও এখন মিলছে না।

জঙ্গিবাদের জুজু

অভিযোগ রয়েছে, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ক্ষমতায় টিকে থাকতে একের পর এক তথাকথিত ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযান’ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। এসব অভিযানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে রাষ্ট্রের সব শক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করা হতে থাকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই ‘সরকারের ভাষ্য’ প্রচার করেছে। আর এসব ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ অপারেশনে নিহত হন অনেক তরুণ, যাদের বেশিরভাগই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ পরিবারের সন্তান। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি ও সাধ্য তাদের ছিল না।

তথাকথিত ‘জঙ্গিবিরোধী’ অভিযানের বয়ান তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কার্ল সিয়োভাকো নামে এক লেখকের সঙ্গে বিদেশি একটি পত্রিকায় তিনি ‘বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থান রোধ’ (Stemming the Rise of Islamic Extremism in Bangladesh) শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন।

এতে জয় লেখেন, ‘… গত দুই বছরের জরুরি সামরিক শাসনের (ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দীন সরকার) কারণে শাসক কাঠামোর বৈধতা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইসলামি মতবাদ দেশটির সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হতে পারে।... তবে দীর্ঘস্থায়ী ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হলে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই এই ইসলামপন্থাকে সক্রিয়ভাবে দমন করার জন্য কিছু পরিবর্তন বাস্তবায়ন করতে হবে। সফল হলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ হতে পারে কোনো মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের বৈশ্বিক উদাহরণ।’

এমনকি, হাসিনাপুত্র সেনাবাহিনীতে ইসলামপন্থিদের নিয়েও নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরেন সেই লেখায়।

এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতারোহণের পর থেকেই জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কথা প্রচার করা হতে থাকে। ২০১৩ সালে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ রক্তাক্ত উপায়ে দমনের পর আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে হাসিনা সরকার। এরপর হোলি আর্টিজানে রহস্যজনক জঙ্গিবিরোধী রক্তাক্ত অভিযানের ধারাবাহিকতায় জাহাজবাড়ীতে ৯ তরুণকে হত্যা করা হয়।

পুলিশের প্রতিবেদনে অসঙ্গতি

জাহাজবাড়িতে তরুণদের হত্যার পর পুলিশের এজাহার, চার্জশিট ও জব্দ তালিকায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে অভিযান সম্পর্কে অসংখ্য অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য।

তথাকথিত সেই অভিযানের পরদিনই রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন্স) শাহ্জালাল আলম। দুই বছর পর ২০১৮ সা‌লের ৫ ডিসেম্বর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) পরিদর্শক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ১০ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেন।

এজাহারে বলা হয়, ‘কল্যাণপুর এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনাকালে ৫নং রোডের ৫৩নং বাড়ির (তাজ মঞ্জিল) পঞ্চম তলায় পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটে ০০:৩৫ ঘটিকায় তল্লাশির উদ্দেশ্যে দরজা নক করলে তারা দরজা না খুলে পুলিশকে ভীতসন্ত্রস্ত করে পালানোর জন্য কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে পুলিশের এএসআই দীল মোহাম্মদ আহত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিচে থাকা পুলিশ ভবনের সামনে-পেছনে এবং বিভিন্ন তলায় অবস্থান নেয়। গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরপরই জঙ্গিদের মধ্যে দুজন হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আমাদের লক্ষ করে গুলি করতে করতে পালানোর চেষ্টা করে। আমরা পাল্টা গুলি চালিয়ে একজনকে আহত অবস্থায় আটক করি।’

এজাহারে আরও লেখা হয়, ‘কিছু সময় পরপর জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণসহ জঙ্গিবাদসংশ্লিষ্ট স্লোগান দিতে থাকে। এরই মধ্যে বাসার মধ্যে অবস্থানরত জঙ্গিরা অগ্নিসংযোগসহ আশপাশে অবস্থানরত পুলিশকে লক্ষ করে মুহুর্মুহু গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। সোয়াত টিমের উপস্থিতি টের পেয়ে জঙ্গিরা ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে ভবনের নিরাপত্তাসহ সরকারি-বেসরকারি জানমাল রক্ষায় সোয়াত টিম পাল্টা গুলি বর্ষণ করতে থাকে। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী গুলিবিনিময়ের পর সোয়াত টিম জঙ্গিদের অবস্থানরত রুমে প্রবেশ করে এবং বর্ণিত ফ্ল্যাটটিতে ৯ জঙ্গির মৃতদেহসহ ব্যাপক পরিমাণ বিস্ফোরক, ডেটোনেটর, আগ্নেয়াস্ত্র, জিহাদি বই, ধারালো অস্ত্রসহ অন্যান্য সামগ্রী দেখতে পায়।’

পরে চার্জশিটেও একই ভাষ্য লেখা হয়।

পুলিশের এজাহার ও চার্জশিট বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেই তরুণদের বন্ধ কামরা থেকে পুলিশকে লক্ষ করে সরু সিঁড়িতেই মুহুর্মুহু গ্রেনেড নিক্ষেপের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অগ্নিসংযোগ ও থেমে থেমে গুলিবর্ষণের কথা রয়েছে। অথচ দরজায় নক করা পুলিশ সদস্যরা কয়েক হাত দূরে থাকলেও গ্রেনেড হামলায় একজনও আহত হননি। একে অবিশ্বাস্য বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

বিষয়টি ফের যাচাই করতে গত ১০ নভেম্বর, তাজ মঞ্জিলে যায় আমার দেশ টিম। সেই বাসার ছোট্ট দরজা বন্ধ অবস্থায় কীভাবে পুলিশকে লক্ষ করে বারবার গ্রেনেড ছোড়া হলো, তা এক বিস্ময়। তাহলে কি গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়নি?

গ্রেনেডের বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা কাটাতে পুলিশের দুটি জব্দ তালিকা যাচাই করা যাক।

পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন্স) শাহ্জালাল আলম মিরপুর থানায় দায়ের করা এজাহারে দুটি জব্দ তালিকার কথাও উল্লেখ করেন। আদালতে উপস্থাপিত নথিতেও হুবহু একই জব্দ তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেই জব্দ তালিকার কোথাও গ্রেনেডের কথা উল্লেখ করেনি পুলিশ।

প্রথম জব্দ তালিকায় সাধারণ ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসের পাশাপাশি বঁটি, স্ক্রু ড্রাইভার, রশি, দুটি চাকু, গুলির খোসা এবং রাইফেলের ৪৩০টি ও পিস্তলের ১৫টি এমটি কার্তুজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পুলিশের দ্বিতীয় জব্দ তালিকায় রয়েছে— ম্যাগজিনযুক্ত চারটি পিস্তল, সর্বমোট ১৪ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, এক রাউন্ড গুলির খোসা, তিনটি সুইচ গিয়ারের চাকু, বেশকিছু চাকু (যার মধ্যে পাঁচটি কাঠের বাঁটযুক্ত)।

জাহাঙ্গীর আলম নামের কল্যাণপুরের পুরোনো এক বাসিন্দা আমার দেশে’কে বলেন, সেই তরুণরা বন্ধ দরজা থেকে কীভাবে গ্রেনেড ছুড়ে মারবে? এটা খুবই দুর্বল স্ক্রিপ্ট। তর্কের খাতিরে ভেতরের জানালা দিয়ে গুলি করার কথা মেনে নিলেও কয়েক ফুটের সরু সিঁড়িতে এমন ভয়ঙ্কর গ্রেনেড মারা, কিংবা থেমে-থেমে গোলাগুলি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

সাক্ষীদের রহস্যজনক সাক্ষ্য

এই অভিযানের সাক্ষীদের বড় অংশই পুলিশ সদস্য। এছাড়া সাধারণ নাগরিক হিসেবে বাড়ির মালিক ও তাদের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষী এবং কয়েকজন তরুণকে সাক্ষী করা হয়েছে। পুলিশের বর্ণনামতে, ভয়াবহ গ্রেনেড ও গোলাগুলির সময় স্থানীয় কয়েকজন সাধারণ নাগরিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন গ্রেনেড হামলা ও গোলাগুলি প্রত্যক্ষ করেন।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১‌৬১ ধারায় দেওয়া সাক্ষীদের জবানবন্দি যাচাই করলে বিস্ময়কর বৈপরীত্য দেখা যায়।

মামলার প্রথম সাক্ষী করা হয়েছিল কল্যাণপুরের শহীদ মিনার রোডের ২৫ বছরের অধিবাসী মো. সুমন মিয়াকে।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘… আরও জানিতে পারি ব্লক রেইড করার সময় উক্ত বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায় পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটে থাকা জঙ্গিরা গভীর রাতে পুলিশের উপস্থিতি টের পাইয়া পুলিশকে লক্ষ করে হাত গ্রেনেড ও গুলি করিতে থাকে। ওই সময় পুলিশের এএসআই দীল মোহাম্মদ জখমপ্রাপ্ত হয়। ... ওই সময় জঙ্গিদের বাসার পশ্চিম/উত্তর চিপা বারান্দার গ্রিলের পকেট গেট দিয়ে দুজন জঙ্গি পাশের বিল্ডিংয়ের জানালার কার্নিশ দিয়ে দ্রুত নামার সময় পুলিশের এএসআই দীল মোহাম্মদ একজনকে গুলি করিলে তার পায়ে লাগিয়া পড়িয়া যায়। অন্যজন বিল্ডিংয়ের পেছনের চিপা দিয়ে পালাইয়া যায়। দীল মোহাম্মদ একজনকে ধরে ফেলে। ... ভোরবেলায় জঙ্গিদের আক্রমণ থামিয়া গেলে পুলিশ উক্ত ফ্ল্যাটের করিডোরে ৯ জঙ্গির মরদেহ এবং তাদের কারও কারও হাতে পিস্তল, ধারালো চাকু, দা ও অন্যান্য আলামত এবং গ্রেনেড দেখতে পায় ও জব্দ করে। আমি ওই সময় পুলিশের সঙ্গে উপরে যাই এবং দেখি। পুলিশ আমাকে জব্দ তালিকায় সাক্ষী করে। আমি জব্দ তালিকায় সই করি।’

লক্ষণীয়, এএসআই দীল মোহাম্মদ কথিত জঙ্গিদের গ্রেনেডে আহত হন। তিনিই আবার পাইপ দিয়ে পালানোর সময় এক তরুণকে গুলি করে ধরে ফেলেন।

একই ধরনের সাক্ষ্য দিয়েছেন স্থানীয় আরও কয়েকজন অধিবাসী। অথচ পুলিশের জব্দ তালিকায় গ্রেনেডের কোনো তথ্যই উল্লেখ নেই।

প্রশ্ন হলো, ভয়াবহ গ্রেনেড, গোলাগুলির পর নিহত তরুণদের হাতে চাকু-দা-পিস্তল কীভাবে থাকে? প্রশ্নটা অবশ্য ২০১৬ সালে নেটিজেনরাও তুলেছিলেন। তবে কর্তৃপক্ষ জবাব দেয়নি।

মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী কল্যাণপুরের গার্ডেন ভিউয়ের কর্মী মো. ওয়াসিমও (২২) ‘লোকমুখে শুনি ও জানিতে পারি’ বলে তার জবানবন্দি দেন।

তিনিও তার সাক্ষ্যে বলেন, ‘গোলাগুলির একপর্যায়ে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলা ও গোলাগুলি বন্ধ হলে সোয়াত টিম ও পুলিশ ওই বাড়ির পঞ্চম তলায় জঙ্গিদের ফ্ল্যাটের সামনে করিডোরে ৯ জঙ্গির মৃতদেহ দেখতে পায়। তাদের কারও কারও হাতে পিস্তল, ছুরি, ধারালো অস্ত্র ও ফ্লোরে কালো কালো গ্রেনেড, অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ও মালামাল দেখা যায়। আমি এসময় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। পুলিশ দুটি জব্দ তালিকা করে আলামত জব্দ করে। আমি দুটি জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করি।’

এছাড়া বাড়ির মালিকের স্ত্রী মমতাজ পারভীন (৬০), ছেলে মাজহারুল ইসলাম (৩৯) ও বাড়ির দারোয়ান জাকির হোসেনও (৪৩) মামলার সাক্ষী।

সবার সাক্ষ্যে ‘পুলিশ দরজা নক করলে ভেতর থেকে তারা গ্রেনেড মারে’ এমন উল্লেখ থাকলেও কেউই নিজ চোখে তা দেখেননি। এমনকি গ্রেনেড সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও সবাই হুবহু একই জবানবন্দি দিয়েছেন।

বাড়ির মালিকের ছেলে মাজহারুলের জবানবন্দি বেশ অদ্ভুত। তিনি বলেন, দ্বিতীয় তলায় আমার স্ত্রীসহ দুই মেয়ে নিয়ে একটি রুমে ঘুমিয়েছিলাম। রাত ১২টার পর বুটের আওয়াজ, মানুষের শব্দ ও পরে গুলির আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে জানতে পারি, বাড়িতে পুলিশ এসেছে, পঞ্চম তলায় জঙ্গি সন্ত্রাসী আছে। জঙ্গি সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ করে গ্রেনেড ও গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। গুলির শব্দে আমরা সবাই আতঙ্কিত ও ভীত হয়ে পড়ি। ভোরবেলায় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল যেন বিল্ডিং ভেঙে পড়বে। একসময় গুলির শব্দ নেই (বন্ধ হয়ে যায়)। পরে জানতে পারি, পঞ্চম তলায় ৯ জঙ্গি সন্ত্রাসী মারা গেছে।’

লক্ষণীয়, ভোরের এমন ভয়াবহ গোলাগুলিতে ৯ তরুণ নিহত হলেও পুলিশের একজনও আহত হননি।

পাইপ বেয়ে নামা তরুণকে গুলি করার গল্প

মামলায় পুলিশের সাক্ষ্যগুলো আরও অবিশ্বাস্য।

অভিযানের সময় দুই তরুণ পালিয়ে যাওয়ার সময় একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আটক হয় বলে পুলিশ বর্ণনা করেছে।

এক নম্বর সাক্ষী এএসআই (নিরস্ত্র) মাসুদুর রহমান (মিরপুর মডেল থানা) বলেন, ‘আমি সঙ্গীয় ফোর্সসহ ৫৩নং জাহাজ বিল্ডিং বাড়ির সামনে অবস্থান করি এবং দেখতে পাই, দুই জঙ্গি সন্ত্রাসী বিল্ডিংয়ের কার্নিশ বেয়ে নিচে নামতে থাকে। একজনের হাতে অস্ত্র ছিল। এ অবস্থায় আমি আমার সরকারি পিস্তল থেকে দুই জঙ্গি সন্ত্রাসীকে লক্ষ করে চার রাউন্ড গুলি ফায়ার করি।’

সে সময় পুলিশের ২০ সদস্য তাদের লক্ষ করে মোট ৮৪ রাউন্ড গুলি করে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

এতগুলো গুলি সত্ত্বেও পলায়নপর এক তরুণ শুধু পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। অন্য একজন পালিয়ে যান। এমন অবিশ্বাস্য বর্ণনাই উঠে এসেছে পুলিশের নথিপত্রে।

ব্যালিস্টিক ও ফরেনসিক রিপোর্টে ভিন্ন তথ্য

পুলিশের এজাহার থেকে জানা গেছে, সেই তরুণরা মোবাইল ফোনে ‘সিওরস্পোর্ট’ অ্যাপস ইনস্টল করে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করত।

তবে মামলায় জব্দকৃত পরীক্ষাযোগ্য আলামতের ডিজিটাল ফরেনসিক (আইটি) বিশারদের মতামতে বলা হয়, সিম্ফনি এ-১০ মডেলের মোবাইল পরীক্ষা করে দুটি মিসড কল, তিনটি ডায়ালড কল ও তিনটি রিসিভড কল-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেছে। আরেকটা সিমে ১০টা কল লগ পাওয়া গেছে। আলামত হিসেবে প্রাপ্ত পেনড্রাইভ দুটি এবং সিম্ফনি মডেল ভি-৫০ ও সিম্ফনি এক্সপ্লোরার ভি-৫২ মোবাইল ফোনের ভাঙা অংশ দুটি ফরেনসিক ল্যাবে ব্যবহৃত টুলস দ্বারা রিডেবল না হওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

অর্থাৎ, ফরেনসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করার মতো কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশের ভাষ্যে নিহতদের অস্ত্রের উৎস

পুলিশ বলছে, নিহতদের সংগঠনের অন্য সদস্য মামুনুর রশিদ রিপন, হাদিসুর রহমান সাগর ও আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশের মাধ্যমে একটি পিস্তল ও পর্যাপ্ত গুলি এনে কল্যাণপুর জাহাজবাড়ীতে তামিম আহমেদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেয়। রিপন জাহাজবাড়ীতে পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করে এবং অস্ত্র সরবরাহ করে। সাগর ও রিপন তিনটি একে-২২ রাইফেল ও পর্যাপ্ত গুলি, গ্রেনেড, ২টি ৭.৬২ পিস্তল ও ১২ রাউন্ড গুলি কল্যাণপুরে এনে তামিম আহমেদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেয়।

পুলিশ আরও বলছে, ভারতে থাকা পরিচিত পুরোনো সদস্যদের মাধ্যমে আব্দুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ অস্ত্র ও গ্রেনেড সংগ্রহ করে ছোট মিজানকে দেয়। ছোট মিজান ও আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসব অস্ত্র ও গুলি ঢাকায় নিয়ে এসে তামিম চৌধুরীকে দেয়। কল্যাণপুর জাহাজবাড়ীতে অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহ করে তারা। সরবরাহকৃত অস্ত্র ও গ্রেনেড কল্যাণপুর জাহাজবাড়ীসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে।

পুলিশ আরও দাবি করে, সাগর তামিম কল্যাণপুর এলাকায় একটি একে-২২ রাইফেল পৌঁছে দেন চৌধুরীর হাতে। রাইফেলটি কল্যাণপুর জাহাজবাড়ীর ঘটনায় ব্যবহৃত হয়। আসামি ইকবাল এই রাইফেলটি নিয়ে জাহাজবাড়ী থেকে পালিয়ে যান।

পুলিশ একবার বলছে, একে-২২ রাইফেলটি কল্যাণপুর জাহাজবাড়ীর ঘটনায় ব্যবহৃত হয়। আবার অন্য জায়গায় বলছে, এক তরুণ পালিয়ে যাওয়ার সময় একে-২২ রাইফেলটি নিয়ে যায়।

ব্যালিস্টিক বিশারদের মতামতে উল্লেখ করা হয়, আলামত চারটি স্থানীয়ভাবে তৈরি (ইমপ্রোভাইজড) পিস্তল।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক সাবেক মেজর নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশ-কে বলেন, এমন ইমপ্রোভাইজড পিস্তল দিয়ে রাতভর পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি করা অসম্ভব। এটা সম্পূর্ণ আষাঢ়ে গল্প।

সবাই পেছন দিক থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত

‘অপারেশন স্টর্ম ২৬’ নামের এ হামলায় নিহত তরুণদের ময়নাতদন্তে প্রত্যেকের শরীরেই একাধিক গুলির আঘাতের চিহ্নের কথা জানিয়েছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ।

তিনি বলেছিলেন, নিহতদের সবাই পেছন দিক থেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রত্যেকের শরীরে সাত-আটটি বুলেটের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেছিলেন, ৯ জনের প্রত্যেকের শরীরেই সাত থেকে আটটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।

তিনি জানিয়েছিলেন, চারটি লাশের শরীর থেকে সাতটি বুলেট বের করা হয়েছে। বাকিদের শরীরে গুলির আঘাতের চিহ্ন থাকলেও শরীরের ভেতরের অংশে কোনো বুলেট পাওয়া যায়নি। গুলিবিদ্ধ হয়েই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছিলেন তিনি।

অথচ পুলিশের দাবি, মুখোমুখি গোলাগুলি হয়েছিল। পিঠে গুলি লাগলেও লাশগুলোর হাতে পিস্তল ও ছুরি ছিল বলে দাবি করে পুলিশ।

অনেক স্বজনের হদিস নেই

নিহতদের একজন পাটকেলঘাটা থানার ধানদিয়ে ইউনিয়নের ওমরপুর গ্রামের তরুণ মতিউর রহমান ঢাকায় একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। তার বাবা নাসির উদ্দিন একজন কৃষক।

গত ৬ নভেম্বর ওমরপুর গ্রামের মেঠোপথে তপ্ত রোদে হেঁটে যখন যাচ্ছিলাম, তখন রাস্তার পাশেই একটি ঘেরে চিংড়ি পোনা ধরছিলেন নাসির উদ্দিন। সঙ্গে থাকা একজন চিনিয়ে দিলেন তাকে। ঘেরের পাশে দাঁড়ালাম। হেঁটে এলেন শীর্ণকায় সেই ব্যক্তি। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। খালি গা। লুঙ্গি কাছা দেওয়া। মাথায় গামছা পেঁচানো। শীর্ণ অবয়ব। চেহারায় অভাবের স্পষ্ট ছাপ।

কুশল বিনিময়ের পর নিহত মতিউর রহমানের প্রসঙ্গ তুললাম, ‘পুলিশ তো বলেছে, আপনার ছেলে জঙ্গি ছিল।’

এমন প্রশ্ন শুনে সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘না। আমার ছেলে জঙ্গি ছিল না। আমার ছেলেকে মারার পর পুলিশ আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেল। সেখানে ১৩-১৪ দিন আটকে রাখল। তারপর ওরা বলল, তোমার ছেলে জঙ্গি নয়। ওসি সাহেব, ডিসি সাহেব... এক পুলিশের বাসায় ১৩-১৪ দিন আটকে রাখল। সেও বলল না, তোমার ছেলে জঙ্গি নয়।’

তিনি জানান, ছেলের লাশও তাকে দেখতে দেয়নি পুলিশ। ঘটনার ২৮ দিন পর গভীর রাতে লাশ দাফন করা হয়।

তিনি বলেন, ঘটনার দেড়-দুই বছর পর তিনি সাতক্ষীরা আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করতে গিয়েছিলেন। আদালত মামলা নেয়নি। এই ঘটনার পর প্রায়ই তার বাসায় পুলিশ আসত।

মতিউরকে শৈশব থেকে লালন-পালন করে বড় করা চাচি নুরুন্নাহার বলেন, সে ভালো ছেলে ছিল। সংসারে কাজকাম করত। এলাকায় মাঝে মাঝে ইমামতিও করেছে। তাবলিগে যেত। তাকে পুলিশ হত্যা করে লাশ দেয়নি। আমরা লাশ নিতে চাইছিলাম।

মতিউরের বড় চাচা এনায়েত মোড়ল বলেন, ‘লাশ ওরা দেয়নি তো! ওর আব্বাকে লাশই দেখায়নি। তিনি বলেছিলেন, আমাকে একটু লাশ দেখাও। তাও দেখায়নি।’

পুলিশের সন্দেহজনক সেই অভিযানে নিহত হয়েছিলেন রায়হান ওরফে রায়হানুল কবির ওরফে তারেক (২০) নামের আরেক তরুণ। তার বাড়ি রংপুর। রায়হানের চাচাতো ভাই শাকিল আমার দেশ-কে বলেন, নিহত হওয়ার ১৫-২০ দিন আগে থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তিনি ঢাকার শ্রীপুরে আপন বোনের সঙ্গে একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন।

‘কতটা অভাবে থাকলে এভাবে ভাই-বোন মিলে ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করতে পারেন, একটু ভেবে দেখুন আপনারা,’ বলেন তিনি। শাকিল বলেন, ‘পুলিশের গুলি লাগায় রায়হান দাঁতভাঙা ও মুখবিকৃত অবস্থায় ছিল।’

তিনি বলেন, ঘটনার পর পুলিশ চাচা-চাচিকে ভয়ভীতি দেখায়। লাশ দেওয়ার কথা বলে তাদের ঢাকায় নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার পর বলে, আপনারা তো সই দিয়েছেন যে আপনারা লাশ চান না। পুলিশ আমাদের কাছ থেকে যাওয়া-আসা বাবদ ১০ হাজার টাকাও নিয়েছিল। জমি বন্ধক নিয়ে টাকা জোগাড় করেছিলেন চাচা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবাদের তো শক্তি ছিল না, কারণ আমরা খুবই গরিব। ঘটনার পর ভয়ে বাসায় কোনো পুরুষ থাকতে পারত না। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছিল। যাকে সন্দেহ হতো তাকেই ধরে নিত। মিথ্যা মামলা করত। যাকেই ধরে তাকেই জেএমবি বানাত।’

শাকিল আরও বলেন, নিহত রায়হানরা দুই ভাই, দুই বোন। সে উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। অভাবের কারণে গার্মেন্টে কাজ করতে ঢাকায় চলে যায়। বোনের সঙ্গেই থাকত। রায়হানের মৃত্যুর পর পুরো পরিবার এখন নিঃস্ব। বড় ভাই আলাদা থাকে।

অভিযানে নিহত আরেক তরুণ মোতালেব ওরফে আবদুল্লাহ (২৩) অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এ তরুণের বাড়ি দিনাজপুরে।

গত ২ নভেম্বর মোতালেবের বড় ভাই মোহাম্মদ নুরুলের সঙ্গে কথা হয়। পেশায় রাজমিস্ত্রি নুরুল দিন আনেন দিন খান। অনেক কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে সংসার চলে।

তিনি আমার দেশ-কে বলেন, ‘আমি রাজমিস্ত্রি। লেখাপড়া করিনি। আমার ভাই মাদরাসায় পড়ত। ছুটিতে আসত। তার মৃত্যুর পর থানা পুলিশ এসেছিল। ঢাকায় গিয়েছিলাম। লাশ দেখেছি। লাশ আনতে পারিনি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক গরিব। পুলিশ যা বলেছে তা নিয়ে কোনো কথা বলার সাহস আমাদের নেই।’

নিহত তাজ-উল হক ওরফে রাশিকের (২৫) বাবার নাম রবিউল হক (৬৬)। নিহত রাশিকের পিতা রবিউল হকের খোঁজে ৩১ অক্টোবর ‘ধানমন্ডি প্রাইড’ নামক অ্যাপার্টেমেন্টে যাই। ভবনটির এক নিরাপত্তা কর্মী জানালেন, রবিউল হক বহু বছর আগেই এখান থেকে চলে গেছেন। মর্মান্তিক সেই ঘটনার পর পরিবারটি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে।

নিহত সেজাদ রউফ ওরফে অর্কের (২৪) বসুন্ধরার ঠিকানায়ও স্বজনদের সন্ধান মেলেনি। এছাড়া জুবায়ের হোসেনের (২০) নোয়াখালীতেও এখন কেউ থাকেন না বলে জানা গেছে। আরেক তরুণকে অজ্ঞাত হিসেবেই দাফন করেছে পুলিশ।

‘কিছুই মনে নেই’ তদন্ত কর্মকর্তার

মামলার পরতে-পরতে ‘মুহুর্মুহু গ্রেনেড’ ছোড়ার কথা বলা হলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজিম ইউনিটের ইন্সপেক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম আমার দেশ-কে বলেন, ‘গ্রেনেডের ব্যাপারে কিছুই আমার মনে নেই।’

‘এত বড় মামলায় গ্রেনেড হামলা, গ্রেনেড জব্দ-সংক্রান্ত কিছুই আপনার মনে নেই?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি ডকেট দেখেন।’

‘ঠিক আছে, সেটা তো দেখেছি এবং ফের দেখব। আপনি তো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন, চার্জশিট জমা দিয়েছেন, আপনার কিছু মনে নেই? ফের জবাব দিলেন তিনি, ‘না। না। আমার কিছুই মনে নেই।’

ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম এখন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে নেই। গত ২৬ নভেম্বর মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়।

গ্রেনেডের বিষয়ে বারবার প্রশ্ন করা হলে তিনি একই জবাব দেন, ‘গ্রেনেডের কিছুই আমার মনে নেই।’ অবিস্ফোরিত কয়টা গ্রেনেড উদ্ধার করেছিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ফের তিনি বলেন, ‘মনে নেই।’

‘বিস্ফোরিত গ্রেনেডের কোনো অংশ উদ্ধারের কথা মনে আছে?’ ‘না। মনে নেই। আপনি মামলার কাগজ দেখেন।’

‘জব্দ তালিকায় গ্রেনেডের উল্লেখ নেই কেন?’

‘আমার কিছুই মনে নেই। আপনি ডকেট দেখেন।’

‘এই ঘটনার পর আপনার প্রমোশন হয়েছে?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না। প্রোমোশন হয়নি।’ টেলিফোন আলাপের সময় তাকে অত্যন্ত ভীত মনে হয়েছে।

অভিযানে কারা ছিলেন? তারা এখন কোথায়?

কথিত সেই অভিযানের মূল কুশীলব সাবেক পুলিশপ্রধান একেএম শহীদুল হক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং মিরপুর ডিভিশনের তখনকার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (পরবর্তী সময়ে ডিসি) জসীম উদ্দীন মোল্লা জুলাই গণহত্যার দায়ে এখন কারাগারে। ৯ তরুণকে হত্যার অন্যতম প্রধান কারিগর ‘কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম’ ইউনিটের তখনকার প্রধান মনিরুল ইসলাম জুলাই গণহত্যার পর পলাতক রয়েছেন।

জাহাজবাড়ী অভিযানের চার্জশিট দাখিলকারী তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশে কর্মরত।

অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া মিরপুরে তখনকার উপকমিশনার মাসুদ আহম্মেদকে পরে চট্টগ্রামের এডিশনাল ডিআইজি হিসেবে সংযুক্ত করা হয়। সেখান থেকে পরে তাকে রিলিজ করে রংপুরের এডিশনাল কমিশনার হিসেবে সংযুক্ত করে আদেশ দেওয়া হলেও ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সেখানে কাজে যোগ দেননি।

এ বিষয়ে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম গত ১ ডিসেম্বর টেলিফোনে আমার দেশ-কে বলেন, ‘মাসুদ আহম্মেদকে এখানে (রংপুর) যোগ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো কাজে যোগ দেননি। সিএমপি থেকে রিলিজ দিলে হয়তো কাজে যোগ দেবেন।’

এ বিষয়ে জানতে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজকে টেলিফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে এ নিয়ে জানতে তাকে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তার জবাব মেলেনি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, তার সর্বশেষ অবস্থান ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। আমার দেশ-এর অনুসন্ধান অনুযায়ী, মাসুদ আহম্মেদ এখন পলাতক।

অভিযান নিয়ে সে সময় নেটিজেনদের সন্দেহ

নিহত তরুণদের জঙ্গি প্রমাণে অদ্ভুত সব তথ্য-প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের তখনকার প্রধান মনিরুল ইসলাম (জুলাই গণহত্যার সময় এসবিপ্রধান)।

তিনি বলেছিলেন, ‘ওই বাসার লোকেরা সারারাতই কথিত জিহাদের পক্ষে স্লোগান দিয়েছেন। তাদের রুমে কথিত আইএসের পতাকা পাওয়া গেছে। প্রচুরসংখ্যক উগ্রবাদী বইপুস্তক পাওয়া গেছে। তারপরও তারা জঙ্গি কিনা, তা বোঝার জন্য কি রিসার্চের প্রয়োজন আছে?’

অবশ্য তখনই নেটিজেনরা তার দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

নেটিজেনদের প্রশ্ন ছিল—‘কল্যাণপুরে চারটি পিস্তল দিয়ে নিহতদের পক্ষে রাতভর মুহুর্মুহু গুলি ছোড়া কীভাবে সম্ভব? কালো পাঞ্জাবি আর জিন্স কি কথিত জঙ্গিদের রাতের পোশাক? জঙ্গিরা সবজি কাটার ছুরি দিয়ে হামলা চালায়? ২৪ ঘণ্টা কালো পাঞ্জাবি পরে থাকে?’

এমন প্রশ্নও নেটিজেনরা করেছিলেন, ‘একটি ছবিতে দেখলাম, ছয়-সাতজন গাদাগাদি করে পড়ে আছে। অন্য আরেকটি ছবিতে দেখা গেল, একজন জঙ্গি ফল কাটার ছুরি হাতে পড়ে আছে। জঙ্গিরা কি গলাগলি করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়েছিল? আর জঙ্গিটি গুলি খেয়ে মরে গিয়েও কীভাবে একটা ছুরি আলতো করে ধরে থাকল? গুলিবিদ্ধ হাত, তবুও মৃত ব্যক্তি আপেল কাটার ছুরি ছাড়েনি। মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, তবুও হাত থেকে আপেল কাটার ছুরি পড়েনি। কী করে এসব সম্ভব!

অনেকেই প্রশ্নে তুলেছিলেন, এত বড় অভিযানে এক পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হলো। কিন্তু বিপক্ষের কোনো ক্ষতি হলো না।

তরুণদের হত্যার পর সকাল ৮টায় ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ডিএমপির তখনকার কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ঘটনাস্থলে গিয়েই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিদের পরিচয় জানা যায়নি। তবে তারা অনেক উচ্চশিক্ষিত।

প্রশ্ন উঠেছে, তাদের পরিচয় না জেনেই এরকম একটি তথ্য আছাদুজ্জামান মিয়া কীভাবে বলেছিলেন? কারও পোশাক দেখে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিশ্চয়ই জানা যায় কিনা, সেই প্রশ্ন উঠছে।

আছাদুজ্জামান মিয়া আরও বলেছিলেন, জঙ্গিরা পুলিশের ওপর গ্রেনেড চার্জ করেছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলে গ্রেনেডের কোনো ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র সেদিন গণমাধ্যমে উঠে আসেনি। এমনকি পুলিশের জব্দ তালিকাতেও গ্রেনেডের কিছুই উল্লেখ নেই।

নেটিজেনরা সেদিন প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘তথাকথিত জঙ্গিরা যে কামরায় ছিল, সেই কামরায় বেশি জানালা ছিল না। আর সেটা সেদিন বন্ধ ছিল। একটি বন্ধ রুম থেকে গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও পাশের রুম থেকে শোনা যায় না! আর মানুষ নাকি রাস্তার অলিগলি থেকে তাদের স্লোগান শুনেছে। এটা কী করে সম্ভব?’

লাশের ছবি প্রকাশ করা হলে দেখা যায়, সবাই আইএসের ইউনির্ফম পরিহিত!

পুলিশের প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছিল, ঘটনাস্থলে প্রাপ্ত ৯ জঙ্গি সবাই কালো পাঞ্জাবি এবং বিশেষ ধরনের পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। কারও কারও শরীরের সঙ্গে ব্যাক প্যাক ছিল। অধিকাংশের পায়ে কেডস ছিল।

পুলিশের ভাষ্যমতে, জঙ্গিরা পুলিশের দিকে ১১টি গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে, আর রাতভর অনেক গুলি ছুড়েছে। অভিযানের পর চারটি পিস্তল, ২২ রাউন্ড গুলি, ২৩টি গ্রেনেড, কিছু চাকু ও তলোয়ার এবং পাঁচ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধারের কথা জানিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জব্দ তালিকায় গ্রেনেডের কোনো তথ্যই উল্লেখ করা হয়নি।

জঙ্গিদের কাছে তাহলে গুলি করার মতো রিভলবার ছিল মাত্র চারটি। সেই চারটি রিভলবার দিয়ে হাজারখানেক পুলিশের সঙ্গে সারারাত লড়াই করা কি করে সম্ভব, সেই প্রশ্ন উঠছে।

জাহাজ মঞ্জিলের ওপর থেকে পুলিশের দিকে ১১টি গ্রেনেড ও অজস্র গুলি ছোড়ার ক্ষেত্রে সামান্য হলেও পুলিশের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা। এর আগে হলি আর্টিজানে মাত্র দুটি গ্রেনেডে গুলশান থানার ওসি সালাউদ্দিন ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম নিহত হয়েছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছিল। তাহলে জাহাজবাড়ীতে ১১টি গ্রেনেডে কারও একটুও ক্ষতি হলো না?

অপরাধ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য

পুলিশের জাহাজবাড়ী ‘জঙ্গি গল্প’ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক আমার দেশ-কে বলেন, ‘গ্রেনেড নিক্ষেপ হলে এর বাইরের কাঠামোগত কিছু না কিছু এভিডেন্স থাকবেই। এছাড়া ভেতরের উপাদানগুলোর কিছু না কিছু অংশ পাওয়া যাবে। যেমন- স্প্লিন্টার বা অন্যান্য উপাদান। এছাড়া মুহুর্মুহু গ্রেনেড ছুড়ে মারলে তো ভবনের কাঠামোগত পরিবর্তনও হবে। কিন্তু তা কি হয়েছে?’

তিনি আরও বলেন, পুলিশ যে ধরনের হামলার কথা বলেছে, তাতে তাদের বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটার কথা। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। তিনি মনে করেন, ‘জঙ্গিবাদের নামে যা হয়েছে, তা নাটক।’

আইনজীবীরা যা বলছেন

ওই অভিযানের পরদিন রাতে মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক মো. শাহজাহান আলম বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেন। আসামি করা হয়েছিল ১০ জনকে। এরপর দীর্ঘদিনেও বিচার শুরু হয়নি আলোচিত সেই ঘটনার।

বিচারসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর আমার দেশ-কে বলেন, ‘এমন একটি আলোচিত মামলায় স্বৈরাচারী সরকারের আমলে বিচার প্রক্রিয়া শুরু না করার বিষয়টি যথেষ্ট সন্দেহজনক। মামলার পদে পদে দুর্বলতা আছে বলেই হয়তো ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়োগকৃত প্রসিকিউশন আইনজীবীরা এই মামলাটি বিনা বিচারে ফেলে রেখেছিল।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ আমার দেশ-কে বলেন, ‘একটা মামলায় এত বেশি অসংলগ্নতা মূলত সুস্পষ্টভাবে মিথ্যা মামলার ইঙ্গিত বহন করে। বিচার বিভাগ নিয়ে রাষ্ট্রের এ ধরনের অপকর্ম রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের নিকৃষ্টতর নজির।’

তিনি বলেন, ‘দীল মোহাম্মদ শুরুতেই গ্রেনেড হামলায় আহত হলে পরে আবার কার্নিশ দিয়ে আসামি পালানোর সময় গুলি করে ধরে ফেলা সাংঘর্ষিক বক্তব্য।’

অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার আরও বলেন, ‘পঞ্চম তলায় থাকা অবস্থায় দুই আসামি যখন পালাচ্ছিল, তখন বিল্ডিংটার চারপাশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘেরাও করে রেখেছিল। এতগুলো পুলিশের গুলি এড়িয়ে কর্ডন ভেদ করে পাঁচতলা থেকে পালানো কেবল মাসুদ রানার থ্রিলার মনে করিয়ে দেয়। সাক্ষী বলছে, আলামত জব্দের সময় সে গ্রেনেড দেখেছে, কিন্তু জব্দ তালিকায় নেই। এটাই মিথ্যার বড় প্রমাণ।’

এখন যেমন তাজ মঞ্জিল

‘জাহাজবাড়ী’ হিসেবে পরিচিত তাজ মঞ্জিলে গত ১০ নভেম্বর গিয়ে কথা হলো ভবনটির কেয়ারটেকার সাবিনা শাহনাজের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। ২০১৮ সালে তিনি এই বাড়িতে এসেছেন।

বললেন, ‘ওই দুর্ঘটনার পর ২০১৮ সালে বাড়িওয়ালা মারা গেছেন। তার স্ত্রী বৃদ্ধা। ছেলে আমেরিকায় থাকে। এখনকার সব ভাড়াটে নতুন।’

সেই মামলায় স্থানীয় যেসব ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়েছিল, পুলিশের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

ad
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত